লেখক নয় , লেখাই মূলধন

রণজিৎ অধিকারীর কবিতা

বরফের দেশে কেউ নেই আমার

বরফের দেশে আমার কেউ নেই তবু মনে হয়
কেউ আসবে বরফের দেশ থেকে আমরা জানি,
বরফ মানুষকে খুব বিচ্ছিন্ন করে দেয়, নিঃসঙ্গ… আর
নভেম্বরে রাস্তাঘাট ভরে যায় পুরু বরফে।

চিত্র: জর্জিয়ো দি চিরিকো

গাছপালার নিঃসঙ্গতা শূন্যতাবোধ কীভাবে লেখা যায়!
জানি না কেন হেমন্ত এলেই মনে হয় বরফের দেশ থেকে
কেউ আসবে— আমার কাছেই এসে বসবে
নাতিউষ্ণ রোদে।
এখন দুপুরের দিকে আকাশ স্বচ্ছ নীল আর
মনে হতে থাকে জীবন ক্রমে খাঁ খাঁ হয়ে আসছে।
কেন বরফের দেশেরা অনেক দূরে, কেন কেউ নেই আমার
সেইসব দেশে!— মনে হয় নভেম্বর এলে।
বরফের দেশ থেকে কেউ আসবে আমার কাছেই।

গান

তারাগুলোকে জ্বালিয়ে দেওয়াই তো আকাশজুড়ে গান গেয়ে ওঠা!
একে একে তাদের জ্বালিয়ে দেওয়া! ভাবো যে—
অতিদূর ছড়িয়ে পড়া শৃঙ্খলার মধ্যে সেই গান কেমন
বিশাল গভীর নিয়ন্ত্রিত!
আমাদের তারস্বরে গেয়ে ওঠা গান কিংবা অস্ফুট মৃদুস্বরের গান
কতদূর যেতে পারে
সমুদ্র কি বোঝে আমাদের গান? পাশব বৃত্তি কি মাথা নোয়ায়।
আমাদের গানের কাছে? বন্যতা?
তারচেযে ভাবো— ওই আকাশ জুড়ে ছড়িযে পড়া তারাদের গান
কিংবা একে একে তারাদের জ্বলে ওঠা…
অন্ধকারের দিক থেকে নৈঃশব্দ্যের দিকে ছুটে যাওয়া সেই চির গান

নভেম্বরের সন্ধে অথবা…

নভেম্বরের সন্ধেগুলোয় যখন আমার ভালো লাগবে না।
আমি তখনও কি বুঝতে পারব না— জীবনের জন্য চাই
গভীর শ্বাস নিতে পারার ক্ষমতা ও দীর্ঘ চুম্বনের সাহস!
এত যে বাস্তব কথা লিখছি নিশ্চিত জানি পাঠকেরা
নভেম্বরের অর্থ করবে প্রতীকী— তারা কিছুতেই মানবে না যে,
যথাযথ জীবনের মতোই কবিতা হতে পারে কাঁচা ও অগভীর!

জীবনকে না বোঝার মতোই আমার যে আয়ত্ত হয়নি
কবিতার কলাকৌশল; কবিতা লেখার জন্যও চাই
গভীর শ্বাস নিতে পারা আর দীর্ঘ চুম্বনের স্মৃতি তা
বুঝতে বুঝতেই গড়িয়ে যাবে অক্টোবরের বাকি দিনগুলিও।

আমি নিশ্চিত নভেম্বরের সন্ধেগুলো আমার ভালো লাগবে না
কেননা ভালো লাগানোর জন্য চাই যে যথেষ্ট কলাকৌশল তা
কবিতাকে চূড়ান্ত অবাস্তব করে তুলতে পারার মতোই কঠিন।

কল্পনার যথেচ্ছ সুবিধে আর…

কল্পনার যথেচ্ছ সুবিধে নিয়ে আমরা এক একটা
লোমশ বদ্বীপের ভেতর ঢুকিয়ে দিতে পারি আমাদের
উপোসি বল্লম— তারা কতদিন প্রেম পায়নি!
হতে পারত এ পৃথিবী প্রেমিক-প্রেমিকাদের জন্য সর্বোত্তম বিছানা।
কেন বন্ধ দরজার ভেতরে গুমরে উঠেছে আকাঙ্ক্ষা!
সমুদ্রের নীচে, পাহাড়ের বুকের ভেতর প্রেমের অবদমিত চিৎকার…

চিরকালই প্রেমিক প্রেমিকাদের ছিল যথেচ্ছ কল্পনার সুবিধে: তারা
কাল্পনিক মেহগনি ছায়ার নীচে অনর্গল কথা বলে বলে
হেঁটে ফিরেছে। তবু
কতদিন তারা উপোসি— তারা পরস্পরের দিকে তাকিয়েই
কাটিয়ে দিয়েছে কত কত বয়স; অথচ তাদের ছিল এক এক
তীব্র বল্লম আর গুহার মতো রহস্যময় ফাটল।

পাতা ঝরিয়ে দেওয়া রূঢ় সময়, আমাদেরই বানানো নিয়মকানুন
মাড়িয়ে চলে যাচ্ছে আমাদেরই আকাঙ্ক্ষাগুলিকে; মাড়িযে গেল
মেহগনি গাছের ছায়াদের। তাহলে থাকল পড়ে অথর্ব বল্লম,
কুঞ্চিত গুহামুখ আর কল্পনার যথেচ্ছ সুবিধেটুকু।

Facebook Comments

পছন্দের বই