লেখক নয় , লেখাই মূলধন

সাসকিয়া হ্যামিলটনের কবিতা

সাসকিয়া হ্যামিলটনের কবিতা

ভাষান্তর: বেবী সাউ

ভাঙা বাড়ি

আমার একটি ভাঙা বাড়ি আছে
দামি রাস্তার মতো বাড়ি
দুপাশে বাজার, কমলা রঙের আলো—
সময়ের মতো দীর্ঘ দীর্ঘ আশাবাদ
দিনের মতো রাত
রাতের মতো দিন
মানুষ ঘুমিয়ে পড়ার বদলে জেগে ওঠে সেখানে
আমার একটা ভাঙা বাড়ি আছে
যেখানে দরজা সবসময় খোলা
ভালোবাসা যাওয়া আসা করে

দরজার বাইরে

দরজার বাইরে যেতে গিয়ে, প্রথমে দরজা খুলতে হয়
তারপর নিজেকে খুলতে খুলতে
একটা সময়, দরজাটা তোমায় ডাকতে পারে
তুমি তার ডাকে সাড়া দেবে এ-কথা ভেবে নেয় দরজাটাই।
দরজার বাইরে যেতে গিয়ে, আগে জানতে হয়
কে আছে বাইরে
তার পর তুমি পা রাখতেই পারো
ঘনঘন দরজা নিজেকে খুলে রাখে না কখনো

সূর্যাস্ত

চায়ের রঙের মতো, জীবন এখন অপেক্ষা করে
পার্কের বেঞ্চে। ধোঁয়া ওঠে মন থেকে
জলের উপর দিয়ে আয়ু ছুটে যায়
মেঘের বিভিন্ন রং, যেন মানুষ
ব্যস্ত রঙের, বিষণ্ণ রঙের, অবসন্ন রঙের
তারা একে অপরের সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলে
আর আমরা হাঁটতে থাকি নিরাসক্ত বেলুনের মতো
সুতো ছাড়াই। যেন স্বাধীন। যেন, যেখানে খুশি যাব।

গাড়ি

আমি তার ভিতরে জন্ম নিই বারবার
আর সে ছুটে চলে কোনো পিছুটান ছাড়াই
জানলা দিয়ে দেখি তিন মাত্রা চার ও পাঁচ মাত্রায়
ভেঙে যাওয়া সংসার, দেখি মানুষ
আসলে পেঙ্গুইনের মতো
শুধু তাদের মধ্যে জমাট বেঁধে আছে এক প্রাচীন
রেললাইন। জমে আছে অনিবার্য কয়েদখানা।
সে আমাকে এক রাস্তা থেকে অন্য রাস্তায় নিয়ে যায়
বুঝি, জীবন আসলে বড়ো। মানচিত্রের চেয়েও।

লাশ

আমাদের বুকের উপরে রয়েছে এক সভ্যতা
আর বুকের নীচে রয়েছে আরেক সভ্যতা
হাজার হাজার পাখি এসে বসে শীতকাল থেকে
আর একটু দূরে যাবে বলে
কিছুক্ষণ জিরোয়
আমাদের বুকের উপরে রয়েছে এক সভ্যতা
বুকের নীচে রয়েছে এক সভ্যতা
সেখানে মাথা তোলে সরীসৃপ
স্বপ্নের ভিতর

কারখানা চত্বরে

এখানে ভূতের বাড়ি। ছমছম করে গা।
যেখানে ছমছম করে স্বপ্ন, আমি সেখানে এসে দাঁড়াই।
মানুষ সেখানে নেই, মানুষের ইচ্ছে পড়ে আছে,-
শ্যাওলাধরা পরিত্যক্ত মেশিনের গায়ে, জীর্ণ হাতলে।
এখানে ভূতের বাড়ি। ছমছম করে গা।
দস্তয়ভস্কির উপন্যাসের মতো, আমি একা হয়ে যাই
আর ভয় লাগে, কেউ যেন টোকা মারবে আমায়
পিছন থেকে, যেন অনেক জানা বাকি আছে।

সন্ধিক্ষণ

রাত এবং দিনের মধ্যে যে রাস্তা চলে গেছে হাইওয়ের দিকে
আমি তার পাশে বসে থাকি। জানি সে আসবে।
একটা হলিউডের গাড়ি, লাল রঙের, শাঁ করে ছুটে আসবে
আর নেমে আসবে আল পাচিনোর মতো ঔদ্ধত্য,
মার্লন ব্র্যান্ডোর মতো
আমেরিকা।

বুলডোজার

সভ্যতা মানেই একটা শহর ভেঙে আরেকটা শহর গড়ে তোলা।
তার মানে একটা শহরের নীচে জমা হয় আরেকটা শহর
তার নীচে নিশ্চয় আরেকটা। যেন তুমি গোলকধাঁধাঁ তৈরি করছ
নিজের কাছে ফেরার জন্য। কে কাকে হত্যা করেছে, এ নিয়ে
হয়তো বসে যাবে তদন্ত। বসবে মেডিকেল বোর্ড, জুরিবোর্ড
আর ফরেনসিক রিপোর্ট নিয়ে তুলকালাম হতে পারে সেনেটে।
কিন্তু সভ্যতা মানেই একটা শহর ভেঙে আরেকটা শহর গড়ে তোলা—
একটা কবরের নীচে আরেকটা কবর। তার নীচে আরেকটা।
যাদের ভাঙতে পারে না ওই একশো টনের হারকিউলিস।
যাকে আমি হলিউড ভাবি।

ওভারডোজ

ডেনভার যখন গাইতে মঞ্চে এসে দাঁড়ান
আমি ভাবি পৃথিবীটা কত বিষাদের মতো সুন্দর।
ডিলান যখন গাইতে গাইতে ফুঁ দেন তাঁর অর্গানে
ভাবি, এর পর আর বিপ্লব হতে পারে না।
চে’-এর টি শার্ট পরে আমরা লিঙ্কনের সমাধিতে ফুল দিই…
ভাবি, একদিন আমেরিকাও একটি দেশ হয়ে উঠবে।
মাথার উপর দিয়ে স্বাধীনতার হেলিকপ্টার উড়ে যায়
আমরাও, উড়তে থাকি, সায়েন্স ফিকশন থেকে
সায়েন্স ফিকশনের দিকে।

ফোর্থ জুলাই

ধরা যাক ঈশ্বর আছেন, যিনি তোমায় অত খেয়াল করেন না।
ধরা যাক, তোমার বাড়ি মানেই কিছু পালিয়ে যাওয়া কবিতার বই।
ধরা যাক, তুমি চিৎকার করলে বলে, বোমা পড়ল আফগানিস্তানের গ্রামে।
ধরা যাক, তোমার খিদে পেল বলে খেতে পেল না ইথিওপিয়া।
ধরা যাক, ঈশ্বর আছেন, যিনি তোমায় অত খেয়াল করেন না।
ধরা যাক আয়নাও আছে, যার দিকে চোখ তুলে তাকাতে ভুলে গেছ।

জন লেননের প্রতি

দুঃস্বপ্ন মানেই কিছু বড়বড় বাড়ি, গোপনে লুকিয়ে রাখা বোমা, আর
সৈন্যশিবির
অহঙ্কারের মতো উড়ছে পতাকা
আমার নিগ্রো বয়ফ্রেন্ড আজও মিসিসিপির দিকে হাঁটে
ডেঞ্জেল ওয়াশিংটনের মতো যেন সেই একমাত্র বেঁচে
এই যুদ্ধ ও প্রতিহিংসার পৃথিবীতে।
দুঃস্বপ্ন মানেই টাইমস্কোয়ার, লাসভেগাস এবং
রাস্তায় ছড়িয়ে থাকা মদ।
দুঃস্বপ্ন মানেই ভিনগ্রহের মতো আমার দেশ
ভিনগ্রহের মতো বিমানে
পাড়ি দিচ্ছে কয়েক হাজার মাইলের দিকে
সাদা একটা বাড়ি থেকে
উড়ছে পতাকা
আর শুয়ে আছেন লেনন।
আমরা ভাবছি পৃথিবী মানেই আমেরিকা।
তিনি ভাবছেন, পৃথিবী মানেই একটি পৃথিবী, তার বাইরে কিছু না।

কবি পরিচিতি:

সাসকিয়া হ্যামিলটন, আমেরিকার ওয়াশিংটন ডিসিতে জন্ম। নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করা এই কবির উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ— অ্যাজ ফর ড্রিম (২০০১), ডিভাইড দিজ (২০০৫), ক্যানেলঃ নিউ অ্যান্ড সিলেক্টেড পোয়েমস (২০০৫), করিডোর (২০১৪)। নিউ ইয়র্ক শহরে বসবাসকারী এই কবি তিনটি কলেজে অধ্যাপনা করা ছাড়াও লিটারারি ইমাজিনেশন নামে একটি জার্নালের সম্পাদক। শূন্য দশকের এই কবির কবিতা সম্পর্কে এই মুহূর্তেই বলা হচ্ছে, ‘এক নতুন ভাষার পৃথিবী’।

Facebook Comments

পছন্দের বই