লেখক নয় , লেখাই মূলধন

চন্দ্রাণী গোস্বামীর গুচ্ছকবিতা

আত্মবিশ্বাস

চ্যালেঞ্জের অভ্যাস থাকলে একেকটা অসম্ভবকে আরোহণ মনে হয়

এই যেমন পাহাড়ে আমিই প্রথম সূর্যোদয় দেখবো বলে
অন্ধকার থাকতেই খাড়াই বেয়ে উঠে আসছি,

ধারেকাছে বা খানিক দূরে রডোডেনড্রনগুলোর ক্যানভাসে
রং ও খুশির সিম্ফোনি

একজীবনে মনোযোগ দিয়ে অঙ্ক কষতাম

এখন চোখ তুললেই দেখতে পাচ্ছি তৈলাক্ত বাঁশের ভেতর দিয়েও
বাঁদরটা বেশ সপ্রতিভ ভাবে উপরে উঠে যাচ্ছে

ক্রমশ নিজেকে আত্মবিশ্বাসী লাগে।

চুপকথারা

কখনো কখনো চুপকথারা সশব্দ কথার মাঝে এসে যায়। অজান্তে।

কখনো কখনো গরজি গরজি গুমরি গুমরি মেঘেও কেউ
ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে, ট্রেন ছেড়ে দিলে কথারা “আবার এসো” বলে ওঠে,
অথচ চুপকথারা অজান্তেই বলে ফেলে, চলো একবার ভিজি একসাথে। লেটস গো।

এই বলা আর না বলা কথাগুলোর সন্ধিক্ষণকেই হয়তো বিরহ বলে—

তারপর সমান্তরাল পথের দুধারে পড়ে থাকা ধুলো পাথর মন প্রভৃতিকে
প্রাচীন বটের শিকড়ে সাক্ষী রেখে চুপকথারা আবার ফিরে যায়
নৈঃশব্দ্যের গহীনে।

প্রাকৃতিক

আমার বাবা লম্বা ছিলেন না। বেঁটেও নন।
মধ্যবিত্ত সাংসারিক ভাষায় যাকে বলে মাঝারি।

তিনি ঘাড় সোজা করে আকাশ দেখতেন
তাঁর চোখের নিচে মেঘ থমকে যেত,
আর বিস্ময়ে রোদ ঠেকে যেত তাঁর তামাটে কপালে।

বিশ্বাসে, শ্রদ্ধায়, সমর্থনে ওনার সাথে
আলো, হাওয়া, জল অনর্গল গল্প করতো।

পূর্বাভাস

সে মেঘের কথা মনে করলেই আর বৃষ্টি হতো না
একবুক দহন নিয়ে কবিতার খাতা খুলতো
জ্বলে যেত অক্ষরগুলো, তবু ভিজত না—

পোড়া অক্ষরগুলো নিয়ে সে দোতারা বাজাত ;

আকাশের গায়ে আবার তখনই কানাই কালো মেঘ—
নয়ন সরসি তার ভরে উঠতো জলে,

এমন সময় অক্ষরগুলো ভিজে চুপচুপে হয়ে খাতায় নেমে আসতো ক্রমে—

ব্যাস, ঠিক তখনই আবহাওয়া দপ্তর ঘোষণা করে দিত,
বর্ষার মেঘ সরে গেছে। অতএব আজ সারাদিন আকাশ রৌদ্রজ্বল থাকবে।

মেঘ-বৃষ্টির কথকতা

মেঘ জমেছে বৃষ্টি হবে ধুর, বয়েই গেল।

যেদিন সক্কালবেলা ঘুম ভেঙে উঠে কিছু মনে পড়ত
সেদিনই জানলার পাশে বাতাবি গাছটায় রোদ থমকে দাঁড়াত।

সেসব দিন গ্যাছে
লালচে মেঘ ধপধপে ইস্ত্রির মতো আকাশ দুটো টিকিট

শুধু যেদিন মা বাগানে ঝরা পাতাগুলো জড়ো করে
আর পোড়ায়
অদ্ভুত এক আনন্দ পোড়া গন্ধ আমার নাকে আসে—

সেদিন, সেদিনই
আমি ধোপদুরস্ত পোশাক পড়ে মুখে পান ঠুসে
নিজেকে সঙ্গে নিয়ে অপেরা দেখে আসি।

পুরোটাই তর্ক

একবার ভেবে দেখো, কাল সারারাত ঝড়ের পর তুমি পরিত্যক্ত বাগানে খসে যাওয়া হলুদ পাতাগুলো পরিস্কার করতে গেলে, এমন সময়ই চৌদিক ঝলমল করে মাথা নাড়িয়ে হেসে উঠল পাকা আমনের হলুদ স্নেহান্ধ শিষগুলো।

কবি হিসেবে এই হলুদকে প্রেম খসে পড়ার সিম্বল ধরে নিয়ে এতকাল যে অজস্র বিরহজনিত কাব্য লিখে তুমি সকলের বাহবা কুড়ালে, আর প্রাণ হিসেবে সেই হলুদ আজ তোমায় বাঁচার ইঙ্গিত দিচ্ছে— একে কি তোমার দ্বিচারিতা বলবে?

একে আমি অপদার্থদের সার মর্ম বলি।

Facebook Comments

পছন্দের বই