লেখক নয় , লেখাই মূলধন

নিত্যানন্দ দত্তের গুচ্ছকবিতা

ইস্কুলবাড়ির কবিতা

রেনি ডে

যেদিন বৃষ্টি খুব, আলোয় ঝমঝম করে গাছ।

গুটিকয় সিক্ত কিশোর শূন্য ক্লাসঘরে মৃদু মৃদু কাঁপে, বোতামের ঘরে ঘরে বৃষ্টির ছাঁট এসে জমে, জমে সুদূরের ছোটবেলা থেকে বিষাদের মেঘ…

সেই ভাঙাচোরা ইস্কুলবাড়ি, সাতসতীনার দীঘিতে দাউদাউ রক্ত শালুক, তাদের সহিষ্ণু মৃণাল নেমে গেছে জলের গভীরে, দমকা হাওয়ায় সুপক্ক হরিতকি খসে পড়ছে ঘাসে…

আর ইংরিজির নারায়ণবাবু সুগম্ভীর ঝুঁকে আছেন কুন্ঠিত খাতায়। ভুলের ভেতর থেকে এক আশ্চর্য জাদুকরের মতো তুলে আনছেন সঞ্জীবনী ফুল…

***

ছুটি

ছুটির ঘণ্টা বাজলেই স্কুল বাড়িটি আচমকা নিঝুম হয়ে আসে…

অবিশ্রাম ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত ফ্যানেরা হাত পা ছড়িয়ে বসে, শুকনো দেবদারু পাতা শূন্য করিডরে একা একা ওড়ে আর ওড়ে, বিকেলের শ্রান্ত আলো দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে…

পশ্চিমের বারান্দায় সুবিনয়কাকু প্রতি সন্ধ্যায় এভাবে একলা বসে থাকেন। ধোঁয়ার উষ্ণতা উড়ে উড়ে চায়ের কাপ মৃত্যুর মতো ঠান্ডা হয়ে আসে।

গতবার পুজোয় মন্দারমনির জোয়ারে ভেসে গেল ছেলে মেয়ে দুজনেই…

তারপর থেকে ছুটি হওয়া স্কুল বাড়িটির মতো সূর্যাস্তের আলোয় তিনিও স্তব্ধ বসে থাকেন
…অপেক্ষায়…

***

পরীক্ষা

সাদা পৃষ্ঠার ওপর হেঁটে যাচ্ছে কৃষ্ণবর্ণ আলো। তাদের বিনীত চলার শব্দে মৃদু মৃদু কেঁপে উঠছে মাটি…

যেন পাহাড়ি জনপদের ছোট্ট গুম্ফায় সান্ধ্যঘণ্টা বাজিয়ে ফিরে যাচ্ছেন বৃদ্ধ লামা, তার মন্থর ধ্বণি দূরের পাহাড়ে পাহাড়ে রেখে আসছে বুদ্ধের বরাভয়, খাদের ধারে ধারে সারিবদ্ধ রঙিন পতাকা কাঁপছে সামান্য বাতাসে …

কেউ কাউকে ফিরিয়ে দিচ্ছে না কলমের ঠোঁটে। কাগজের অকুলানে কেউ কাউকে ঠেলে দিচ্ছে না অনিশ্চয় খাদে …

***

ফার্স্টবয়

গরাদহীন ছোট্ট জানালা দিয়ে সে দেখে দামোদরের চরে দূর দূর থেকে উড়ে আসে পরিযায়ী হাঁস, তাদের শুভ্র পালক থেকে আনন্দজল খসে পড়ে নিরন্তর, জেলে বউ কোচরভর্তি পুঁটিমাছ ধরে রূপোলি আলোর পথে পথে ফেরে…

বর্ষার আলুথালু জলে তার ভেতর থেকে গলে পড়ে মাটি

শুধু বছরের একটি দিন সে জাদুকরের রঙিন পোশাকে স্কুলে এসে দাঁড়ায়। তার তিমির বরণ শরীরে আলো ঝলমল করে। বাতাস তার পূর্ণতার খবর নিয়ে যায় চিকন দেবদারু পাতার কাছে, জলের শীতলে ঘুমন্ত শ্যাওলার কাছে…

শূন্যের পূর্ণতা নিয়ে হাওয়া আজ হুল্লোড় করেছে সারাদিন
আর সে, দুপাশে প্রগাঢ় শূন্যতা নিয়ে ঘরে ফিরছে
একা

Facebook Comments

পছন্দের বই