লেখক নয় , লেখাই মূলধন

পঙ্কজকুমার বড়ালের কবিতা

নিঃঝুম শূন্যতা ওড়ে


রাতের ভেতর রাত৷ ক্রমশ গহীন বন, ছোটো ছোটো টিলা৷ মনোরম ঘাসের গালিচা পেতে শিশির ঘুমায়৷ গাছে গাছে জোনাকি আলপনা৷ একটি নদী, তার হাঁটু জলে হেঁটে যায় নুড়ি— কাঁকড়, ছোটো মাছের ঝাঁক৷ একসময় চকিতে উঁকিমারে বুনো চাঁদ, তারপর ডানা মেলে এগিয়ে আসতে থাকে৷ বাতাস ওড়ে, বাতাসের চুল থেকে খসে পড়ে অচেনা ফুলের সুবাস৷ সমীরণ টিলার বুকে মাথা রাখে, যেন তপস্যা ক্লিষ্ট কোনো ঋষি এইমাত্র ঘুমিয়ে পড়েছে৷ তার একটি হাত বুকের উপর পরম নিঃসঙ্গতায় লীন হয়ে আছে, অপরটি ঝরাপাতার মতো মাটির শরীর জুড়ে এলিয়ে রয়েছে— এখন চরাচর জুড়ে ঘুমের জগৎ৷ কোনো অপেক্ষা নেই, যন্ত্রণা বিবশ হয়ে আছে, ইচ্ছের দুয়ার এঁটে দিয়ে না পাওয়ারা গান হয়ে ভেসে গেছে অলীক আকাশে৷


জাগো হে, জাগো— চেতনা দোলা দিয়ে ওঠে৷ অজান্তেই হাত চলে যায় পাশে৷ কে ডাকে! পাশ বালিশের শরীর জুড়ে ছড়িয়ে থাকে কোমল অভিমান৷ ধীরে ধীরে চোখ মেলে সমীরণ৷ জানলা দিয়ে চুঁইয়ে নামছে আলো৷ তার নরম ছোঁয়ায় উঠে বসে সে৷ কী এক স্বপ্নের ঘোর, যেন মাথার ভিতর রাশি রাশি তুলো গোঁজা৷ এক অদ্ভূত অনুভবে সে যেন ডুবে যেতে থাকে৷ বাইরে উঠোন জুড়ে শালিকের ডাক৷ গাছের শিরা বেয়ে নেমে যাচ্ছে রৌদ্র শিহরণ৷ একসময় দরজায় টোকা পড়তে থাকে৷ সমীরণ বুঝতে পারে না কোন দরজার কড়া নড়ে যায়৷ কেবল টোকা পড়ে৷ দরজার শরীর জুড়ে শব্দ ওঠে ঠক্..ঠক্..ঠক্৷


যেন কোথাও কিছু নেই, অশেষ আকাশ৷ একটি ঘুড়ি সুতোহীন উড়ে যেতে থাকে৷ ঘুড়ির পিছে পিছে ডানা মেলে দিনের ছায়ারা৷ সমীরণ বসে থাকে দীঘির পাড়ে৷ সমস্ত দীঘি জুড়ে হাঁসের সফেদ৷ তাদের চঞ্চুর ধারে ক্ষয়ে যায় বাতাসের আয়ু৷ সমীরণ সে সব দেখে অথবা দেখে না৷ সে শুধু বসে থাকে৷ যেন একটি প্রকাণ্ড চাকার উপর বসে আছে সে৷ চাকাটি ঘুরতে ঘুরতে নেমে যাচ্ছে মহাতলের দিকে৷


প্রাণপনে মাটি আকড়ায় সমীরণ৷ সে যেন একটি গাছ৷ একমাথা ডালপালা, শেকড়ে পলির উষ্ণ ঘ্রাণ৷ আর একটি লতা, ফুলে ফুলে ফলের আকুতি নিয়ে সে যেন জড়িয়ে আছে সমস্ত ভূবন৷ সবুজ রক্ত চলকে উঠছে তার৷ অতঃপর স্বপ্ন আসে, কত স্বপ্নের কথাবিতান পৃষ্ঠা মেলে দেয়৷ অভিমানের নিঃশ্বাসে লতা গাছটি গুমড়ে ওঠে— কথা বলো, কথা বলো গাছ৷


মনের বাগান জুড়ে টুপটাপ পাতা খসে যায়৷ ময়ালের মতো নিঃশব্দে বয়ে চলে হাওয়া৷ সমীরণ বুঝতে পারে তার ভিতরে আর কোনো গান বেঁচে নেই, স্বপ্নের পাঠশালা ভেঙে গেছে কবে! ক্রমশ শুকিয়ে যাওয়া শিকড়ের ফাঁস ঢিলে হয়ে গেছে৷ এখন কেবল নিঃশেষের পালা৷ যে মনে ফোঁটেনি ফুল, সবুজের হাতছানি, যাবতীয় রঙের বাহার তার কাছে বোবা আয়োজন৷


তবুও এক স্পন্দন জেগে থাকে বুকে! কী আশ্চর্য, কী দারুণ যন্ত্রণাময়! জমে থাকা ঘন কালো মেঘে বিস্ফোরণ ঘটে গেলে যেমন হঠাৎ চলকে ওঠে আলো, তেমন এক স্পন্দন মাঝে মাঝে গুমড়ে ওঠে বুকে, নিঃশব্দে বজ্রপাত হয়৷ সমীরণ চোখ বন্ধ করে৷ তারপর দেখতে থাকে নিজের ভিতর৷ শত শত ছায়াপথ, ব্রহ্মাণ্ড ছাড়িয়ে আরও দূর, গহীন দূরত্বে, যেখানে কেউ নেই, কেবল শূন্যতা৷ অথবা শূন্যতাহীন অপার স্পন্দন৷

Facebook Comments

পছন্দের বই