লেখক নয় , লেখাই মূলধন

মিগুয়েল হারনানদেজের কবিতা।। অনুসৃজন: মৃন্ময় চক্রবর্তী

(স্পেনের ফ্যাসিবিরোধী কবি মিগুয়েল হারনানদেজ (১৯১০-১৯৪২)। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় স্পেনের গৃহযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন ও প্রতিক্রিয়াশীল শাসকের হাতে বন্দি হন। নিদারুণ যন্ত্রণাময় জেলজীবন সহ্য করতে না পেরে জেলেই যক্ষায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান কবি। অতি সাধারণ গরিব পরিবারের ছেলে ছিলেন মিগুয়েল। কমিউনিস্ট হয়েছিলেন। প্রাণ দিয়েছিলেন সুন্দর এক ভবিষৎ পৃথিবীর স্বপ্ন বুকে নিয়ে মাত্র ৩২ বছর বয়সে। চিলির খ্যাতনামা কবি পাবলো নেরুদা, লোরকার মতো মিগুয়েলকেও স্পেনের মহত্তম কবি বলে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন।)

মৃত্যুর সামনে বসে

মৃত্যুর সামনে বসে
এই দু’মাস ডুবে আছি নীরবতায়,
ফাঁকা জুতোয় চুমু খেয়েছি আমি
হৃদয়ের হাতে নির্মাণ করেছি একটা ক্রুদ্ধ মুঠি
যা এই আত্মাকে পরিচালনা করবে।

আমার উচ্চকন্ঠের কাছে এসো,
এই একই স্তন থেকে তো পুষ্ট হয়েছে জনতা
গাছের শিকড়
আমায় আটক রেখেছে কারাগারে
কারণ, আমি এখানে এসেছি তোমাদের ভালোবেসে
আমি এখানে এসেছি তোমাদের
আমার রক্ত আর কন্ঠের মতো দুটি
বাধ্য রাইফেলের সাহায্যে রক্ষা করতে গিয়ে।

যদি আমি এ মাটির বুক থেকে বাইরে এসে থাকি
যদি আমি জন্মে থাকি কোনো
দারিদ্র্য আর দরদে ভরা জঠরে,
এটা তো ঠিক যে আমি ফিরে আসতামই
সমব্যথী নাইটিঙ্গেলের মতো,
দুর্ভাগ্যের প্রতিধ্বনি
গাইতে গাইতে আর বারবার উচ্চারণ করতে করতে
তাদের কাছে, যারা আমার কথা শুনবে
যন্ত্রণার সবকিছু, দারিদ্র্যের সবকিছু,
সবকিছু এই পৃথিবীর।

গতকাল লোকেরা ঘুম থেকে উঠেছিল
নগ্ন হয়ে, নিজেকে ঢেকে রাখার মতো কোনো কিছু ছাড়াই
ক্ষুধার্ত হয়ে আর খাবার জন্য কোনো কিছু ব্যতিরেকেই
এবং আজ এখন ভোর হয়েছে
কেবলই ঘৃণায় ভরা
আর কেবলই রক্তাক্ত।
তাদের হাতের রাইফেলগুলো
সিংহ হতে চায়
সহিংসতায় খতম করতে চায় ওদের
যারা দীর্ঘ সময়জুড়ে সহিংস রয়েছে।

যদিও তোমাদের কোনো হাতিয়ার নেই
তবু জনতার আছে শত সহস্র প্রতিরোধশক্তি
তোমার হাড়গুলো দুর্বল রেখো না
শাস্তি দাও যারা তোমাদের আহত করেছে
তোমাদের তো তোমাদের সংখ্যার মতো দীর্ঘ মুঠি রয়েছে
রয়েছে নখ, থুতু, হৃদপিন্ড,পৌষ্টিকনালী, অণ্ডকোষ, দাঁত।
প্রচণ্ড ঝড়ের মতো আদিমতায়,
মৃদু হাওয়ার মতো শান্তভাবে,
যারা হত্যা করে তাদের খতম করো,
যারা ঘৃণা করে, ঘৃণা করো তাদের
এতেই তো তোমাদের হৃদয়ের শান্তি
শান্তি তোমাদের স্ত্রী জঠরেরও।
ওদের তোমাদের পিঠে ছোরা বসানোর সুযোগ দিয়ো না
মুখোমুখি বাঁচো আর বুলেটের সামনে
প্রকাণ্ড ঘরের মতো বুক চিতিয়ে মরো।

আমি গাইছি তীব্র বেদনার্ত কন্ঠে
তোমাদের বীরেদের জন্য, হে আমার জনতা:
তোমাদের আকাঙ্ক্ষাগুলো যেন আমার নিজেরই
তোমাদের দুর্ভাগ্যগুলো তো একইরকম
ধাতুতে গড়া আর চোখের জলে ভেজা,
তোমাদের সহ্য করা কষ্টগুলো একই ফসলের
আর একই অরণ্যের জন্য
তোমাদের ভাবনা আর আমার মন
আমার রক্ত আর তোমাদের হৃদয়
তোমাদের যন্ত্রণা আর আমার জলপাই পাতার মুকুট।
জীবন আমার চোখে
এক তুচ্ছ প্রতিবন্ধকের মতো।

আমি এখানে বাঁচতে এসেছি
যতক্ষণ পর্যন্ত প্রাণের অনুমতি মেলে
আর মরতেও এসেছি
যখন এসে পৌঁছবে সেইক্ষণ
তারপর রয়ে যাব জনতার শিরায় শিরায়
আজ এবং চিরকালের হয়ে।
গলায় ঢালার জন্য অনেক কিছুই তো জীবন,
মৃত্যু কেবলমাত্র প্রকাণ্ড একটি ঢোক
এই যা পার্থক্য।

যখনই আমি যাই

যখনই আমি তোমার জানালার নীচ দিয়ে হেঁটে যাই
আমার পিঠে আছড়ে পড়ে গন্ধের চাবুক
তোমার সারা বাড়িময় সে ঘুরে বেড়ায়
যখনই আমি কবর পেরিয়ে যাই
কে যেন আঁকড়ে ধরে আমায়
তোমার হাড়ের ভিতর দিয়ে তার শ্বাসের শব্দ শোনা যায় !
(একমাত্র সন্তানের মৃত্যুতে লেখা কবিতা। স্পেনের জেলখানা থেকে প্রেরিত।)

কাছেই কবরখানা

কবরখানাটি কাছেই
যেখানে নীল কাঁটাওলা নাশপাতি,
কেয়াগাছ আর নিশুত রাস্তায়
ছেলেমেয়েদের ভীত চিৎকারের ভেতর
তুই আর আমি ঘুমিয়ে রয়েছি।
এখান থেকে কবরখানার ভেতর যা কিছু দৃশ্যমান
সবই নীল, সোনালি আর ঝকঝকে।
মৃত্যুর থেকে চারকদম।
জীবনের থেকে চারকদম।
পরিচ্ছন্ন, নীল আর সোনারং
মাঝখানে এই ব্যবধানটুকু বেড়ে উঠেছে শুধু খোকন আমার।

যেন তরুণ ডুমুরগাছটি

তরুণ ডুমুরগাছটির মতো
গিরিখাদের ধারে দাঁড়িয়ে রয়েছ তুমি।
আমি যখনই পাশ দিয়ে হেঁটে যাই
তুমি বেজে ওঠো পাহাড়ে পাহাড়ে।
তরুণ ডুমুরগাছটির মতো
হে প্রাজ্ঞ দৃষ্টিহীন।
তুমি যেন একটি ডুমুরগাছ
একটি প্রাচীন ডুমুরগাছ।
আমি পাশ দিয়ে হেঁটে যাই আর তুমি
শুকনো পাতা আর নীরবতা দিয়ে
শুভেচ্ছা জানাও।
একটি ডুমরগাছ যেন তুমি
বাজে পোড়া, প্রাচীন।

Facebook Comments

পছন্দের বই