লেখক নয় , লেখাই মূলধন

মেঘ অদিতির গদ্য

টুকরো কথার দর্পণ

কত কথাই তো বলতে পারতাম। এঁকে দিতে পারতাম ছবির মতো ঠাস বুনোটের শব্দ শামিয়ানা। কিন্তু এ-সব এখন কেবল কুয়াশা বিভ্রম তৈরি করবে। সিগন্যালগুলোও বহুদিন স্থবির। সভ্যতার আগাপাশতলা দুমড়ে গ্যাছে। ঢুকে পড়েছি প্রাচীন এক নগরে। সেখানে তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও কি ফিরিয়ে আনতে পারব যৌথতার স্মৃতি!

সখ্যতার জল সরে গেছে। উজানের ঢেউয়ের ভেতর বিস্মরণের অতলে কি তলিয়ে যাব একাই…

কুমারী আলোর কথা ভাবা যাক। চোখ মেললে কী দেখব? ভেতরে হা-ক্লান্ত বাতাস শুধু ঘুরে ঘুরে মরছে। একটা নীল ডুমো মাছি তার চারপাশ দিয়ে ঘুরছে। লেবুপাতার গন্ধ কচলে ফিরিয়ে আনতে চাইছি স্মৃতি। ইন সার্চ অফ লস্ট টাইম। কিন্তু কান পাতলে শুনতে পাই কেউ বলছে, বিনিদ্র এইসব রাতে ভেতরবাড়ির বিপন্নতার স্বরটি যে চেনে সে কেন পথে পথে খুঁজে বেড়ায় প্রেম! ঐশী সত্তাটির কথা সে ভোলে না অথচ অন্তর্ব্যাপ্তির চৌকাঠ ছুঁয়ে আবার ইল্যুশনের মাঝেই সে উন্মুক্ত করে তার অস্তিত্ব।

নিজেকে স্বতন্ত্র করার প্রয়াসে নিজেকে কেন ক্লান্তিকর করে তোলে বারবার…

কেন?

জানি না। সত্যিই জানি না। হাইডেগার যেমন বলেছিলেন, বিপন্নতার, উদ্বেগের সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ হয় না। বিপন্ন কাউকে এ প্রশ্ন করা হলে সে কেবল ফিলিং অফ নাথিংনেসটাই বলতে পারে। তার বেশি কিছু নয়। হয়তো তাই। আমাকে শূন্য করে দিচ্ছে অবধারিত মৃত্যুসংকেত। পথে যেতে যেতে ক্রমাগত ফুরিয়ে আসার কথাই ভাবছি।

মানুষের মাঝে আজকাল বৃক্ষধর্ম খুঁজি অথচ জানি ধী সম্পন্ন মানুষেরাও আজ বিপন্ন। শৈশবের এক মাথা চুল, ছোট্ট প্রজাপতি শরীর, ঝিনুকে রাখা মন, সে কি দেখেনি, ওইসব ভারী ভারী পোশাকের অন্তরালেও মানুষ বাঁচে আদতে তার পশু স্বভাবটি নিয়েই? জলপাই সবুজের আড়ালে তখন আলাদা করে কাউকে আর চেনা যায় না। সপ্ত পেরেকের ওপর শৈশবকে দাঁড় করালে আজও তো প্রতিটি বসন্তের ভিড়ে হিংস্রতা খুঁজে পাই। আজ যাদের নিমিষে সরলীকরণ করা যায় তারাও কি একদিন বিভীষিকার মতোই ছিল না?

তবু অনুভূতির ভেতর কান পাতলে সেখানে আজও কেন বেজে ওঠে আখতারি বাই ফৈজাবাদি!

*

প্রতিটি মানুষ প্রকৃতির নিয়ন্ত্রণাধীন।

কী করে ভাবব বিস্মরণ সময়ের খেলা মাত্র? কেবল অনিবার্য মৃত্যুর দিকে ধাবিত হবার অধ্যায় এই বিস্মরণ… অভিসম্পাতগুলো কখনো ভুলে থাকা সম্ভব? নক্ষত্রের প্ররোচনায় প্রতিবার দূর থেকে কাছে আসে যে তার ভয়াল রূপ মনে পড়ে না? ভুলে থাকা যায় সে-সব স্মৃতি?

তবু এইসবের দূরত্ব ঘুচিয়ে আরও ভেতরের দিকে যদি দেখি—

এখন মনে পড়ছে, জোছনার ফুলও সুদীর্ঘকাল প্রতক্ষ্য করিনি। ঝিঁঝি পোকার সবুজ জ্বলে ওঠার গল্পও তেমন করে তুলে আনিনি। দুপুরের হলুদ রোদে ঝাঁঝালো আকাশের দিকে নিষ্পলক চেয়ে থাকার খেলাটা একটা খেলাই ছিল। আর ছিল জিনিয়া, কসমসের স্পাইরাল বাগানের ভেতর ঘুরতে ঘুরতে একবার কেন্দ্রের কাছে পৌঁছে যাওয়া… সেও তো স্মৃতিই। মনে পড়ে না?

তাহলে?

কুন্দেরা বলছেন, ‘ক্ষমতার বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম হচ্ছে বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির সংগ্রাম।’ একে আত্মিক করে তুলি যদি, যদি নিজের মত করেই ভাবি তাহলে বিস্মরণের পথ ধরে হাঁটলেও বিপন্নতা ঠিক স্মৃতির গভীরতম স্থানেই নিয়ে যাবে।

মকাই খেতের স্তিমিত আলোয় যারা ফিরে চলেছেন মহাশূন্যতার কাছে তাদের নেপথ্যেও একই সুর বাজে।

আদতে সবাই এক অথবা একা। সবই স্মৃতি-বিস্মুতির নিগূঢ় গোপন খেলা।

*

অনাস্থায় যা চুরমার হয় তা শরীর নয়, হৃদয় সাম্রাজ্য। দীর্ঘ চুম্বনও আর কোনো সমাধান নয় তখন। শুরুতে যে-পাখিটা প্রবল ডানা ঝাপটায় সময়ে তারও খসে পড়ে পালক। আবরণ খসে যাবার পর কেউ কিছু আর ভাবছি না তখন। কিছু বুঝতে চাইছি না। পুড়ছে রাজ্যপাট। সংকটের ভেতর ঘনিয়ে ওঠে আরও প্রবল সংকট। পুড়ে সব ছাই হয়ে গেলে সত্যের অনাদি অনন্ত নিয়ে ভেবে কী হয়?

সত্য কি স্থির, অনন্ত?

সত্য কি ততটা নিরীহ যা দিয়ে বিভ্রান্তির নিরসন সম্ভব?

একটা পাখি একবার তার পালক ফেলে গেছিল তরুণ চোখের ফ্রেমে। কারো সুঠাম আঙুলের কথা ভেবে পাখিটার কথাও আজ মনে পড়ছে, সে বলেছিল, এ মহাযজ্ঞের অতি সামান্যই তুমি জানো। বলেছিল যে-চোখে তুমি সত্যকে বিচার করো তা একবারেই তোমার দৃষ্টিকোণ। একই ঘটনায় সত্যের নির্মাণ এক-একজনের কাছে আলাদা হয়ে ধরা দেয়। সত্য তাই কখনোই পুরোপুরি সত্য নয়। দৃশ্যতা, স্থান, কাল ভেদে সবটাই কয়েক বছর, মিনিট, সেকেন্ড বা মিলিসেকেন্ডের পুরানো, খণ্ডিত সত্য।

*

‘সর্বদ্বারাণি সংযম্য মনো হৃদি নিরুধ্য চ।

মূর্ধ্ন্যাধায়াত্মনঃ প্রাণমাস্থিতো যোগধারণাম্।।১২।।’

প্রতিটি মুহূর্ত শূন্যতার মুখোমুখি করে বারবার। এত অসম্পূর্ণতা, এত হানাহানির ভেতর কী করে নিজেকে কেন্দ্রের দিকে ফেরাব বুঝতে পারি না। প্রতিটি অণুপলই এখন রক্তক্ষরণের। অশান্ত হাওয়ার। প্রবল আর্তনাদের। জীবনের উৎসবকে ম্লান করে দিয়ে বেজে উঠছে মৃত্যুর খঞ্জনি। সে আজ মুহূর্তের খেলা মাত্র।

হৃদয় অশান্ত খুব। তবু নত হতে চাই। গভীর ক্ষত নিয়েও পুরোনো পথ ধরে আবার ফিরে আসতে চাই। আর একটিবার।

সমস্ত ইন্দ্রিয়কে সংযত করি যদি, যদি মনকে হৃদয়ের মাঝে স্থিত করি তবে কি শান্ত হব… সুন্দরের সন্ধান পাব! যে-অস্তিত্বটিকে ‘আমি’ বলে বয়ে নিয়ে চলেছি মহাপ্রয়াণের পথে সে মোকাম কী ভরে উঠবে কখনো আবার অজস্র গোলাপের ঘ্রাণে!

Facebook Comments

পছন্দের বই