লেখক নয় , লেখাই মূলধন

বিক্রম ঘোষের কবিতা

ঠাকুমা ও মা


মা বলতো শেষের কয়েকটা দিন ঠাকুমা নাকি শৈশবে ফিরে যেতে চেয়েছিল,
বিকেল হলেই আয়নার সামনে বসে লাল ফিতে দিয়ে সাদা একমুঠো পটের চুলে বিনুনি বাঁধত,
মাঝে মাঝে খোঁপা বাঁধতে না পারায় কমবয়সি লজ্জা পেত
কুচকানো গাল দুটো রাঙা হয়ে উঠত, মনে হত যেন বিকেলের সমস্ত আলো এক দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
তারপর অসম্ভব ছুটে যেত ছাদে, আকাশের দিকে বিস্ময়ের চোখে দেখত, চরুইদের সাথে ঝগড়া করত, হিংসে করে বলত ‘আর আসবি না আমার বাড়ি’।
কৃষ্ণচূড়ার ডালগুলো তাকে ছায়া দিয়ে তার পাশে বসে থাকত, তার ছায়াকে আদর করত, গল্প শুনত।
শীতের মাঝামাঝি সন্ধে নেমে আসত তাড়াতাড়ি
অথচ তার খেয়াল নেই এতটুকু, কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই
কী নিয়ে একটা ব্যস্ত
পাখিদের আড্ডা ঘরে ফিরে যেত একে একে
ঠাকুমার একটা দীর্ঘ ছায়া খেলে বেড়াত গোটা ছাদময়।

তবে মা’ও!
বার্ধক্যের সময় যেতে চাইবে তার শৈশবে, ছেলেখেলা আর খোলাচুলে ফ্রক পরা হাওয়ার অন্ধকারে
তখন আমি পাশে বসে প্রেমিকার মতো কাজল পরিয়ে দেব মায়ের চোখে।
নাকি মাকে কোনদিন বার্ধক্য ছুঁতেও পারবে না
মাকে নিয়ে যাবে না খাদের ধারে, অন্ধকারে দেখাবে না কোনো মৃত্যু ভয়।

অথচ মার দুঃখ ঠাকুমার অধিক,
কাকিমার হঠাৎ মৃত্যুর পর মা কেমন গুমরে গেছে
কতকিছু বলতে চেয়েও বলতে পারে না
সারাদিন বোন আর আমার দিকে অদ্ভুত ভাবে চেয়ে থাকে, আড়াল হলেই চোখে হারায়, ডাকে।

এই চোখ দুটো কি কোনদিন আমাকে দূরে যেতে দেবে!


দুপুরের নির্জনতায় পৃথিবীটা একলা হয়ে যায়
সমস্ত জনমানবের বিস্ময় নেমে আসে ওই পুকুর ঘাটে
বিস্মরণ মূর্তিমান বড়ো বড়ো গাছের ছায়া বিছিয়ে থাকে,
এবং বারবার বয়ে যেতে যেতে উঠে আসে কোনো যুবতীর আঁচলে
দুটো রাজহাঁস আল বেয়ে সরে দাঁড়ায় কিছুটা দূরে
জানলার বিপন্ন দুটো চোখের নিঃসঙ্গতা থেকে…

চোখ ঘুরিয়ে দেখি আমার অস্থির বিছানায় এক অপরিচিত বালিকা
গ্রামের নকশিকাঁথার মতো চাউনি, অসম্ভব মায়া
দুপুর গড়িয়ে আর আসবে না বিকেলের চেনা সম্পর্কদের কোলাহল,
যতই বেড়ে যাক বিষাদের বয়স, গভীরতম হোক ভিতরের দুর্গম পথ
নিবিড়ভাবে শুয়ে আছে, পা দু-খানি দোলাতে দোলাতে সুকুমার পড়ছে
যে সুকুমার ঠাকুমার কাছে আমিও পড়েছি
সে ভীষণই চঞ্চল, মনে হয় সারাঘর ঘুরে আমাকে ছুঁয়ে চলে গেল ছাদের দিকে
তার সামনে যে উন্মুক্ত হলুদ খাতা, আমার থেকে লুকিয়ে নিল
কত কত গোপনীয়তা, একটা বিমূঢ় লজ্জা
দুরন্ত কৌতূহলে তার না বোধক ছেলেমানুষি আমি পেরিয়ে গেলাম
যুক্তাক্ষর ছাড়া ভাঙা ভাঙা অক্ষরে গোটা পাতা জুড়ে লেখা, চিঠির মতো
‘আজ বিকেলে আম চুরি করতে যাব’
—অপু
আমার দিকে তাকিয়ে প্রাণোচ্ছল সেই হাসিটা কী শৌখিন
অষ্টাদশ শতাব্দীর কিংবা তার থেকেও পুরোনো
কত কিছু সেখানে অবিরাম খেলা করে, অথচ এতটুকু শূন্যতা নেই
আর ঠিক তারই ছায়া পড়ে আছে হাসিতে
ওই বালিকা আমার মেয়ে
যাকে মাঝে মাঝেই বড়ো অপরিচিত মনে হয়।

ঘুম দাও নির্বাসন নয়

দীর্ঘ পথ হাঁটতে হাঁটতে পৌচ্ছেছি,
দিগন্তে উদ্ধত কোন নিঃসঙ্গ অরণ্যে
অলৌকিক হাত-পা ছড়িয়ে গাছগুলো আমায় ডাকে,
আমার দিকে ধনুকের ছিলার মতো
ছুঁড়ে দেয় ধূর্ত নেকড়ের হাসি
শুক্লপক্ষের নতুন চাঁদ থেকে
সরু পাতার ফাঁকে ফাঁকে ছিটকে আসে জোৎস্না
কাঁচের গুঁড়োর মতো
ভাঙাচোরা
ছেঁড়াছেঁড়া
হেঁটে যাই আরও কিছুটা,
করতলে মুষ্টিবদ্ধ ইশকুল বয়সের প্রথম ভালোলাগা বালিকার নম্র মুখশ্রী
নিষ্পলক চেয়ে দেখি, বাঘের ডোরাকাটা চামড়ার মতো অন্ধকার
নদীর ওপারে ক্রমশ জন্ম নেয় এক বিহ্বলতা
এই নিঃশব্দ কোলাহলে
তার শরীর থেকে খুলে পড়ে
রুপোলি আঁশ
অহংকার
সেই কি তবে বালিকা, আজ তবে নারী
সে জলে আলতো অধর স্পর্শ করে, উড়ুর কাছে নীচু করে আনে তার আভাদীপ্ত নীল মুখ
সে আমাকে দেখায়, আমি দেখি,
তার বুকে শুয়ে আছি আমি
কোনো বোধ নেই
অসাড় একটা দেহ
মৌমাছিদের মতো মগ্ন
বিষণ্ণ ধূসর মেঘের ছায়া
ঝিঁঝি ডাকে, হয়তো মা সেলাই মেশিন চালাচ্ছে অনবরত
আর জুড়ে দিচ্ছে খেলামাটির স্মৃতি
একটা
দুটো
অসংখ্য
আড়ালে হিজল গাছের নীচে বাবা, সুপুরুষ লম্বা ছায়া।

মাঝে মাঝে মনে হয়,
আমার মধ্যেই কি ভীষণ ত্রাহিরব
ঠিক ঈশ্বরের দরজায় সারি সারি ঘণ্টার উল্লঙ্খিত নিনাদ
এমন নিস্তব্ধতার খেলা ভেঙে দেয়
আমাকে নির্বাসন দেয়
আমি মুষ্টি খুলে আকাশকে নেমে আসতে বলি
অজস্র নক্ষত্রের ঢেউ
সাঁতরে যাই
জলকষ্ট হয়
আর কতগুলি রাতের পরে একা ধ্রুবতারা
আমার গলা শুকিয়ে আসে এবং
ঘুম পায়
আমাকে ঘুম দাও, নির্বাসন নয়।

গোধূলিতে মা

স্মান অন্ধকারে সেখানেই প্রথম আলো জ্বলে ওঠে
সলাজ কুমারীর মতো মায়ের সেই মুখ,
দরজায় দাঁড়িয়ে আছে দীর্ঘ দিন
দীর্ঘ সময়
তার মাঝে আঠারোটা বছর, হাজারবার সূর্যের আসা-যাওয়া মায়ের চিবুকে রেখে গেছে বড়ো বড়ো শক্ত পাথর
এখন মাকে সেই পথের কথা জিজ্ঞেস করলে সে কাঁদে না
নির্বাক চোখে আমাকে দেখে
সেই প্রথম বুঝতে পারি চোখের নীচে কালো দাগটা কীভাবে কেড়ে নিয়েছে সমস্ত সৌন্দর্য
মা জানে ফিরে আসবে, দিনান্তে কাঁধে করে নিয়ে আসবে ক্লান্তি আর
ভেজা পোশাকে শিশু সবুজের সুবিস্তৃত ঘ্রাণ

মায়ের এক শরীরে মৃত নদী,
যেখানে দিগন্ত জুড়ে ধূ ধূ নিঃসঙ্গ চোরাবালি
এক ঝাঁক স্তব্ধতা
গলা-মোচড়ানো মরা পাখি
বাতাসে হিংস্রতার দুর্গন্ধ
সেখানে দু-একটা ব্যথার মতো কাঁটাগাছ, ছায়া ফেলে রেখেছে অনেক দূর পর্যন্ত
মায়ের শরীরে অন্য গোলার্ধে কি উদগ্রীব জলোচ্ছ্বাস
ফেনিল স্বপ্নের ইন্দ্রজাল ভোররাতে মাকে কাছে টানে
দু-হাত বাড়িয়ে
এই উচ্ছ্বসিত জলপ্রপাতের ধারে
মা সেখানে চিৎকার করে ডাকে
একবার এবং শতবার
তার প্রতিধ্বনি ফিরে আসে, ফিরে আসে অসংখ্য নিস্ফলতা নিয়ে
অপেক্ষা দাঁড়িয়ে থাকে একটা বৃহৎ মহীরুহের মতো

অথচ মায়ের মধ্যেই এতকাল এতকিছুর ওঠা নামা আমি কিছু টের পাই না কিংবা
যতটুকু পাই তার বর্ণনার জন্য এ সামান্য কবিতা যথেষ্ট নয়
আমার কাছে পৃথিবী অনেকখানি বড়ো
ঠিক যেমন মায়ের কাছে এই আধপোড়া টিমটিমে সংসার
যাকে স্তব্ধতার ভিতরে বহুদূর পরিচিত পাথেয় মনে হয়।

অন্ধ মানুষ কীভাবে ঘুমায়

মা পুড়ছে, একা
সাজানো চন্দন কাঠের ওপর মা শুয়ে আছে
যেভাবে অহংকারী রুপোলি জোৎস্না শুয়ে আছে শান্ত হয়ে
খোলা নদীর বুকে
কান্নার বিষণ্ণ বিস্তৃত চরাচরে…
আমি তাদের থেকে অনেকটা দূরে
একটা গাছের নীচে, শিকরের নিবিড় আলিঙ্গনে বসে আছি
বসে আছি আমিও একা

তোমাকে ওই উল্লসিত আগুন এত সহজে পোড়াতে পারবে না
তাই আমি মনে করে নিয়ে এসেছি একটা কবিতার খাতা
আমাকে যে এবার লিখতেই হবে,
কলমটা ধরতেই হাতটা থরথর করে কেঁপে ওঠে
অথচ শরীরে এতটুকু শিহরণ নেই, বাতাসের খোলকে হিম চঞ্চলতা নেই
আশঙ্কা মাত্র কলম নয় খসে পড়ে আমার দু-চোখ
গড়ানো পথে তারা নেমে যায় কোন অদৃশ্য ঈশ্বরের পায়ে
তৎক্ষণাৎ গলে যায় পৃথিবীর ক্লান্তির মোম, আর কানে কানে ফিসফিসিয়ে শুরু হয় খোশগল্প

মা গো তুমি শিগগির উঠে এসো ওই আগুন থেকে
তোমার চোখ দুটো আমাকে দাও
আমি এইসব কবিতা আর কারুর জন্যই রেখে যেতে চাই না
তার আগে অনন্ত একবার তোমাকে পড়ানো দরকার
তুমি না হয় তারপর দূরে চলে যেয়ো
তারপর চলে যেও
বাবার বুকের ব্যথা কি এখনও কমেনি?
শুধু বলে যেও, যাওয়ার আগে
যাদের চোখ নেই তারা কীভাবে ঘুমায়
স্বপ্নে কিংবা দুঃস্বপ্নে,
সমস্ত পিপাসা কি শুয়ে থাকে ফুলের বাগানে!
আর অশ্রুধারা?

Facebook Comments

পছন্দের বই