লেখক নয় , লেখাই মূলধন

মোহন রাণার কবিতা

ভাষান্তর: পিয়াল রায়

কবি পরিচিতি:

ব্রিটেন নিবাসী হিন্দি কবি মোহন রাণার জন্ম দিল্লিতে ৯ মার্চ ১৯৬৪-তে। এ পর্যন্ত কাব্যগ্রন্থ আটটি। তাঁর কবিতায় জীবনের সূক্ষ্মতম অনুভূতির উপস্থিতি চমকে দেওয়ার মতো। বাজার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে তাঁর চিন্তাভাবনা কবিতার মধ্য দিয়েই সামনে এসেছে বারবার। কবি নিজে মনে করেন কাব্যরচনা প্রক্রিয়া আসলে নিজের ভিতর এক স্বতন্ত্র বিচার ধারার প্রকাশ। তাঁর কবিতাকে কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্যের ধারানুসারী বলা চলে না বরং কবিতার একটি নিজস্ব ঘরানা তৈরিই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। তিনি জানতেন কবিতার মধ্যে নিজের বিচারধারা প্রবাহিত করা ও কবিতা সম্পর্কে নিজস্ব বিচার পোষণ করা, দু-টি সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। একটার সঙ্গে অন্যটাকে গুলিয়ে দেওয়া চলে না।

এ পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলি হল:

‘জগহ’ (১৯৯৪)
‘য্যায়সে জনম কোই দরওয়াজা’ (১৯৯৭)
‘সুবহ কী ডাক’ (২০০২)
‘ইস ছোর পর’ (২০০৩)
‘পত্থর হো যায়েগী নদী’ (২০০৭)
‘ধুপ কে অন্ধেরে মে’ (২০০৮)
‘রেত কা পুল’ (২০১২)
‘With Eyes Closed’ (দ্বিভাষী সংগ্রহ ২০০৮)
‘Poems’ (দ্বিভাষী সংগ্রহ ২০১১)]

নক্সানবীস

পঙ্‌ক্তির ভিতর নেই তুমি
আসলে তুমি এক নিঃশব্দ পরিচয়
যেমন এলোপাথারি মেঘ বৃষ্টিহীন
তুমি অনুপস্থিত তেমনই জীবনের প্রতিটি রিক্ততায়
সময়ের অন্তরালে
এইসব ভীত গলিগুলোয়।
কোনো জানালার দিকে আমি তাকাই না আর
কোনো দরজায় দাঁড়াই না
ঘড়ির দিকে তাকাই না যেমন
তেমনই শুনি না অন্য কারো ডাক
বদলে যাওয়া এই দুনিয়ার অবয়বে
ভয়ই এখন একমাত্র সঙ্গী আমার

নিজের সেই দেশ

লোকেরা ওখানে মনে রেখেছে ভুলে যাওয়া
অতীতের দেশ আমায় ডাকেনি কখনো
শপথও ছিল না তার অপেক্ষার
বেসামাল বাতাস এলোমেলো
সাই সাই মাথা ঠোকে দরজায় জানালায়
দেরাজে আঁচড় কাটি সবকিছু ওখানে অথচ কিছুই নেই
আসবাবের ভিতর ঠাসা আসবাব এই ঘর
নিরন্তর খুঁজে চলা ছাড়া আমি নিজেই জানি না আমার ইচ্ছেটা কী
নাড়ি চেপে নক্সার ভিতর কেবল খুঁজে চলি দেশ
দিশা খুঁজে নিতে পারতাম রোদের ছায়া থেকে
কিন্তু এখনও পর্যন্ত ভয় ছাড়া আর কিছুই পাইনি খুঁজে

ইশকুল

প্রথমে পেলাম বইয়ের মলাট
তারপর একটা খাতা
বইয়ের ব্যাগে এত বছর পর আর কিছু ছিল না
ঘণ্টি শুনেই জেগে উঠল
মাঠে কেউ ছিল, না দশম শ্রেণিতেও না
তবে কি আজ ইশকুল ছুটি? ভাবলাম আমি

উড়োজাহাজ ছিল মধ্য ইউরোপের কোথাও
আর আমি অনেক বছর আগের আমার স্কুলে

পৃথিবী নিল শ্বাস
হেসে উঠল সাগর
আকাশ ভেসে পড়ল অনন্তের খোঁজে

অনেকদিন আগে টেবিলে ঘষে ঘষে
আমি লিখেছিলাম আমার নাম
সময়ের ত্বকের নীচে অস্পষ্ট
কোনো তারিখ

বাতাসে ভেসে এল সেই প্রাচীন দ্বিপ্রহর
কোন কথার শিকড়
আমিই সেই দেওয়াল
যার ফুটিফাটায় জন্ম নিয়েছে অশ্বত্থবৃক্ষ

পুরোনো জানলা

দূরবীনে নজরবন্দি দুনিয়া
চিলেকোঠায় কোথাও রাখা আছে ফেলা

পুরোনো জানলায় কোথাও কোনো চিহ্ন নেই
বাতাস, রৌদ্ররশ্মি অথবা বৃষ্টির
সময়ে সময়ে করা রঙের পালিশ ঝকঝক করে
তবুও ওকে ডাকা হয় পুরনো জানলার নামেই
বইয়ের ভাঁজে বন্দি অগুন্তি শব্দ
গাঁঠরিতে বন্দী বই
পুরোনো জানলার কাচগুলোই কেবল পুরোনো দেখায়
যেন চলে যাওয়া দিন
পুরোনো জামা
পুরোনো কবিতা
পুরোনো কোনো কথা
ওর জীবনের আশিটা বছর দুটো মাত্র পাতার ভিতর
আর পাতা দুটো জমা হয়ে আছে কম্পিউটারে

দুনিয়াকে স্থির দেখায় না পুরোনো জানলায়
এলোমেলো দুনিয়ায় ধীরে ধীরে কাঁপতে থাকে নাসপাতি গাছের শাখা
নেমে আসে মেঘ পাখিরা উড়ে যায়
ভরা দুপুরের মতো ঢাল বেয়ে নেমে যায় মেষ
পুরোনো জানলায় দুনিয়া এখনও
ভরভরন্ত দেখায় অজ্ঞাত রাস্তার

আজ যা নতুন তা পুরোনো হয়ে যাবে কাল
কিন্তু আজ যা পুরোনো তা কালও পুরোনো

ধোবী

সকালের চনমনে রোদ
ঘন বাদলকে চিরেছে চুপচাপ
আমি আকাশ দেখতে ভুলে গেছি
ব্যথাতুর দুটো হাতকেও
জলের ভিতর ড্যাবডেবে প্রতিবিম্বর আড়মোড়া
ভুলে গেছি দেখতে
আমার বয়সে
নৃত্যরত সবুজের ভিতর রক্তাক্ত ছায়াদের
দেখতে ভুলে গেছি আমি
ভুলে গেছি মৃতদের বর্তমান
যা ভেবেছি করেছি ঠিক তার অন্যরকম
গুলে যাওয়া নীল আকাশে ফ্যাকাসে মেঘেদের মাঝে
আমি কেবলই ধুয়ে চলেছি নিজেকে

তিন মনুষ্য

ওরা খারাপ দেখত না
ওরা খারাপ শুনত না
ওরা খারাপ বলত না
ওরা গান্ধীজীর তিনটি বাঁদর নয়
তিনজন মানুষ

তিনজন মানুষ ভীষণ একা
নিজেদের অবসরে
প্রসারিত বাহু
মধ্য দুপুরে বন্ধ করেছিল চোখ

ওখানে অনেক অন্ধকার
তুমি কোথায়?
কোথায় তুমি?
হাতের চাপ
অন্য হাতে
এখানে অন্ধকার প্রচুর

তলঘরে বসে
ওরা চকচকে রোদকে ডাকত
হারিয়ে যাওয়া হাওয়াকে ডাক দিত
জানতে চাইত প্রেমের সঙ্গে আনন্দের সম্পর্ক
ঘুরে ঘুরে চলা অতীতের সর্বত্র
ধুলোর পরত
ব্যথাও এক ধুলো
এই নাটকের আমি দর্শক বৈ তো নই

তিনজন মানুষ টিউবওয়েল খুঁড়ছে নিজেদের অতীতে
যে-গভীরতায় দূষণ বলতে কিছু নেই
যা জল নয় আদৌ
এবং যা ওদের অমর করে দেবে
কিন্তু শেষ হয়ে গেল নাটক এর ঢের আগেই

তোমার কখনো কোনো নাম ছিল না

ওরা ব্যস্ত
গুরুত্বপূর্ণ কাজে ওরা সদা ব্যস্ত
আমার কোনো নালিশ নেই তাই নিয়ে
আমার প্রতিটি প্রশ্নে ওদের উত্তর
এখন ব্যস্ত
স্থিরভাবে দেখলে আমি ওদের সঙ্গচ্যুত বহুদিন
তবু ওরা মন্ত্রের মতো বিড়বিড় করে
‘আমি ব্যস্ত
আমি ব্যস্ত
সময়ের সঙ্গে
সদা সময়ের সঙ্গে’

কিন্তু আজ বধির শ্রুতি
আর দৃষ্টিহীন দেখা
হাতড়ে হাতড়ে বেড়াচ্ছে দিন

সময় সেই দ্বিপ্রহর
কোথাও ঘনিয়ে এসেছে সন্ধ্যা
কোথাও জেগে উঠছে নতুন সকাল
কোথাও হয়তো নেমে আসছে সেই পুরাতন রাত

তুমি কি কবিতা লেখোনি কখনো? জানতে চাইতাম
যাতে ওর মনে পড়ে যায়
লিখত কখনো কিন্তু এখন নিজের নামও লেখে না আর

ওর স্তব্ধতাকে কী নামে ডাকতাম
এখন আর মনে নেই সেসব
এই ভুলে যাওয়াটা সত্যি কত না কঠিন

আবার এক কবিতা

উলঙ্গ গাছের উপর
ভগ্ন দেওয়ালের গায়ে
ঘরহীন গৃহে
নিখোঁজ রাস্তায়
ক্ষুধাতুর ময়দানে
বিচ্ছেদী স্মৃতির ভিড়ে
অস্থির জানলায়
লুকোনো ছায়ায় কেটে যাওয়া মধ্য দুপুরে
সামান্য স্পর্শে
দু-হাতে গ্রহণ করি ওকে,
উঠে আসে ক্রমশ ফিকে হতে থাকা
বিশ্বভুবনিক স্বর
চোখ খোলার সঙ্গে সঙ্গে

জলের রং

বৃষ্টি হয়েই চলেছে এখানে টানা কয়েক দিন
যেন মরিয়া হয়ে ধুয়ে ফেলতে চাইছে
আমাদের নাছোড় দাগগুলো
কিন্তু জামার উপর জল হয়ে পড়ছে বিবর্ণ
যে-জামা গায়ে দিয়ে চলে গেছে কত না মরসুম
দেওয়াল থেকে সে-স্মৃতিটুকুও গেছে হারিয়ে

না এখন গ্রীষ্ম
না ঝরাপাতার মৌসম এমনকী শীতের কোনোদিনও নয়
কখন যেন আমি চিনতে চিনতে নিজেকে
ভুলে যাই পুরোপুরি

এমন প্রবল ধারাপাতের পর
কালচক্রে হয়তো কোনো রংই বাঁচবে না আর
জলের রংই হয়ে যাবে জামাটার রং

তৃতীয় প্রহর

আমি তারাদের দেখছি বহুদূর
দেখছি
এই মুহূর্তে ওরা
অতীতের এক টিমটিমে সময়
অন্ধকারের অসীমে
ভোরের পিছু ধাওয়া করা রাত
এই তৃতীয় প্রহর

কিছুতেই ভেবে পাচ্ছি না
আমি কি জীবনকে বাঁচছি এই প্রথমবার,
নাকি ভুল করে বাঁচার নামে
কেবলই করে চলেছি পুনরাবৃত্তি চিরকাল
শ্বাস নেবার ঠিক পূর্ব মুহূর্তেই

মাছেরাও কি পান করে জল
নাকি সূর্যও বোঝে গরমের তাপ
আলো কি কখনো দেখে অন্ধকারকে
বৃষ্টি কি চিরকাল ভিজতে থাকে এভাবেই
ঘুমের ব্যাপারে স্বপ্নও কি প্রশ্ন তোলে
যেমন তুলেছি আমি

দূর, বহুদূর চলে এসেছি
এখন আমি দেখছি তারাদের— দেখছি অনেক কাছে,
আজ সারাদিন বৃষ্টি হল খুব
আর তোমার মুখ থেকে ধুয়ে যেতে থাকল শব্দের যত গুনগুন

উতলা ধুন

রাত শেষ, ভোর হয়ে এল
তবু পাশ ফেরার মতো জায়গা গেল না পাওয়া
হে বন্ধু, এ হল ভুল ঠিকানার দিকে যাত্রা
যদি রাস্তা ভুলতে চাও সঙ্গ নাও,
শর্ত একটাই
সবার আগে ভুলে যেতে হবে নিজের নাম,
অবশ্য কে না ভয় পায় মানুষের ভুলে যাবার
মনে করাতে থাকে জন্ম জন্মান্তর ওদের
নিজের অনুপস্থিতি।
কবে পরিচয় হবে স্বপ্নের সাথে সত্যের
জেগে থেকেই বা কীভাবে উত্তর পাব
যখন কেউ ঘুমিয়ে রয়েছে আশেপাশেই
স্মৃতির ঘুমে তলে যেতে যেতে
এক উতলা ধুন সঙ্গে সঙ্গে থাকে
যে কিনা কিছুতেই সরে না মন থেকে

কবির নিয়তি

ওই আলো যদি সফেদ হত আরও
অদৃশ্য হয়ে যেতাম তুমি ও আমি
নিজের নিজের অদৃশ্য যন্ত্রণা নিয়ে বাঁচতাম
খুশির অনুপস্থিতি না জেনেই
ওই অদৃশ্যতায় অবাক হতাম
যার মধ্যে গায়েব হয়েছে ছায়া
আর পড়ে যেতে যেতে আমরা
কল্পনা করতাম উড়ে যাবার
আকাশ ছাড়াই
কেবলমাত্র শব্দই
পৌঁছে যেত বেঁচে থাকা স্মৃতির দিকে
যেখানে নতুন পরিচয়ের আর কোনো প্রয়োজন নেই
কবির নিয়তি
কবিতার নিয়তি
একই সঙ্গে এবং একইসঙ্গে
জড়িয়ে থাকা নিবিড় এক শ্বাস

Facebook Comments

পছন্দের বই