লেখক নয় , লেখাই মূলধন

মানিক সাহার গুচ্ছকবিতা

হাত সরাও

হাত সরাও। গা পুড়ে যাচ্ছে ওর তাপে। এই ন্যাকাপনা হাসি আর চাউনির পেছনে যে সাপ বাস করে, তাকে আমি চিনি। তার দ্বিখন্ডিত জিভে হিংসা ও লোভ লেগে আছে। লোভের বাইপাস কিছু নেই। সে কেবল ধ্বংস করতে জানে৷ চামড়া গুটিয়ে নিয়ে সাদা মাংস রোদে শুকোতে দেয়। মন্ত্র পড়া শুরু করলেই বলে ওঠে, এটা ম্লেচ্ছদের পাড়া। এখানে প্রেম নেই। যৌনতা আছে।
প্রেমের পেছনে ছুটে যে ক্যাবলা ছেলেরা গঞ্জিকা সেবন ছাড়া গত্যান্তর পায় না, তাদের বিনম্র মনে থুথু দাও। গালি দাও। বোঝাও এত তুলতলে মন নিয়ে এখন আর প্রেম করা যায় না।
প্রেম এখন কাঠফাটা রোদ। সবার সহ্য হয় না। যে কৃষক চাষ করে, যে শ্রমিক আগুনের কাছে গিয়ে হাত নেড়ে আসে, পাথর ভাঙতে গিয়ে যার আঙুন ফেটে গিয়ে দর দর রক্ত বেরিয়ে আসে— তাদের পিঠের ও বুকের চামড়া থেকে ওম নাও। ফুল দাও দেবতার পা’য়। ফুলের গর্ভে বসা পাখিটিকে জল দাও। দানা দাও। স্নানের আয়োজন করো।
প্রেম অত সোজা বস্তু নয়। খুব যদি ইচ্ছে করে প্রেমের আছিলা করে পাহাড়ী স্টেশনে ঘুরে এসো।

বশীকরণের মন্ত্র

‘সুবৃহৎ তন্ত্রসার ও ডাকিনীবিদ্যা’ খুলে দেখা বারণ ছিল। ফলে সুযোগ পেলেই ঠাকুমার আলমারি খুলে সেই বই দেখতাম। তার ভেতর ছবিগুলি জ্যান্ত হয়ে উঠত। আমার চোখ স্থির হয়ে যেত ডাকিনীদের বুকের উপর। রক্ত মাখা হাত দিয়ে তারা আমাকে আদর করতে চাইত। আমি ভাবতাম ওরা আমার রক্ত খেতে চায়। দ্রুত বই বন্ধ করে পালিয়ে আসতাম।
সংক্রান্তির দিন চরকের মাঠে নীল পূজা। আমি বালা ঠাকুরের কাছে বশীকরণের মন্ত্র শিখতে যেতাম। উনি প্রতিবার কল্কে হাতে দিয়ে বলতেন, যা আগুন নিয়ে আয়।
শিঙা ফুকানো যার তার কাজ না। এর জন্য কৃপা থাকতে হয়। আমি মইশের শিংএর তৈরি শিঙায় ফু দিলে শিঙা কথা কইতো। নিজেকে সবার থেকে আলাদা মনে হতো। এখনও মনে হয়। রাতের বেলা অন্ধকার ঝিমঝিম করতে শুরু করলে এখনো তান্ত্রিক হতে ইচ্ছে করে। যে যে নারীকে আমি কামনা করেছি তাদের বশ করতে ইচ্ছে করে।
অথচ বশীকরণের মন্ত্র উচ্চারণ করলেই দেখি সেগুলি কেমন করে যেন কবিতা হয়ে যাচ্ছে। যে নারীদের কামনা করেছি, তারাই মাথায় হাত বুলিয়ে, আশীর্বাদ করে চলে যাচ্ছে দূরে।

রানী কাহিনি

প্রতি রাতে রানীর আদেশে পুকুরের জল সরে যায়। জেগে ওঠে গুপ্ত দ্বার। অবৈধ ডাক। সেই দ্বার সুরঙ্গের ভেতর দিয়ে রানীর ঘরে চলে গেছে। সেই গুপ্ত ও অবৈধ দরজায়, মাঝে মাঝে, নিজের হাতের ছাপ দেখি।
হাতের ছাপে ঘুম নীল হয়ে ওঠে। রানীর বিছানায় কামিনী ফুলের গাছ। খাটের পায়ার কাছে বসে থাকে যক্ষের দল। তাদের হাতে স্বর্গীয় মদের গেলাস। রাণীর সম্ভোগের দৃশ্য দেখে তারা উৎফুল্ল হয়। শিৎকারে ঘাঁই মারে মহাশোল। আমি ক্লান্ত হলে নগ্ন রাণীর পাশে শুয়ে পড়ি ।
পাকুর গাছের ছায়ায় চুপি চুপি কথা বলে যক্ষ ও যক্ষিণী। তাদের কথা শুনতে শুনতে চাঁদ মুগ্ধ হয়। চাঁদ কিন্তু কিছুই বলে না, কেবল চুপ করে থাকাই তার স্বভাব।
জল বেয়ে বেয়ে উঠি। শরীরে রানীর ঘ্রাণ। পায়ের নিচের মাটি সরে যায়। শরীরে লুকোনো ঘ্রাণ, নারী শরীরের। রাজা আমার ব্যভিচারী ছায়াটিকে অসংখ্য টুকরো করে কাটে। রান্না হয়। আমার খাওয়ার পাতে বেড়ে দেয় গরম গরম। মুখে দিয়ে দেখি তেতো। রাণীর অশ্রু আর কামরস গোলাপ জলের মতো আমার নরম মাংসে লেগে থাকে।

আবহমান

ঝিমধরা জ্যোৎস্নারাতে যাদের পিছুটান নেই, তারা ছায়া হয়ে আসে। খোঁজ নেয় কোন কোন গাছে ফুল এসেছে। কোঠা বাড়ির মনিব গম্ভীর স্বরে ডাক দেয় তার পুরনো ভৃত্যকে।
মিহি ও মধুর পাতা দেখতে ভালো লাগে। অথচ আমাকে দেশান্তরী করার জন্য কত জনের কত ফন্দি। কত জল্পনা। আমি তাদের তুচ্ছ করি। মাঝরাতে জাল ফেলে নাভিগন্ধ তুলে আনি।
ডুব দিই। জলের ভেতর দিয়ে দেখি। বাতাস কেমন মিহি হয়ে ঢুকে যাচ্ছে শরীরের ভেতর। দেখি বাতাসের আবডালে মিশে যাচ্ছে শাড়ি পরা দেহ। তার পিঠ বেয়ে জল নেমে আসে। জলে কত মোহ গন্ধ কুর্চি ফুলের মতো অনাদরে পুড়ে যায়।।
ভাবি, হাঁসের মাংস দিয়ে পিকনিক হবে৷ ভাংপাতার বড়া। আর ঢেঁকি ছাটা লাল লাল চাল। কলাপাতা কেটে আনি। স্নান দেখি। পাতার আড়াল দেখি। ঝিমধরা ছায়াগুলি জ্যোৎস্না হয়ে ঝোপের আড়ালে নেমে আসে।

নক্ষত্রপুরুষ

ছাত্র পড়াতে যাই। অথচ একসময় ভেবেছিলাম সন্ধ্যা হলে রঙিন আলো জ্বালিয়ে গল্পের আয়োজন করবো। চা খাবো। তার ধোঁয়ায় নক্ষত্রগুলো ঢেকে যাবে অমায়িকভাবে। কোনো কোনো সন্ধ্যায় বান্ধবীদের বাড়ি যাব। অন্ধকারের আড়চোখ বাঁচিয়ে বাড়ি ফিরব মাঝরাতে। কিংবা কোনো রাত নক্ষত্রের নিচে কাটাব বলে লিখে রাখব ক্যালেন্ডারের নির্দিষ্ট ঘরে। গন্ধরাজ ফুলের গন্ধে চেতনা লুপ্ত হবে। কেউ হয়তো গান গাইবে। কিংবা মাঝরাতে উঠে এক বাউদিয়া পুরুষ বাঁশি বাজাবে আপন মনে। ভেবেছিলাম আমি তার সুর হয়ে, ধ্বনি হয়ে জ্যোৎস্না কাঁপিয়ে দেব।
অথচ সন্ধ্যা হলে প্রতিদিন পড়াতে যেতে হয়। শ্রমিকের মতো দিন কাটে। স্বপ্ন ও ঘুমের সামান্য ব্যবধানে আমি এক নক্ষত্রপুরুষ নিজস্ব তারা বেঁচে সংসার চালাই।

সখ্যতা

দরিদ্র পিতার মতো আমার বাগান। তবু তাতে পাখি আসে, প্রজাপতি আসে। রাতের আলোয় মথ জোনাকির মতো ওড়ে। ডানায় অনন্তকাল দাবি-দাওয়া নিয়ে বসে আছে। যেন তার শোক নেই, তাপ নেই, আক্ষেপও নেই। কেবল আলোর দিকে উড়ে চলে যায়।
অসংখ্য লোক জমে। মৃতদেহের উপর বস্তুতই যাদের কোন মমতা নেই, তারাও দুঃখ করে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বড়ো করে। তারপর ”লেট হয়ে গেল” বলে চলে যায়।
কয়েকটা পোকা, খরিশ সাপ, শেয়াল, অন্ধকার মেখে হামাগুড়ি দেওয়া ভাম, একটা বাঘডাসা আমার মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে থাকে। ওরাই বরং থাক। ওদের সখ্যতা বেশি ভালো, বড়ো করে শ্বাস ফেলা চাটুকার মানুষের চেয়ে।

Facebook Comments

পছন্দের বই