লেখক নয় , লেখাই মূলধন

শুভম চক্রবর্তীর কবিতা

ঘুম ভেঙে গেলে

ঘুম ভেঙে যাওয়া অন্ধকার রাতে তারাভরা আকাশের দিকে তাকালে শ্যামা মায়ের কথা মনে পড়ে
আর শ্যামা মায়ের দিকে তাকালে তারাভরা আকাশের কথা
ছিপছিপে, শ্যামাঙ্গী আমার প্রেমিকাও এমন নদীর জল, মূর্তির ধারণা তার পাড়ের মাটি
তারই জলে ছলছল করছে অশ্রুভারানত মহাজগৎ
এ-জগৎ বৃহৎ অন্ধকার থেকে সুতো ছড়িয়ে ছড়িয়ে আবার গুটিয়ে মিশে যাবে অন্ধকারে
‘দে মা মূর্তির ধারণা’ এই আপ্তবাক্যটিকে জড়িয়ে কাঁদছি আমি, না কৃষ্ণানন্দ, না জল, না তারা, না জগৎসংসার
ঘুম ভেঙে গেলে খুব কোল দিও, তারা ভরা কোল!

দিনলিপি ১

অন্ধকারে ফুটে উঠছে আলো
প্রকৃতি জাল বিছিয়ে দিচ্ছে সৃষ্টি হবে বলে
খুলে খুলে যাচ্ছে মাকড়সার ফাঁস, শায়ার দড়ি, তোমার ফোঁপানি
খুলে খুলে যাচ্ছে বাক্যহীন জাদু, ঠোঁটে অস্ফুট জ্বলে ওঠা বিড়ি
খুলে যাচ্ছে তার আগুন ও তার দহনশক্তি
এরকমই তদগতচিত্ত অবস্থায় মাস্টারবেট করি আর শ্যামাসংগীত বাজে
কেঁদে কেঁদে আকুল হয়ে ঘুমিয়ে পড়েন পান্নালাল
সৃষ্টিহীন এই শোক, শ্লোক হচ্ছে না হে

দিনলিপি ২

মন্দিরের ঘন্টাধ্বনি, চাঁদ আর তুমি একই দৃশ্যবাস্তবতার প্রেক্ষাপটে স্থাপিত হয়েছ
শুদ্ধ চিন্তার একটা ছবি আর কাদামাটির ঢেলা পাশাপাশি
সে কাদায় গঙ্গামাটি, বেশ্যার রজঃস্রাব ভেজা মাটি একাকার
মিটমিটে তারার আলোয়, বসন্তের রোদে বসে যে এসব ভাবছে
দৃশ্যবাস্তবতা থেকে অনতিদূরে অন্য আরেকটি দৃশ্যের আয়োজনে সেও প্রকরণ
ভিড় থেকে একটু দূরে, স্বতন্ত্র মর্যাদায়, অন্ধকারে
মদ, মাংস, মৎস, মুদ্রা, মৈথুন সাজিয়ে রাখছে কেউ
পায়েস ও এঁটোকাঁটা কিছুই যে বাকি থাকছে না হে

দিনলিপি ৩

গ্রীষ্মের দাবদাহে ভরা দুপুরবেলা শিশুর ঘুম ভেঙে গেল
স্বপ্ন থেকে সচেতনে এলো সে, এসেই খানিক ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলো

এলেমেলো চাদর দেখে মনে পড়ে যায় প্রসূতিসদনের কথা

জানলার ওপারে গুমগুম করছে খটখটে হাওয়া

টলোমলো পায়ে, থেমে থেমে, সে নামছে স্বপ্ন থেকে সচেতনে, সিঁড়ি ধরে ধরে

দিনলিপি ৪

অন্ধকারে শুয়ে আছি
বাইরের হাওয়ায় পর্দা কেঁপে কেঁপে উঠছে
শরীরের ভেতর যে শরীর অথবা মনের ভেতর যে মন তাকে মনে পড়ে এইসময়
ক্লান্ত লাগে, ঈশ্বরচিন্তা করি
নিজের বুকের বোঁটায় আঙুল ঘষি, শিরশির করে না
এই নিষ্ক্রিয়, অনর্থক শুয়ে থাকা
এই অলস মনভঙ্গীকে কী নামে ডাকো তুমি
নিজেকে কেটে কেটে দেখতে ইচ্ছে হয়
এই হাত এই পা এই লিঙ্গ তক্তাপোশে মেলে নেড়েচেড়ে দেখব
নিজেই হব নিজের খুনী
নিজেকে নিজেই দেখে যাব খণ্ডে খণ্ডে এবং সমগ্র মিলিয়ে
এবার তো বোঝা যাবে মহাজগৎ-এর কাছে মানুষের ভালোবাসা, কামনা ও কাম কতখানি মূল্যহীন, কতখানি মূল্যবাণ ক্ষত

দিনলিপি ৫

ভনিতাবিহীন ভাবেই বলছি তোমাকে ভীষণ ভালোবেসেছিলাম
তাই আজ কান্নায় ভেসে যাচ্ছে চৌকাঠ
ছড়ানো চাতালে, ছড় টেনে টেনে কী একটা বাজাচ্ছ সারাদিন
কিন্তু তার সুরের রেশটুকু মেখে চলে যাব দূরে
আর তারই গন্ধে সারাদিন খুশি খুশি থাকব এই নির্লিপ্তি গাছের পাতাই যেন ঝরে গেছে আর মাটিতে মিশে গেছে
তাকে খুঁজি, মাটি খুড়ে খুড়ে
কেঁচো ও অজানা মাটিপৃথিবীর পোকামাকড়ময় পেলবতায়
যে ভাবে আগুন ও দহনশক্তি
আলো ও তার অন্তর্গত দাউদাউ
ভৌমজল ও ফোয়ারা
তেমনই আগাপাশতলা জড়িয়ে মাড়িয়ে এমন মিশে আছে, মিশেই আছে
যে কান্নায় ভাসছে চৌকাঠ কিন্তু ভিজে যাওয়াটুকু নিয়ে কারও পদছাপ আর আঁকা হচ্ছে না

দিনলিপি ৬

গ্রামেই থাকি বলে নির্জনতার শব্দ শুনতে পাই
কোলাহল থেকে দূরে শান্ত আর সমাহিত পাখিদের অন্য কোলাহল আমি প্রতিদিন শুনি
ঝিঁঝিঁর ডাক একটানা শুনলে ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে
মনে হয় কেউ নেই, কোথাও, কেউ আমার অপেক্ষায় নেই
আশ্চর্য এই যে ঝিঁঝিঁর শব্দ শুনি কিন্তু তার অস্তিত্বে আমার বিশ্বাস নেই
সে যে আছে, তাই ডাক শুনি এরকম তো ভাবিনি কখনও
মায়া জমে যায়, এরকম ভাবলে বড়োই মায়া জমে যায়
সকালবেলায় কেউ দুধ নিয়ে এলে তার সঙ্গে গল্প করি, পিঠে হাত রাখি, টুকটাক বিনিময় করি
সে উঠব উঠব করলেই হাত ধরে আবার বসাই
ঝিঁঝিঁর ডাককে আমি বিশ্বাস করি, নিশির ডাককেও
কেবল প্রিয়সম্বোধন করে কেউ ডাকলে, তাকে বলে দাও তুমি নির্জনতার শব্দ
দূর থেকে ঝিঁঝিঁর ডাক ভেসে আসে ঝিঁঝি আসে না
ডাক থাক, সম্ভাবনা থাক, খুব বেশি কাছাকাছি এসো না, কবিতা

Facebook Comments

পছন্দের বই