লেখক নয় , লেখাই মূলধন

রণজিৎ অধিকারীর কবিতা

ধারণা, যা রূপ পেতে চায়

তারপর সূর্য সমগ্র স্থানে ছড়িয়ে পড়তে চেয়েছিল, কিন্তু
কখনোই সে সমুদ্রের তলদেশ স্পর্শ করেনি।
গহন অরণ্যের পায়ের কাছে আর তোমার শরীরের গভীরে
                                        সে কখনোই ঝলমলিয়ে উঠতে পারেনি।
আমি যখনই তোমাকে ভালোবাসতে চেয়েছি—
ভেবেছি এই ভালোবাসা সূর্যের ছড়িয়ে পড়ার আগে হয়তো ছিল
কেবল একটা তির্যক রেখা, ত্রিকোণের ধারণা কিংবা
একটা স্পর্শক মাত্র— যা ছুঁয়ে থাকে শুধু…
আমি যখনই তোমাকে আদর করতে থাকি— ঝিকমিক করে ওঠে;
কোথা থেকে এসে সে আলো আমার অঙ্গ মাতিয়ে দেয়!
…ধারণা কীভাবে রূপ পায়? অপরূপ হয়?
কোটি কোটি বছরের দিকে তাকিয়ে থাকি,
মেঘের ফাঁকে ফাঁকে নক্ষত্রেরা ভেসে বেড়ায়…
আমি আমাকে খুঁজে পাই না,
তোমাকে দেখতে পাইনা— যেন সূর্যের ছড়িয়ে পড়ার আগের
দুই বিন্দুর ধারণা হয়ে আছি।
কোন পথে এতদূর এসে এই ভালোবাসায় ঝলমল করে উঠেছি আজ!
যে ভালোবাসা কখনোই আকাশ নক্ষত্রের বিস্তারকে স্পর্শ করতে পারেনি।

সেতু— যা ধ্বংস করে দেয়

সেতু— কখনোই দুটো মহাদেশকে জুড়ে দেয়নি,
বরং দুটো মানুষকে বরাবর সে ধ্বংস করে চলেছে।

… একটা পাতা, মিলিয়ে যাওয়ার আগে লম্বমান রশ্মি,
কোনো নারীর অশ্রুসিক্ত চোখের পাতা…
কিংবা পাকা গাঁথনির বিলাস হয়ে ওঠা ভঙ্গুর যা কিছু…
এক একটা সেতু।

দুটি ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে রাখে আকাশ,
অনতিদূর দুই জানালাকে ধরে রাখে একটা নির্জন কাঠবিড়ালি…
একটা প্রশ্ন প্রতিপ্রশ্ন দীর্ঘ অভিমান
আমাদের দুজনকে কাছে নিয়ে আসে;
দুই পাতের মধ্যবর্তী ফাঁক… সেই কাতরতা;
কোনোকালের এক সাদা পাল তোলা নৌকা দুই সমুদ্রের নামকরণের সীমানা
                                        যেভাবে ভেঙে দিতে চায়। আর তুমি আমি
—কতকিছুই না আমাদের সেতু হতে চেয়েছিল…
একটা কবিতার টুকরো, জ্যোৎস্না মাখা ডাল, স্বপ্নের সঙ্গম…
প্রত্যেকেই একে একে ধ্বংস করে দিয়ে গেছে।

আসক্তি

আমি সেই যোনিদের কাছে বারেবারে ফিরে যেতে চাই,
যারা তত আঁটোসাটো নয় আর অতি কল্পনাপ্রবণ।
বানানোর সময়ই তারা হয়ে উঠেছিল অবাস্তব বাঁধনহারা।
এইভাবে আমি ধীরেধীরে ঘুরেফিরে এসেছি
পৃথিবীর ভিড়াক্কার সমুদ্রতীরস্থ নির্জন হলিডে হোমের
                                        স্মৃতিকাতর ঘরগুলি — যেখানে এখনো
বিস্তর শীৎকার জমে আছে, এখনো দামাল হাওয়ার সঙ্গে
তাদের কথোপকথন শুনতে পাওয়া যায় আর সমুদ্রে নেমে গেলে
সেইসব প্রাচীন সঙ্গমের উথাল-পাথাল স্মৃতি টের পাই ।
কতগুলো বছর কারুর মনে নেই। আমি অনুমানে লিখে রাখি,—
বিস্তর ঝড়বৃষ্টি আর হাওয়া অতিক্রম করে অনেক অভিমান
আর একাকিত্বের বছরগুলো পেরিয়ে এসেও
                                        যে-আসক্তির কূলকিনারা হয়নি।

আমার কবিতা

আর কখনোই যেন আমার কবিতা দীর্ঘ না হয়ে ওঠে!
চাই কবিতাও হয়ে উঠুক একটা জ্যামিতিক গড়নে
                                        এবং ছোটো।

তোমার চোখের পাতায় লেগে থাকা অশ্রুবিন্দুর মতো
টলটলে হোক আমার কবিতা
কিংবা আমার হাত ভরে দেওয়া তোমার স্তনের মতো—
গোটা পৃথিবীও যে হাত অমন কানায় কানায়
ভরে দিতে পারেনি।

ছোটো
ভরাট এবং
গভীর একেকটি কবিতা…

আমার কবিতাও একদিন তোমার মতো একটা পাথরে
বসে থাক উদাসীন কিংবা সকালের ঘাসে খানিক হাঁটুক।
কিন্তু কখনোই চাই না একটা বিশাল মূর্তি, চাই না …
তার প্রগলভতায় ছড়িয়ে পড়া!
একটা ছোট্ট ত্রিভুজ তো কত কথাই বলে, তেমনি …
ভালোবাসা মানে অনেক জায়গা জুড়ে থাকা নয়,
কোনো এক বিন্দুতে স্পর্শ করা।
তোমার সূর্যের কারুকাজ করা যোনি— কখনোই তল
পাইনি যার— আমার কবিতা সেই অতল গহ্বরের মতো
                                        রহস্যময় হতে পারে না?

যদিও শিশিরমাখা হেমন্ত শেষমেশ একটা হেমন্তই…

তোমার ভালোবাসার মধ্যে চেয়েছি একটা বিশেষত্ব।
যেন তোমার রেগে ওঠা, কেঁদে ওঠার ভঙ্গি,
                    আদরে শিউরে ওঠা, যন্ত্রণার কাতরতার ভেতর
                                        কেবল তোমাকেই খুঁজে পাই।
প্রকৃতির খামখেয়ালিপনার বাইরে গিয়েও
আষাঢ় যেভাবে একটা আষাঢ়ই হয়ে ওঠে; কিংবা
বসন্ত কি কখনো অর্থহীন হয়ে যায়!
কিন্তু ভালোবাসার মুহূর্তগুলিতেও আমি ভুলি না—
তোমার অতল চোখ, ঈষৎ নমিত স্তন, যোনির বিস্তার
… সব প্রকৃতি থেকেই নেওয়া। তারপরও
যা তোমার— এক সময়চেতনা, যা মুহূর্তগুলিকে
নতুন করে তোলে। দেখি— তোমার ভ্রূভঙ্গি, স্পর্শে কেঁপে ওঠা,
বর্শাবিদ্ধ হওয়ার কাতরতা… তোমারই।
কখনো অদলবদল করে নিই আমাদের ভূমিকা,
যাবতীয় খেয়াল… ভেঙে দিই পরম্পরা… আর
আদরের রীতি, সকাল-বিকেল-রাত্রিকে টুকরো টুকরো করে
আবার জুড়ে দিই। কেননা তুমি
আমার ভালোবাসার মধ্যে চেয়েছ একটা বিশেষত্ব।

Facebook Comments

পছন্দের বই