লেখক নয় , লেখাই মূলধন

সঞ্জয় মৌলিকের কবিতা

প্রচার

‘তিনটে আপেলে যা নেই, দুটো পেয়ারাতে আছে’

আমি অবাক বিস্ময়ে সেই অল্পবয়সি ফলওয়ালার সহস্র ভ্রূভঙ্গির দিকে তাকিয়ে থাকি।

ছোট্ট একটা আপেলের দুটো গোলার্ধ দু-হাতে ধরে সে অনর্গল বলে যাচ্ছে—

‘হ্যাঁ, আপনার জীবনে একটি আপেল সত্য হতে পারে, কিন্তু জানবেন, আরও সত্য
মহাকর্ষ, তার চেয়ে বড়ো সত্য স্যার
আইজ্যাক নিউটন’

লাইন ক্রমশ আমাকে ঠেলে কাউন্টারের দিকে এগোতে থাকে।
টিকিট কাটার ইচ্ছে হয় না আমার।

শান্তিপুরের ট্রেন বনগাঁর দিকে রওনা দেয়।

‘জানবেন, সব সভ্যতাতেই এমন সময় আসে— মানুষ যখন
গন্তব্য ভুলে গিয়ে এদিক সেদিক ছুটতে থাকে’
ছেলেটি নির্বিকারভাবে বলে চলে—

‘একটি করে পেয়ারা প্রত্যহ দুপুরে খাওয়ার পরে খান। যৌবনের তেজ বাড়বে।
একথা বলে গেছেন ভারতের কবি বিধান চন্দ্র রায়
আর রাশিয়ার ডাক্তার কার্ল মার্কস’।

দেখি, এক অর্বাচীন লোভে পড়ন্ত নায়িকারা এসে
ঘিরে ধরছে তাকে!

***

একদিন বিকেলের দিকে মেজকাকু আমাকে ডেকে বললেন

শোন বাবাই, বই-পড়া খুব গর্হিত ব্যাপার, বসার ঘরে বই সাজিয়ে রাখা
আরও খারাপ কাজ… শুধু বই আছে বলেই রামেশ্বরমের ঝিনুক, বিশাখাপত্তনমের বাসন
ঘরের ভেতর সারাজীবন রাখার জায়গা পেল না তোর কাকিমা।
রাজাদাদার বইপত্তর… মিষ্টুদিদির মেডেল রাখা গেল না অতিথিদের সামনে…এত এত
অক্ষরের আবর্জনা নিজের হাতে সরাতে পারিনি রে…এইসব পোকার খাদ্য, আমি চোখ বুজলে
তুই নিয়ে যাস, শোন বাবাই, যাকে ভালোবাসবি জেনে বুঝে নিবি, বইকে সে ঘরের মধ্যে
শ্রেষ্ঠ আসবাব বলে মনে করে কি না…ভুল বানানের মতো কোনো সম্পর্কে
জড়াস না কখনও!

তার কিছুদিন পরে মেজকাকু অনন্তলোকে চলে যান।

মিষ্টুদিদি এক কাপ চা নিয়ে ঢোকে। বলে, বাবাই, কী করে কী হল ?

আমি ছুট্টে গিয়ে একটা হরিচরণ নিয়ে আসি। তার উপরে চায়ের কাপটা
রেখে বলি, চল আজ কিছু-কিছু বানানের উৎসে ফেরা যাক।

***

চিটফান্ড

দু-কাঠার ওপর বাড়ি।

নীচের তলায় গ্যারেজ।
মিটার বক্স।

দোতলাতে হল-বেডরুম-কিচেন।
ওয়াশিং মেশিন। টিভি। ফ্রিজ।
ইনভার্টার। মাটির পুতুল।

তিনতলায় কাঠের সিংহাসন।
লক্ষ্মী। গণেশ। কৃষ্ণ। সরস্বতী।

সেলুলয়েডের সিঁড়ি ভেঙ্গে মোম-ফর্সা বউ
ওঠা-নামা করছিল। কারুকার্যময় কলে
হাত পাতলেই জল।


প্রিয় টিয়াপাখিটিকে সে ছেড়ে দিয়েছে। আর ঘুসি মেরে
সমস্ত আয়না ভেঙ্গে ফেলেছে বাড়ির।

সারাদিন সাড়া দেয়নি প্রতিবেশীর ডাকে।

চিলেকোঠার দরজা ভেঙ্গে ঢুকেছে পুলিশ।

***

সূত্র

গাছের তালিকায় থাকে অনেক বৃক্ষ।

বৃক্ষের তালিকায় অনেক গাছ।

সেই সূত্রে গাছ হয়ে আছি। বৃক্ষ হয়ে আছি।
মায়ার সংসারে।

জলের লাইনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখি অনন্তকাল
কাদের চুলের থেকে
পাতা উড়ে পড়ে। আরও কার বালতির উপচানো জলে শিকড়গুচ্ছ
নিভে গেল।

মাথার কোটরে পাখি ডেকে ওঠে।
দুই কাঁধ থেকে লাফ দিয়ে নামে দুরন্ত
বাদুড়েরা।

শেষ রাতে চুপি চুপি তাদের, তাদের
আধখানা কানের কাছে
গিয়ে বলি, এই নাও আশ্চর্য কুঁড়ি।

ফুটিয়ে দাও।

***

চড়কগাছে চক্ষু

‘unfortunately it was paradise.’
—Mahmood Darwish

নদী ও জঙ্গলে জড়াজড়ি।
নদী কামড়াচ্ছে জঙ্গলটিকে।
জঙ্গলও গলা টিপে রেখেছে নদীটির।

ভ্রমণকারী লেখকও বর্ণনাকালে বলবেন:
এখানে কোনো পিচের রাস্তা, লাইটপোস্ট
কিংবা একটি চায়ের দোকানের প্রশ্নই ওঠে না।

শীত না, বসন্ত না, বর্ষা না, কী ঋতু
ঠাহর করা প্রকৃতপক্ষে
অসম্ভব।

পাখি নেই, মৌমাছি নেই, জঙ্গলে।
মাছ নেই, ফেরি নেই, নদীটিতে।

একটা খুন-গরম-করা চিৎকার কোথা হতে আসছে।
তার পিছনে পিছনে ছুটছে চিকন কান্নার আর্ত রব।

ভালোবাসাবাসি কি নিষিদ্ধ হয়েছিল কখনো
এই বধ্য বনাঞ্চলে?

ভ্রমণের আরও একটু গভীরে ঢুকে, মহাশয়
নিশ্চিত দেখবেন:
অর্ধেক পুড়ে গিয়ে, অর্ধেক প্রাণ ফিরে পেয়ে
ঘাটের মড়া উঠে বসে আছে চিতার ওপর!

Facebook Comments

পছন্দের বই