লেখক নয় , লেখাই মূলধন

শার্ল বোদল্যেরের তিনটি কবিতা

মূল ফরাসি থেকে অনুবাদ: যশোধরা রায়চৌধুরী

আলোকস্তম্ভ

রুব্যাঁস, বিস্মৃতিস্রোত, আলস্যের সাজানো বাগান
রক্তমাংসে গড়া শীতল বালিশ— যেইখানে নেই প্রেমের আহবান
সেইখানে ছলাচ্ছল তবু, নেয় ভাসিয়ে জীবন
সমুদ্রে সমুদ্র যেন— বা আকাশে যেমন বাতাস।

লেওনার দ্যভ্যাঁসি— কী অন্ধকার, অতল দর্পণ
মধুর হাসির প্রিয় দেবদূত যেখানে সতত
যাদুটোনা ভরপুর— হয় আবির্ভূত
সে-দেশের হিমবাহ আর চিরহরিতের ছায়াতে গোপন।

রঁব্রঁত, বিষাদঘন হাসপাতাল, গুঞ্জরণময়
বিশাল ক্রুশের চিহ্ন শুধু তার সাজ মনে হয়
সাশ্রু প্রার্থনা শুধু উঠে আসে সেই খানে আবর্জনা থেকে
এক লহমায় আসা শীতের সূর্যের আলো মেখে

মিশেল অঁজ— সেই অব্যক্ত স্থানে হারকিউলিসের আনাগোনা
যিশুদের সঙ্গে তারা মেলামেশা করে আর ভূত প্রেত দানো যত জন
দুর্দম ক্ষমতাবান— সোজা উঠে যায়, গোধূলির বেলা হলে
উদ্যত আঙুলে যারা ছিঁড়ে ফেলে নিজস্ব কাফন—
বক্সারের ক্রোধ আর পশুদের নির্লজ্জতা, তাও
একত্র করার তত্ত্ব জানো তুমি— রোথোদেরও সুন্দর দেখায়
অহংকারে ফুলে ওঠা হলুদ দুবলাদেরও দেখা যায় বিশাল হৃদয়

প্যুজে, এক সম্রাট, বিষাদঘন— কারাবন্দিদের।
ওয়াটো— এক উৎসব, যেখানে নামী-দামী হৃদয়েরা
ঝকমকে আলো জ্বেলে প্রজাপতিদের মতো ওড়ে
শান্ত ফুরফুরে পর্দা— ঝাড়বাতির আলোয় উজ্জ্বল
নাচের ভেতর যেন উন্মাদনা ঢেলে দেয়— ঘুরপাকে ঘোরে
গোইয়া— দুঃস্বপ্ন এক— অজানা জিনিস দিয়ে ভরা
ডাকিনীর হাল্লাবোলে রেঁধে খাওয়া ভ্রূণেভরতি করা
আয়নার সামনে বসা বৃদ্ধা আর নগ্ন শিশু, যারা
দৈত্যকে তাতিয়ে তুলতে ঊরু অবধি মোজা টেনে বাঁধে
দলাক্রোয়া— রক্তে ভরা হ্রদ, বাসা গেড়ে আছে দুষ্ট দেবদূত
চিরহরিতের বন, ফার বন দিয়ে ছাওয়া দেশ
বিমর্ষ গগনতলে আশ্চর্য সংগীতের রেশ
বয়ে যায়, যেরকম ওয়েবারের চাপা দীর্ঘশ্বাস বায়ুভূত

এই অপবাদ, এই কাতরোক্তি, অভিশাপদল
‘হে ঈশ্বর, মঙ্গলময়’ গান, মূর্ছনা, কান্নারোল, অশ্রুজল
এসব তো একটাই প্রতিধ্বনি— সহস্র গোলোকধাঁধা পাক খেয়ে আসা
মর-হৃদয়ের জন্য দৈবী আফিম দিয়ে ঠাশা

সহস্র প্রহরীর হুংকার যেন বারম্বার
সহস্র শিঙার মধ্যে বেজে ওঠা তান যেন, সুষম, সপাট
একটাই আলোকস্তম্ভ— সহস্র দুর্গপৃষ্ঠে জ্বলেছে বিরাট—
অরণ্যের গভীরে হারানো ব্যাধেদের দেওয়া এক যৌথ ডাক।

আমরা যে অভিজাত, তার সাক্ষ্য যদি থাকে কিছু বা নিশ্চয়
এই সেই সেরা সাক্ষ্য যা আমরা হাজির করি সম্মুখে তোমার, ওগো প্রভু!
আবেগের কান্নারোল— যুগে যুগে এর ঢেউ ভেঙে পড়ে পাড়ে
তোমার অনন্তের তীরে এসে, মরে মরে শেষ হয় তবু!

বিদেশি

— ওগো রহস্যময় বিদেশি, বলো দেখি কী তোমার সবচেয়ে প্রিয়? বাবা, মা, ভাই না বোন?
— আমার না আছে বাবা, না মা, না বোন, না ভাই।
— তবে কি বন্ধুরা?
— এমন এক শব্দ আপনি ব্যবহার করলেন যার অর্থ আজ অবধি আমার অজানা।
— আপনার দেশ, তবে?
— কোন দ্রাঘিমায় তা অবস্থিত, আজও অজানা আমার
— সৌন্দর্য?
— তাকে আমি ভালোবাসতে পারতাম, দেবী ও অমর্ত্যবাসিনী।
— তবে কি স্বর্ণ?
— তুমি ঈশ্বরকে যতটা ঘৃণা করো আমি ততটাই, তাকে…
— ওহ! তবে কী ভালোবাসেন আপনি, অসামান্য বিদেশি?
— আমি ভালোবাসি মেঘেদের… ওই মেঘ যারা ভেসে ভেসে যায়… ওইখানে… অপরূপ মেঘেদের দল…

কুকুর ও আতরের শিশি

“আমার সোনা কুকুর, আমার আদুরে ভৌ ভৌ, আমার আহ্লাদি তু-তু, আয় আয়, শহরের শ্রেষ্ঠ সুগন্ধির দোকান থেকে কেনা এই চমৎকার আতরটা শুঁকে যা দেখি!”

আর সেই কুকুর, আসে লেজ নাড়তে নাড়তে, ওই লেজ যা কি না আমার বিশ্বাসে ইতর প্রাণীদের ক্ষেত্রে এক গাল হাসির সমতুল্যই… কাছে এসে কৌতূহলী হয়ে ভিজে নাকটা খোলা শিশিটার মুখের কাছে রাখে; তারপর হঠাৎ পিছিয়ে যায় প্রচণ্ড ভয়ে আঁতকে উঠে, আমার বিরুদ্ধে তার তিরস্কার জানাতে, গর্জন করে ওঠে।

“আহ! হতভাগা কুত্তা! এখন যদি তোকে এক দলা পুরীষ এনে দিতাম কত না ফুর্তি পেয়ে শুঁকতিস, হয়তো-বা খেয়েই ফেলতিস। এভাবেই, একেবারে এরকমই… আমার দুঃখী জীবনের হাভাতে সঙ্গীরা, তোরা সব সেই জনসাধারণেরই মতো— সূক্ষ্ম সুবাসে ভরা আতর যাদের কাছে এনে দিলে যারা হতাশ হয়ে পড়ে, যত্ন করে খুঁজে খুঁজে আনা আবর্জনাই যাদের পছন্দ।

কবি পরিচিতি:

শার্ল বোদল্যের (পুরো নাম- শার্ল-পিয়ের বোদল্যের, জন্ম- ৯ই এপ্রিল, ১৮২১ পারিতে। মৃত্যু- ৩১শে অগাস্ট, ১৮৬১ র্যু দু দোম)। ফরাসি সাহিত্যের অন্যতম কবি ও অনুবাদক। প্রাবন্ধিক ও শিল্প-সমালোচক হিসেবে তাঁর কাজও উল্লেখের দাবি রাখে। ফরাসিতে এডগার অ্যালান পোর অন্যতম প্রথম অনুবাদক ছিলেন তিনি। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ- ‘লেস ফ্লেউরস দু মল’ আর ‘প্যারিস স্প্লিন’। একমাত্র উপন্যাস- ‘লা ফাঁফারলো’।

Facebook Comments

পছন্দের বই