লেখক নয় , লেখাই মূলধন

পঙ্কজ চক্রবর্তীর গুচ্ছকবিতা

সম্মেলন

তোমার কবিতা শুনি বাদলের দিন প্রিয় নয়
ধারাবাহিক নগ্ন জীবনের বিষণ্ণ ছায়া
শব্দ পেরিয়ে এসে আহত বাক্যের ক্ষত

প্রতিবিম্ব ছেড়ে গেছে লঘুশোকের সবদিন
হীনমন্য মানুষের প্রতিশোধস্পৃহা
রচনার এইসব দিনে আঁতুরঘরের শান্ত ধোঁয়া
লেখার উপর থেকে মুছে দাও পুরস্কারধন্যতার আলো

অহেতুক এই বিবেচনা যেন অক্ষমের শেষ আস্ফালন
তোমার শান্ত ঘুম প্রয়োজন আজ

তোমার শান্ত ঘুম আজ এক জরুরি সংবাদ

সম্মান

একজন ভালো মাছবিক্রেতা
তার অহংকারের কাছে আমি ছোটো হয়ে গেছি
শিক্ষকের সম্মান কতদূর হাঁটে
জোনাকির পথ তার করায়ত্ত নেই

ভাবি কিছু উপদেশ দেব
উদাসীন মাছের স্তূপ আমাকেই নগ্ন করে দেয়

এখন দেওয়াল জুড়ে সান্ত্বনার রঙিন কিছু বাণী
বাড়ি ফিরছি ধীর পায়ে মেছো গন্ধের স্বাদ

বাজার শেষ হয়ে গেছে বঁটির হুঙ্কার এখনও থামেনি

সন্ত্রাস

সংঘটিত হত্যার আকাশ— দূরত্ব রচনা করি
নিরাপত্তা বলয় জুড়ে তোমার মহিমা
মানুষের ব্যলক্তিগত সুখে শুধু অতীতচারিতা
বিন্যাসের রকম ফেরে কার্যকর হয়েছে পুতুল

পায়ে চলার পথ চিহ্ন মুখর
ডালে ডালে সন্ত্রাসের অনিবার্য শোক
মুগ্ধ বালকের ধুলোবাতাসে সব গান নষ্ট হয়ে গেছে

এখন আকাশ জুড়ে ছোটোখাটো সান্ত্বনার দ্যুতি
কাছের মানুষের চোখে কিছু ধূসর ইশারা

অনেক মানুষের এই মৃত্যু আমাদের প্রতিবেশী নয়

সন্ততি

অবসন্ন মানুষের ডালপালা ছড়ানো বিকেলে
ছাদের উপরের নির্জন ঘরে
সে শুধু পালক ভাসায় দিনরাত

একলা মানুষের নিঃসঙ্গ বুকের ইতিহাস নেই
ভূগোলের নদ-নদী তার কোনো প্রতিবেশী নয়
একান্ত নিবিড় যৌনতা দুপুরের বাথরুম জানে

পাশের বাড়ির গুল্ম লতাপাতা তাকে ঘিরে রাখে
বোবা কথার এই শুধু সামান্য সংলাপ

মাঝে মাঝে আকাশে বাড়িয়ে হাত জাগে অট্টহাসি
একটি মেয়ের দুঃখ অভিভাবকের পায়ে পায়ে ফেরে

উঠোনের মাধবীলতা এখনও সন্তানের মতো দুঃখ পায়

শুশ্রূষা

এই যে ব্যাধির পাশে উষ্ণ মুখের অভ্যর্থনা
মানুষের নগ্ন ভালোবাসা
প্রচ্ছন্ন রয়েছে মুগ্ধ আড়ালবাড়তি সতর্কতা

তবুও তোমার কাছে শুশ্রূষা নেই
অপরাধ আর কিছু বাড়তি সন্দেহ
উপত্যকা পেরিয়ে যায় আমাদের দ্রুত স্বভাববদল

এখন ঢেউয়ের আলো সঙ্গতিবিহীন
পরিচর্যা নেই কোনো অহেতুক বাতাবরণের
আরোগ্য ফিরে আসে এই মর্মে

একটি বাড়ির চরাচর অপরাধমনস্ক তুমি কি প্রস্তুত?

লিবিডো

আশ্চর্য নদীর গল্পে পূর্বপাঠের ফের আলোচনা
উপকাহিনির স্রোত পাড়ায় পাড়ায়
যেন এক দৃশ্যপটে বসে আছে গৃহস্থের লোভ

আরোগ্যের চিহ্ন নেই
বেড়ার ফাঁকে ভোরের আলোটি ঘুমোয়
চোরাস্রোতে ভেসে যায় স্বপ্নলব্ধ সমস্ত অসুখ

পিতার রমণদৃশ্যে জেগে ওঠে সন্তানের মুখ

যৌনতা

প্রস্তুতি বাঘের মতো
সারাদুপুর আমায় খুঁজে বেড়ায় সে
শিহরণ টের পাই এই আবহাওয়া

পালিয়ে এসেছি পুকুরের ছায়া-মাখা বিকেলের কাছে

এখনও তোমার নখে খিদের প্রতীক্ষা
হাঁড়ির নীচের ভাত পুঁড়ে যাচ্ছে উদাসী হাওয়ায়
যেন ঘরে ফেরার সংকেত ছাই চাপা আগুনের মতো

আমার অশৌচ কাটেনি— মিথ্যে বাতাসে তারই প্রস্তুতি

যুদ্ধ

যতদিন যুদ্ধ শহীদের মৃত্যু মহান
রাষ্ট্রের মহিমা আমি বুঝি
রক্তের বিনিময়ে ঘুমের সফল আয়োজন

একটি বালকের মুখের হাসি স্তব্ধ হয়ে গেছে

মঞ্চের আলো জুড়ে বেজে ওঠে শোকের প্রণয়
অর্থ ইনাম এসে জুড়ে দেয় স্মৃতির বিরহ
নেই কোনো আয়োজন সফলতা উদ্দেশ্যবিহীন

একটি বালকের ঘুমন্ত স্কুলব্যাগে শহরের উদাসীন হাসি

মর্মকথা

এই চলাচল আমি আর বইতে পারি না
ফিরে যাব এমনই তুচ্ছ অপরাধ
অপারগ মানুষের জটিলতা ফিরে ফিরে আসে

পরিধির দিকে সবাই চলেছে
একা মানুষের সন্দেহ কাটে না কিছুতেই

যদি যাই, যদি ফিরে আসি গ্রহণের হাত তুমি সরিয়ে নিও না

ভ্রূণ

স্বামীর অন্তর্বাস কাচতে কাচতে মেয়েটির মনে পড়ে
বিগত অভিশপ্ত রাত
এই যোনির ধূসর প্রান্তরে একটি কুসুম ঝরে গেছে

নতুন পুরুষের নগ্ন আঁকিবুকি
মুক্তোর খোঁজে তুমি হন্যে হয়ে পথ হারাবে
আমার বুকের ঘাম মঙ্গলসূত্র পায়নি এখনও

তোমার সংসারে আমি সৌন্দর্য প্রতিমা এনে দেব
লুকিয়ে রাখব লগ্নভ্রষ্ট জীবনের ডানা
প্রেম নেই কিছু মায়া ভালোবাসার উঠোনে

আমার কুসুমের পিতা হবে রাত্রির ঘনিষ্ঠ ডুবুরি?

পুতুল পুতুল

সাহস একরকমের আলো
ডানায় লুকিয়ে রাখা শান্ত বিদ্রোহ
তাকে আমি প্রত্যক্ষ করেছি এই অবেলায়

অবৈধ সঙ্গমে আমার যত আস্থা বিপ্লবের প্রতি
ছলনার জীবনে শান্ত যাতায়াত
নগ্ন হাতিয়ারে টুকরো হয়ে গেছে সমস্ত সান্ত্বনা

তুমি পিছনের দরজা দিয়ে এসো
তুমি সামনের দরজায় ছদ্মপ্রহরী
আমি ডাকনাম ভুলে গেছি মানুষের অসহিষ্ণু চোখে

ছেলেবেলার পুতুলের এই শোক আমাকে কাঁদতে দেয় না

ক্ষত

যন্ত্রণার কিছু দূরে মায়াপুতুলের ঘর
কোনো অভিযোগ নেই
সন্দেহের ছায়ায় তোমার নিবিড় মুখ

একটি দিনের রেখা মুছে গেছে
গুপ্তঘাতকের মরচে ছুরি অসহায়

শব্দের গুহায় বসে আছে আশ্চর্য ব্যাধের মনীষা

উৎপাদন

কত কবিতার গর্ভপাত দেখে এ জীবনে বড়ো হয়েছি

তেমন কিছুই নয়
তবুও তোমার কবিতা পড়ে মুগ্ধ হই মনে মনে
না লেখার দিনগুলিতে ঋতুমতী নারীদের মতো

আমি চাই এলোপাথারি ঝড়ে
উড়ে যাক সদ্যোথজাত সমস্ত কবিতা
অতি উৎপাদনের দিনে দিকে দিকে তারই সংকেত

অনুকরণপ্রিয়তা দেখে ভয় জাগে শোকের মর্মমূলে

টের পাই মাতৃস্বভাব ঝড়বাদলের দিনে
অবুঝ জলপাই বনে কাঠকুড়োতে এসেছে
মনে মনে স্বাধীন মানুষটি পথ হারিয়ে ফেলছে বারবার

মনে মনে স্বাধীন মানুষটি ভুল কামনায়
অহেতুক ফেঁসে গেছে শোক সম্মেলনের ফুলের মতো

সংকেত

হেঁটে বেড়াই তন্দ্রার পাশে
ঘুম আসে না
টের পাই বয়স বাড়ছে তোমার
শরীরে জেগে ওঠে উদাসীন চর

বিপজ্জনক বাড়ির পাশে দু’জনের ঝড়ের আবহ
সন্দেহের কাঁটা দিয়ে তুলে নিই সব বিরোধিতা
ছোটো কবিতার মতো সংকেতপ্রবণতা— রহস্য আদিম

তোমার আখ্যান তুমি লিখে নাও
ওগো ধারাবাহিক ক্রমশ প্রকাশ্যও!

সশস্ত্র

ধার দেনা শোধ করে সুখী মানুষের নিরাপত্তা
আমাকে প্ররোচিত করে
অস্ত্র হাতে নিই

দুরাশা আর দিবাস্বপ্নের এই তো উপায়
কিছু জটিলতা নিজস্ব ব্যক্তিগত টান

উপেক্ষা দিয়ে সে সন্ত্রাস মোকাবিলা করে

রঙিন গল্পের শেষে ফানুস ওড়ায় শিশুদের চোখে

ভাষাবন্দনা

এই গল্পের শেষে আপনি পাবেন মধুর ভাষার ঠিকানা
চরিত্রের সন্দেহজনক দোলাচল
কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবেন পথনির্দেশ নেই
কয়েকটি বাস্তুঘুঘু কবি ও ক্লাউনের স্বদেশ

দূরপাল্লার ট্রেনে জেগে উঠেছে ধূসর তন্দ্রাপথ

নখ আর বাহুর এই তো সৌজন্য— লুপ্ত সতর্কতা
রক্তে পারদর্শী গুপ্তবিদ্যার নিঃশব্দ আস্ফালন

ভুল পাঠকের সমর্থন লুফে নেয় মায়াবী বাজার
প্রত্যাখ্যানের ভাষা কথার আদলে নেই পাঠপ্রতিক্রিয়া

উপমা রক্ষিতা তুমি গয়নার লোভে আজ পাগল হয়েছ

Facebook Comments

পছন্দের বই