লেখক নয় , লেখাই মূলধন

মাসুদ খানের কবিতা

দুশ্চিকিৎস্য

“বহুবক্র কাষ্ঠখণ্ডে গড়া মানব, মানবতা—
যা থেকে হয় না সরল কোনো কিছু”
—ইমানুয়েল কান্ট

চিত্র: ইভস্ ট্যাঙ্গি

সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে উঠবে মানুষ একদিন—
বিশ্বাসযোগ্যতার সূচকে এই আশাতথ্য যেন
জাতকের সমুদ্রশোষণ…
পঙ্গুর অলঙ্ঘ্য অট্টালিকা-লঙ্ঘন…
সুখী সুদর্শন সংসারিজনের গাভিগমন…
জিরাফের অশ্বারোহণ…।

আজান

আবহাওয়া আজ মেঘলা ও ঘোলাটে।
তাই এদিকে প্রায় বারোটা বাজতে চলেছে, ওদিকে ফজরের আজান হেঁকেই চলেছে ইমামেরা, মুয়াজ্জিনেরা।

যোগসূত্র

এও এক জটিল জালিকাবিন্যাস।

এই যে হারান মণ্ডল মাঝে-মধ্যেই বউ পেটায়
সার্কাসের অতিপ্রশিক্ষিত জোকারও মাঝে-মাঝে ভুল তামাশা দেখায়
এসবের জন্য নাকি কোনো-না-কোনোভাবে দায়ী থেকে যায়
বহু-দূরে-থাকা বিশ্বব্যাংকের চেয়ারম্যানও।

বহুদূরে বাড়ে সুদের হার, এইদিকে বাড়ে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা।

শুভেচ্ছাশক্তি

মহাবিস্ফোরণের পর ব্রহ্মাণ্ড যখন ছড়িয়ে জুড়িয়ে যাচ্ছিল একটু একটু করে, তখন ওই ছোট্ট শিশুবিশ্বজুড়ে কেবলই বিকিরণ আর বিকিরণ। আর সেই বিকিরণ থেকে মুহুর্মুহু তৈরি হচ্ছিল কণিকা ও প্রতিকণিকা। ছুটছিল দিগ্বিদিক। আবার তারা যেই মুখোমুখি, অমনি সংঘর্ষ। অমনি পরস্পরে বিলীন হয়ে গিয়ে ফের ফিরে যাওয়া শক্তিতে, বিকিরণে।
বিশ্ব আরো প্রসারিত হতে থাকল ক্রমে। কমে এল উত্তাপ উষ্ণতা। থেমে গেল শক্তি থেকে কণিকা-প্রতিকণিকা তৈরির যজ্ঞলীলা। তবে কী এক দুর্জ্ঞেয় কারণে, সমান-সমান না হয়ে প্রতিকণিকার চেয়ে কণিকা তৈরি হয়েছিল অনেক বেশি। প্রকৃতি দেখিয়েছিল এক স্পষ্ট প্রগাঢ় পক্ষপাত, কণিকার প্রতি।
ভাগ্যিস দেখিয়েছিল! ভাগ্যিস প্রকৃতি নিজেই ভেঙেছিল তার স্বঘোষিত প্রতিসাম্যের নিয়ম! তা না হলে এ-বিশ্ব এখন ভরা থাকত শুধুই বিকিরণে।
সে-কোন বিধান-ভাঙা বিধি, সে-কোন পক্ষপাতদুষ্ট একরোখা শুভেচ্ছাশক্তি প্রকৃতির, যার আবেশে বিশ্ব আজ এমন বস্তূজ্জ্বল, প্রাণ-থইথই?

অভিব্যক্তি

গাছপালা সব ব্রোঞ্জের, পাখিরা অ্যালুমিনিয়ামের, ঘাসপাতা লতাগুল্ম সব প্লাস্টিকের। আগাগোড়া ধাতু ও কংক্রিটে-মোড়ানো সব নিরেট নির্বিকার উল্লম্বস্তূপরাশি। মানুষেরা সব পণ্যপর্বত আর ভোগপাহাড়ের মধ্যে আটকা-পড়া, অসুস্থ উদ্ভ্রান্ত গিনিপিগের মতো ক্রমাগত ছুটতে-থাকা।
হাঁপিয়ে-ওঠা, হাসফাঁস-করা মানুষেরা কোথায় গেলে পাবে একটু নিরাময়, একটু সবুজ, একটু গা-ছমছমে ভাব, কোথায় গিয়ে উগরে দেবে তাদের দিনগত জহরিলা, ঘোচাবে বিভ্রম বিভ্রাট, লঘু পাপেচ্ছা… তা-ও একটু ভেবে রেখেছিলেন মা প্রকৃতি।
দৃষ্টি-ও-শ্রুতিকঠোর এই ধাতুনগরীর মাঝখান দিয়ে বক্ষসন্ধি বরাবর আগে থেকেই বইয়ে রেখেছেন এক চিলতে ধারালো নদী—জংলি ও খরশান। ছোট্ট নদীর দুই ধারে বিচিত্র-প্রাণীপতঙ্গ-অধ্যুষিত জঙ্গলে-ভরা পাহাড়ি অববাহিকা। ঢালের একবার নিচে ওই কৃশকায়া বন্যতোয়ার পাড়ে এসে দাঁড়ালে ঘন জঙ্গলজালের আড়ালে সম্পূর্ণ ঢাকা পড়ে যায় ওই নিষ্করুণ নগরী। কিছুই আর দেখা যায় না তখন ওই স্তূপ-স্তূপ কংক্রিটরাশির।
কোটি কোটি টন ধাতুকংক্রিটের এই দুর্ধর্ষ নগরত্বের বিপরীতে এই এক টুকরো দুর্দান্ত প্রাকৃতিকতা। এক ভয়াল কালাপাহাড়ি জড়ত্বের বিরুদ্ধে প্রাণপণ লড়াইরত এক ফালি সবুজ সজল জৈবিকতা।

বিশ্বব্যাপার

লোকালয়হীন, জলজঙ্গলভরা বিস্তীর্ণ ভূভাগ। তার ভেতর দিয়ে ভূমিতে সাঁটানো কালো স্কচ টেপের মতো চলে গেছে নির্জন পিচঢালা পথ। আঁকাবাঁকা। যেন এক অতিকায় রিল থেকে হঠাৎ ছাড়া পেয়ে ছড়িয়ে পড়েছে শতশত মাইল ফিল্ম-ফুটেজ, রাশপ্রিন্ট।
সড়ক ধরে ছুটে চলেছে এক নিঃসঙ্গ যন্ত্রযান। মাঝে মাঝে তার পথ আগলে দাঁড়াচ্ছে দুর্বিনীত গ্রিজলি ভালুক, বাচ্চাকাচ্চাসহ। কখনও কখনও মাথাভরতি শিঙের জটিল জঙ্গল-অলা মুজ-বাহিনী। মাইল কয়েক পরপর মূল সড়ক থেকে বেরিয়ে কোথায়-না-কোথায় উধাও হয়ে চলে গেছে সরু-সরু সব প্রশাখাসড়ক।
এদিকে পথ হারিয়ে বাহন ছুটছে উন্মাদের মতো এলোমেলো দিশাহারা। জিপিএস-এর ধীরস্থির স্পষ্টবাক মেয়েটিও মাথাখারাপের মতো ক্রমাগত বলেই চলেছে ‘টার্ন রাইট’, ‘টার্ন লেফট’, ‘ক্যালকুলেটিং রাউট’। এই এখনই ‘রাইট’ তো পরক্ষণেই ‘লেফট’, আবার এখনই ‘ক্যালকুলেটিং…’। অনেকক্ষণ এরকম করতে করতে একসময় হাল ছেড়ে দিয়ে নিশ্চুপ হয়ে গেছে সে… সেও বেশ আগে। ক্রমেই ফুরিয়ে আসছে জ্বালানি, ফুরিয়ে আসছে আশা ও আলোক। আশপাশ, পরিবেশ সব ভয়াবহরকম নির্জন। জনমানুষের চিহ্নমাত্র নাই। হঠাৎ স্পষ্ট শোনা গেল এক ঢেউ-খেলানো লোকগানের কলি “বহুদিনের পিরিত গো বন্ধু, একই দিনে ভেঙো না”, পরিষ্কার বাংলাভাষায়। আলাস্কায় বাংলা গানের কলি! তা-ও এই হিম-হিম নিঝুম জলাজংলা পথে!
ঝোপের ভেতর থেকে ভেসে আসছে খালি গলার ওই গান। ইতস্তত ফুটে উঠছে আরও অনেক গানের কলি। পাপড়ি-ব্যাদান-করে-থাকা, পতঙ্গ-ধরে-ধরে-খাওয়া ভেনাস ফ্লাই ট্র্যাপ, দুধশাদা-আলোবিচ্ছুরণী ড্যানডেলায়ন, আর্কটিক স্প্রুসের মঞ্জরি, আলাস্কান ব্লুবেরি আর ফরগেট-মি-নটের ঝোপ… একে-একে সবকিছুতে চটপট ফুটতে থাকল বিচিত্র সব গীতকলি, এলোপাথাড়ি, দৈবচয়নে— “ওলো সই, আমার ইচ্ছা করে তোদের মতো মনের কথা কই”, “আমার কাক্সেখর কলসি, গিয়াছে ভাসি, মাঝি রে তোর নৌকার ঢেউ লাগিয়া”, “যেজন প্রেমের ভাব জানে না, তার সাথে নাই লেনা-দেনা”, “দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা”, “দ্যাখ-না মন ঝাকমারি এই দুনিয়াদারি”, “কান পেতে রই, ও আমার আপন হৃদয়…”, “নদীর নাম সই অঞ্জনা, নাচে তীরে খঞ্জনা সই…”, “গৌর বলে বাহির হবো, গৃহেতে আর রবো না গো” “শাওনও রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে”, “আমি বাংলায় গান গাই…” “অমরত্বের প্রত্যাশা নেই, নেই কোনো দাবিদাওয়া/এই নশ্বর জীবনের মানে শুধু তোমাকেই চাওয়া।”…
দুর্জ্ঞেয়, দুর্বোধ্য সব বিশ্বব্যাপার।
এক প্রহেলিকাপূর্ণ পটভূমি-সংগীতে বেজে চলল গোলার্ধপ্রতিম দূরের নির্জন নিঝুম আর্কটিক বনপথ— বাংলা ভাষায়, বাংলা সুরে।

Facebook Comments

পছন্দের বই