লেখক নয় , লেখাই মূলধন

প্রবুদ্ধসুন্দর করের দশটি কবিতা

সংক্রান্তি

চৈত্রশেষের বাতাস ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল
—বল বস্, কাল মাংস হচ্ছে তো তাহলে? দই? খুব ভোরে স্নান?
তেলচিটে গেঞ্জি আর জাঙিয়ার ওপর গলিয়ে নেবে আদ্দির পাঞ্জাবী?
বিকেলে আশ্রম যাবে? কাব্যলোক? রবীন্দ্রসংগীত?
ফেরার পথে কি ছুঁয়ে যাবে লক্ষ্মী বস্ত্রালয়? শ্রীহরি ভাণ্ডার?
রাতে কি হুইস্কি? কাজু? শশা আর টম্যাটো স্যালাড?
আড়াই পেগের পর, হুক খুলতে খুলতে বৌকে কি বোঝাতে চাইবে
তুমি আজও সেই জকি, যার ঘোড়ার ওপর চোখ বুঁজে বাজি রাখা যায়?
উঁহু, চমকে ওঠো না বাঞ্চোৎ। এ হচ্ছে থটরিডিং।
চৌদ্দশো আটের মতো, এবারও তোমাকে
ঘেঁটি ধরে ওঠবস করাবে, মদন গুপ্ত, নয়ত বেণমাধব শীল।

ভাঁড়

জতুগৃহ থেকে যারা কখনোই পালাতে পারে না
পালাতে না পেরে যারা প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে
আড়মোড়া ভাঙে, হাই তোলে, দাঁত মাজে
বাথরুমে গান গায়, তারিয়ে সাবান মাখে রোজ
আবারও দপ্তরে ছোটে, টেবিল বাজায়
বেতনবৈষম্য নিয়ে জোর তর্ক করে
বিকেলে রাস্তায় হাঁটে, আড়চোখে মেয়েদের দেখে
জন্মনিরোধক আর বেবিফুড কিনে বাড়ি ফেরে
সেইসব সংখ্যালঘু অর্ধদগ্ধ ভাঁড়
তাদের গোপন আড্ডা থেকে আমাকেও চিঠি লেখে
তীব্র হাহাকার আর গোঙানি মেশানো
সেইসব চিঠি পড়ে, উত্তর না লিখে আজও চুপ করে থাকি
আমার মৌনতাহেতু, সম্ভবত, তাদের ধারণা
জতুগৃহ থেকে তবে আমিও পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছি।

দরজা

যে তোমাকে ছেড়ে যেতে চায়
তাকে যেতে দাও
আটকে রেখো না।
একটি কথাও না বলে তার
ব্রিফকেস গোছাতে সাহায্য কোরো।
প্রেসার বা থায়রয়েডের ওষুধ সে যেন
ভুল করে ফেলে না যায়। শূন্যতা ছাড়া
সে যেন ছেড়ে না যায় অন্য কোনো স্মৃতি।
অশ্রুগ্রন্থি থেকে যেন বেরিয়ে না আসে সূচ্যগ্র তরল
ঘুণাক্ষরেও তোমার মুখে যেন জলবসন্তের মতো
আর্তি আর হাহাকার ফুটে না ওঠে।
শুধু এগিয়ে দেওয়ার পথে নিচু স্বরে তাকে বোলো
দরজা ভেজানো থাকবে
টোকা দেওয়ার দরকার নেই।
আলতো ঠেলে দিলেই কপাট খুলে যাবে।

গাইড

দেখুন, এই যে রাজবাড়ি। উজ্জ্বয়ন্ত প্রাসাদ। এখন বিধানসভা ভবন।
এই জোড়া দিঘি, বাঁয়ে জগন্নাথ জিউর মন্দির।
লক্ষীনারায়ণবাড়ি। ডানে আনন্দময়ী আশ্রম।
এই যে স্পোর্টস কমপ্লেক্স দেখছেন
এখানে রাজার আস্তাবল ছিল। ঘোড়া ছিল। ছিল হ্রেষা ও সহিস।
এখন তো আগরতলা খচ্চরে ভরে গেছে
কী বললেন? হ্রেষা? ওহো, এককথায় প্রকাশ পড়েননি?
সেই যে ব্যাঙের ডাক মকমকি। ময়ূরের ডাক কেকা।
কুকুরের ডাক বুক্কণ। হাতির বৃংহন।
তেমনি ঘোড়ার ডাক হচ্ছে হ্রেষা।
তবে খচ্চরের ডাককে এককথায় কী বলা হয়
তা অবশ্য আমাদের বাংলা ব্যাকরণে নেই।

আত্মশ্লাঘা

যদিও আমার বাবা আস্তাবলের সহিস ছিলেন না
বেতো ঘোড়া হয়েও অবশ্য বেঁচে থাকেননি।
আমারও লেখাপড়া খুব বেশি নয়
আমিও ভেবেছি, সৌন্দর্য ও সত্য একটি মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ
নিসর্গের চেয়ে বড়ো কল্পনাপ্রতিভা।
নিজের লেখায় আমি মিশিয়েছি ইন্দ্রিয়ের তীব্র আত্মবিষ
অসুস্থ কর্নিয়া নিয়ে সম্ভোগ করেছি সমূহ সৌন্দর্য
সংগীতের ঘোরে কেটে গেছে অনিদ্রার রাত
ফুল ও যোনির গন্ধে সনাক্ত করেছি ঋতুবদলের জ্বর
খর জিহ্বায় চেখেছি অমৃত ও অহিফেন।
আমার সামান্য লেখালেখি একদিন বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাবে
এই বলে, কখনোই বিলাপ করিনি বন্ধুদের কাছে।
রন্ধ্রপথে আমারও শরীরে প্রবেশ করেছে ক্ষয়রোগ
আমার মৃত্যুশিয়রে কোনোদিনই এসে বসবে না ফ্যানি ব্রাউনের প্রেম
তবু তার চিঠির অপেক্ষা করে বেঁচে থাকি এক একটি রাত।
মৃত্যুর কয়েকদিন আগে যদি তার শেষ চিঠি আসে
অভিমানে সেই চিঠি না পড়েই বন্ধুদের বলে যাব
অপঠিত এই চিঠি যেন অন্ত্যেষ্টি মুহূর্তে আমার কবরে রেখে দেওয়া হয়।
এরও আগে লিখে রেখে যাব এপিটাফ
—এইখানে শুয়ে আছে এক আত্মশ্লাঘা, যে নিজেকে জন কীটস ভাবত’
মনোবিদ্যার ভাষায় একেই কি ডিলিউশনাল ডিসঅর্ডার বলা হয়ে থাকে?

সংকর

বাবা, বেগবান অশ্ব
মা ছিলেন এলোমেলো সংসারের ভারবাহী গাধা
আমি খচ্চর, বাংলাকবিতা লিখি।

প্রজাতি

পৃথিবীর সব প্রণয়িনী জানে, বোকাচোদা এক
প্রজাতির বৈজ্ঞানিক নাম প্রেমিক। ক্ষতবিক্ষত
আত্মা, গন্ধক, ছত্রাক, রজন দিয়েই তৈরি হয়
তাদের শরীর। ভিখিরির মতো শুশ্রূষা চাইতে
এলে তাদের জিহ্বায় প্রণয়িনীরা সযত্নে তুলে দেয়
সেঁকোবিষ।এইসব প্রেমিকেরা যেখানে সেখানে
হাহাকার, দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নিঃস্ব হয়ে ভালোবেসে
উপদংশ উপহার পেয়ে তপ্ত ও অস্থির মাথা
সমর্পণ করতে গিয়ে কোল খুঁজে খুঁজে ফিরে আসে
সেই মায়াবিনী প্রণয়িনীর কাছেই। সেখানেও
তীক্ষ্ণ কাঁটা ও পেরেকভর্তি কোল দেখে ভয়ার্ত সে
পালিয়ে বেড়ায় আলো ও বালির ছলনাসর্বস্ব
মরুপথে। প্রেমিক, পুরুষ; তার তীব্র অহমিকা
কিছুতেই নেবে না সে সিলভিয়া প্লাথের তরিকা।

কু-কবিতা
আজ থেকে হাজার হাজার বছর আগে, আমাদের নীতিশিক্ষা প্রণেতারা মাধ্যম হিসেবে, তিনটি পুতুলকে বেছে নিয়েছিলেন। আজও, আমাদের ড্রয়িংরুমের দেওয়ালে, এই তিনটি পুতুলের মূর্তি সাজিয়ে রাখা হয়। প্রথম পুতুল, দুহাতে তার মুখ চেপে রাখে; অর্থাৎ কু-কথা বলা উচিৎ নয়। দ্বিতীয় পুতুল, দুহাতে, কান দুটো চেপে রাখে; অর্থাৎ কু-কথা শোনা উচিৎ নয়। তৃতীয় পুতুলটি, দুহাতে তার চোখ দুটি বন্ধ রাখে অর্থাৎ কু-দৃশ্য দেখা অনুচিত। যে পুতুলটি মুখ চেপে রাখে, তার চোখ ও কান খোলা থাকার কারণে সে, সব সময় কু-দৃশ্য দেখে এবং কু-কথা শোনে। যে পুতুল কান চেপে রাখে, সেও, একই কারণে, ইচ্ছে করলেই কু-কথা বলতে পারে এবং কু-দৃশ্য দেখতে পারে। তৃতীয় যে পুতুলটি চোখ বন্ধ করে রাখে, তারও, একইভাবে কু-কথা বলার এবং কু-কথা শোনার সম্ভাবনা রয়ে যায়। কু-কথা না বলার জন্য, কু-কথা না শোনার জন্য এবং কু-দৃশ্য না দেখার জন্যে, একটি পুতুলের যে অন্তত ছয়টি হাতের প্রয়োজন হয়, তা আমাদের নীতিশিক্ষা প্রণেতারা, কখনোই ভাবেননি বলে, আজ, দুহাত খোয়ানো তরুণ কবিরা, কু-কথা বলতে বলতে, কু-কথা শুনতে শুনতে এবং কু-দৃশ্য দেখতে দেখতে, পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মরুভূমির বালিতে, নীতিপ্রণেতাদের বিরুদ্ধে অজস্র কু-কবিতা লিখে রাখে।

অস্ত্র

কখনোই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জল খাবেন না
কিডনিতে সরাসরি চাপ পড়ে।

জল যখনই খাবেন, বসে
দিনে জল বেশি খান, রাতে কম।

পুনর্নবা শাক খাওয়া ভালো
আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য্য আরও অনেক নিদান দিয়েছেন।

বৃক্ক হচ্ছে ছাঁকনি, শরীরের পক্ষে উপকারী ভালোটুকু নিয়ে
বর্জ্য বের করে দেয়।

আমাদের কোন অস্ত্র নেই, সংগঠন নেই, ম্যানিফেস্টো নেই, কর্মসূচি নেই
বৃক্ক, আমাদের একমাত্র অস্ত্র

বৃক্ক সচল রাখুন
ভুলে যাবেন না, অনেক কিছুর উপরই আমাদের পেচ্ছাপ করে যেতে হবে।

সাপ লুডো

রহস্যময় এক সাপলুডোর গুটি হয়ে ছেলেদের আয়ুষ্কাল কেটে যায়। একটি মুখখোলা, ছোটো কৌটোর ভিতর, একটি ছোট্ট সাদা ঘনকই তাদের প্রাণভ্রমর। ঘনকটির ছয়টি পৃষ্ঠতলে কোথাও একটি, কোথাও দুটি, কোথাও তিনটি, কোথাও চারটি, কোথাও পাঁচটি, কোথাও বা ছয়টি ফুটকি আকাঁ থাকে। কখনো ছক্কা অর্থাৎ ছয়, কখনো পাঞ্জা অর্থাৎ পাঁচ, কখনো কানা অর্থাৎ এক ইত্যাদি শব্দ আউড়ে মেয়েরা, অজস্র সাপ, মই, আর ১ থেকে ১০০ পর্যন্ত সংখ্যাঙ্কিত এই লুডোর ছকের উপর দান ছুঁড়ে মারে। যেহেতু ছেলেরা জন্মসূত্রেই লোভী, তাই তারা সাপ লুডোর ১০০ সংখ্যাটির অবৈধ ও তীব্র হাতছানি এড়াতে না পেরে, মেয়েদের হাতে ঘুঁটি হয়ে থেকে যায়। সাপ লুডোর এই ১০০ সংখ্যাটি, দার্শনিকদের কাছে নির্বাণ বা জন্মান্তর বা নাস্তি, আধ্যাত্মবাদীদের ব্রহ্ম, উচ্চাকাঙ্খীদের আমলাতন্ত্র, রাজনীতিবিদদের ক্ষমতা এবং কবি সাহিত্যিকদের প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্ণীত হয়ে এসেছে। এভাবে, উত্থান, পতন, আর সর্পদংশনের ভেতর দিয়ে যেসব হতভাগ্য ছেলেরা, শেষ পর্যন্ত ওই ১০০ সংখ্যাটিকে আজও ছুঁতে পারেনি, আমি তাদেরই একজন। তাদের মিলিত কান্নাকাটি আর নেশাভাঙের কমিউন থেকে সামান্য সরে গিয়ে, এটুকু আঁচ করতে পেরেছি– লুডোর ছকে যে সব সাপ ও মই আকাঁ থাকে, সেসব মই ও সাপ আসলে, মেয়েদেরই তুখোড় ছায়াবাজি মাত্র। সাপ লুডোর এই রহস্য ফাঁকা করে দেওয়ার দায়ে, মেয়েদের হাতে ঘুঁটি হয়ে থাকা ছেলেদের এই গ্রহদোষ, আরও কয়েকজন্ম বয়ে যেতে হবে।

Facebook Comments

পছন্দের বই