লেখক নয় , লেখাই মূলধন

বিপ্লব চৌধুরীর কবিতা

শকুন্তলা

একটা কৃষ্ণসার হরিণের দিকে যখন তাক করেছি আমার জার্মান মাউজার, ঠিক তখনই একটা গাছের আড়াল থেকে আমি দেখতে পাই তোমাকে। প্রথমে আমার নয়নে আসে তোমার বক্ষসৌন্দর্য, এবং অতঃপর মুখচন্দ্রিমায় মুগ্ধ হয়ে যাই। তখন অবাক হয়ে দেখি, যে হরিণটিকে হত্যা করব বলে আমি ভাবছিলাম, তুমি তাকে ধরে আদর করছো। সে তোমার সঙ্গে যেন কথা বলছে কোনো এক বনজ ভাষায়। আমি কিছু বুঝতে পারি না। তুমি সেই ভাষা বোঝো, ভালোবাসা দিয়ে।

বন্দুক মাটিতে ফেলে, তীর ও ধনুক পরিত্যাগ করে, আমি গিয়ে দাঁড়াই তোমার মুখোমুখি। দেহ থেকে চন্দনের, চুলের খোঁপা থেকে ফুলের সুবাস সুবাতাসে ভাসে। তোমার আশ্চর্য চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, আজ থেকে আর শিকার আমার কাজ নয়। শুধু চাই, তোমার নরম বুকে আমার কঠিন হাড় ক্রমে মিশে যাক। আমাদের ঘিরে ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামে। তুমি আমার, আমি তোমার হাত ছুঁয়ে থাকি।

রাত ভোর হয়ে যায়। প্রেমের প্রেরণায়।

সেই আমি

গাছের ভিতরে গাছ হয়ে যাই যদি! তুমি কি তখনও চিনতে পারবে? মাছের ভিতরে যদি মাছ হয়ে যাই, কাঁটা বেছে বেছে খেয়ে ফেলবে নাতো! নদীর ঢেউ অথবা ভূপৃষ্ঠের মাটি, কোথায় আশ্রয় নেব ভাবছি এখন। আর তাই সমগ্র সত্তা-জুড়ে বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছে সাড়া-জাগানো সব সংশয়। মনে হয়, একটা রূপান্তরের পথ বেয়ে হেঁটে চলেছি কোনো তেপান্তরের দিকে। সেখানে গিয়ে আমি পাব একটা সবুজ ফুসফুস। ডানা পাব দুটো। পাখি হব গভীর বনের। উড়ে এসে যখন বসব বাগানের গাছে, তুমি কি তখন চিনতে পারবে! শুনতে চাইবে বহুবার চেনা-শোনা কোনো প্রিয়তম গান?

নির্বিষ

তুমি বাজাবে বীণ। আমি সেই তালে তালে নাচাব আমার ফণা। গোবর-লেপা বাঁশের ঝাঁপিতে চেপে, তোমার কাঁধে কাঁধে ঘুরে বেড়াব মেলার পর মেলা— হাটের পরে হাট— কত কত শহর আর শত শত গ্রাম। আমার দৈনিক খেলা তোমার মুখে তুলে দেবে প্রতিদিনের ভাত-রুটি-মদ। বউয়ের জন্য শাড়ি, ছোটো ছেলেটির জন্য পিতলের ঘুনসি কিনে আনবে তুমি। আমৃত্যু আমি থেকে যাব তোমার সহায়।
সেই কবে বটের কোটর থেকে তুমি বন্দি করেছো আমাকে। এতদিন পরে তোমার সংশয়ী মন বলছে আমাকে, সেই প্রতিশোধ-স্পৃহা থেকে যদি কখনো তোমাকে ছোঁবল মারি আমি! ও জীবন-সাপুড়ে, কেন এসব অর্থহীন কথা আজ উঠছে বলো তো? প্রথম দিনেই তো তুমি ভেঙে দিয়েছো আমার বিষ-দাঁত।

চোখ

আছে, তাই দেখি। ওই তো শিমুলগাছ রঙে রঙে লাল। মাটিতে ফুল-সহ পড়ে আছে পলাশের ডাল। তোমার সুন্দর বিরাট দিঘি। ফুটে উঠলো গোলাপি শালুক। বিকশিত হতে দেখি ভোর থেকে রাত। ছেলেরা ক্রিকেট খেলছে। বড়ন্তীর ড্যামে বাবার সঙ্গে ঘুরতে আসা সেই ছোট্ট মেয়েটির ফুটফুটে মুখ। জঙ্গলের অন্দরমহলে জীর্ণ এক টেরাকোটার মন্দির। মাটি ফুঁড়ে, সরলবর্গীয় গতি নিয়ে জেগেছে পর্বত। তার শৃঙ্গের ওপর নীল নীল নীলাকাশ। নাম-না-জানা পাখিরা সব উড়ে যায় অজানার দিকে।

Facebook Comments

পছন্দের বই