লেখক নয় , লেখাই মূলধন

রুম্মানা জান্নাতের কবিতা

বরুন ফুলের সন্ধ্যা

‘ঠিকানা জানি না, বাড়িটা চিনি ‘

এটুকুই সরল দুঃখ আমার। নানান গাছ নানান কারণে কাটা হয়ে যায়। অকারণেও কারো কারো ভাই মরে যায় জন্মের আগেই।

‘ঠিকানা জানি না, বাড়িটা চিনি’

তুমি আমাকে বলো, এপ্রিল থেকে শাহবাগের মাঝখানে কত ঋতুর দুরত্ব—! ক্রমশ নদী ও নৌকার কাছে আমরা একা হয়ে পড়ি। চিঠিতে যে বৃষ্টির কথা লেখা ছিল, ট্রাংকবন্দি থাকল সব ফোটা—পাতাবাহারের বোঁটায় দুলছে যৌথ ছাদের কল্পনা—

‘ঠিকানা জানি না, বাড়িটা চিনি’

জং ধরা জানালায় ফুফুর না থাকা তাকিয়ে আছে, এখনো। বসন্ত আর শরৎের হাওয়ার রং আমরা আলাদা করতে পারি না।

শুধু—
তুমি আমার, আমি তোমার ভেতর ঢুকতে ঢুকতে দেখতে পাই— গাছটা কাটা হয়ে গেছে!

সুইসাইডাল

তুমি কতদূর অব্দি পৌছে দেবে এ খবর—
সুইসাইড! সুইসাইড!

হাওয়া থামছে। থামছে না।

পাহাড়ের ওপাশে বৃষ্টি নেই, এ কথা আমি জানি। তবু বলছি, ভূগোল পড়ো না। জেনে যাবে, আমাদের মৃত সন্তানেরা বিশাখা প্রদীপ নয়, কিছু নয়—প্রকৃতির মিথস্ক্রিয়া।

অযথা শীতকাল, ইভার সোয়েটার, অন্য কোনো নামের পাশে বসতে চাচ্ছো তুমি—এইসব দুঃখ আমার ভালো লাগে।
আমি ক্লান্ত নই। মা’কে আমি চিরকাল মা বলে ডেকেছি। মর্গে দাঁড়িয়েও আমি বিশ্বাস করেছি খাবারের ঘ্রাণ।

তবু মৃত্যুর প্রতি সন্দেহ পাবার আগেই আমাকে নাও—দেখাও সুরধন্য এক আঁতুর ঘর!

বৃত্ত

জ্বরের ভাষা বুঝে সিলিংফ্যান
ঘুরে যাচ্ছে দীর্ঘকাল।
খসে পড়া পলেস্তারা যেন
বিগত জলদাগ—

তারের গভীরে বুজে আসছে মা!

যে বৃষ্টি আনতে গিয়ে নিঁখোজ সহোদর
হ্যাঙারে তার ঝুলে আছে জন্মদিন।

এমনও হয় আক্রান্ত রাত
উলটে দিচ্ছে গেলাস, বইয়ের তাক
একপাটি জুতোর আয়ুপথ—

এবং একটি জানালা শুধু দেখে গেল
চিরদিন সামনের শাদা বাড়ি।

কন্যা ( আইশা’কে)

ভোর হওয়ার অকস্মাতে ফুল ফুটে যাচ্ছে। পর্দাহীন কাঠের জানালা— পিঠ বাঁকিয়ে ধানমুখী বাতাস আমাদের অলি গলি ঢুকে যায়।

পিঁপড়ার ঢেলার উপর মেয়েটা হাত মেলে বসে আছে। পোয়াতি মেঘের বিকাল নীচু হয়ে উড়ে যাচ্ছে উত্তর পাড়ার ভিঁউয়ে। যেখানে খেসারির সারি। তাকানোর জায়গা জুড়ে খেত। শুধু ঈদের চাঁদের মতন উঁকি দিচ্ছে একলা বাঁশের থোপ।

পুকুরে পৌছানোর আগেই মুরগির সব ডানা কাটা পড়ে গেছে। শতবর্ষী গাছটার নিচে আমরা সন্ধ্যার নিঃসঙ্গতা নিয়ে কথা বলেছি।

আমাদের দেনা, ডালভাতে ঘুম, পেপারের বিল ভাঁপ ওঠা কুয়াশার মতো ভারী হয়ে থাকে।

এই ক্যালেন্ডার ভোলা দিন, পাশের ছাদে একটা সুইসাইডাল শাড়ি, নিংড়ানো পানির পাতায় জমানো আদর ধুয়ে যাচ্ছে।

তবু শুনেছি, কন্যার জন্মদিনে—
বাঁশবনী জোছনার ধারে খুব ডানা ঝাঁপটানো বৃষ্টি হতে থাকে ভররাত !

‘মিস করি’ সিনট্যাক্সের বাইরে, তোমাকে

আয়নার ওইপাশে খোলা ছাদ—
দুইটা পাখি বসে আছে।

তাদের আমি স্বপ্নে ওড়াতে চাই

আর শুনি, আয়নার মধ্যে ছোটো কিঁচকিঁচ ডাক ঝন ঝন করে ভেঙ্গে পড়ছে!

এই দুপুর কিংবা প্রতিটা দুপুর তুরাগ নদীর দিকে তাকিয়ে থাকতে পারি। তীব্র হুইসেল ঠেলে ছোটো জাংলায় লাউ পাতা, বেড়া ভাঙা খেতের মধ্যে ঘোলা পানি ঢুকে যাচ্ছে। তোমাকে সব কথাই বলতে পারি। কিন্তু কেন বলব? এমন সন্দেহের ভারে একটা তিল তোমার শরীরে ফুটল কি না আমি জানি না। শুধু তোমার বাড়ন্ত চুলের আঠায় আঙুল আটকে যাওয়ার ভয়ে আমার স্বপ্ন ভেঙে যাচ্ছে !

এই বিকাল কিংবা প্রতিটা বিকাল আমি ঘুমিয়ে থাকতে পারি। কিন্তু মোঘল সাম্রাজ্যের যেকোনো চরিত্রের গলিতে আমার হাঁটতে ভালো লাগে। ‘আনলাকি থার্টিন’ এ বসে ভাগ্যকে আমার সবুজ নহরের দেশ মনে হয়। যেখানে একটাই ঘর, ভুলে যাওয়া গানের মতন সত্য। যে বাস শাহবাগে যাবে না কখনোই তার সবথেকে নরম গদি আমরা দখল করে রাখব দিনের পর দিন। আর কবরস্থানে ঘুরতে যাওয়ার তারিখ আমরা শুধু ক্যালেন্ডারেই দাগ টেনে রাখব।

এই সন্ধ্যা কিংবা প্রতিটা সন্ধ্যা এভাবেই বসে থাকতে পারি। মনে পড়তে পারে, ওভারব্রিজ, লাফ না দিয়েই চলন্ত বাসের ছাদে নিজেকে দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে আলো জ্বলে উঠছে। আরেকটু এগোলে, পলিতে মোড়ানো রিক্সায় তোমার নিঃশ্বাস এমন ঘন হয়ে আসছে যেন পৃথিবীতে আর কখনো বৃষ্টি নামবে না। নীল পলিথিনের প্রয়োজন এই মোড় ঘোরার সাথে ফুরিয়ে যাবে। এই সন্ধ্যায় একটা যৌনমুখর কবিতা লিখতে পারি। কিন্তু বাংলা সিনেমায় কেঁপে ওঠা ফুলের ধারনা তুমি ভাঙছ না কেন?

Facebook Comments

পছন্দের বই