লেখক নয় , লেখাই মূলধন

সুদীপ ব্যানার্জীর কবিতা

স্ক্র‍্যাপবুকে পাখি উড়ে এল


ঘুম পেত বলে বকতে তখন। এখন ঘুমোই নিজের ইচ্ছায়। দেখো কত অবসর এই সী-বিচে। সামনে স্রোত আছড়ে পড়ছে। জানি এখন জোয়ার নয়। না, ভাবনায় বিপদের ছিঁটেফোঁটাও নেই। একটা রঙিন ছাতা মাথার ওপর, চেয়ারে বসে কচি ডাবে চুমুক দিতে কী যে আরাম! তবে ঘুম নিয়ে আমার বড্ড লোভ। যেদিন ঘুম ভাঙবে না, সেদিন তোমার অভিযোগও আর শুনব না।


একটু আগে একটা নতুন পাখি দেখলাম। সত্যি বলতে, বলতে হয়, একটা পাখি দেখলাম। নতুন? আসলে আমি ঠিকঠিক পাখি চিনি না। চিনত যে, নামটা মনে না এলেও, মুখটা স্পষ্ট তার। বেশ বলতে পারত এটা মুনিয়া, ঐ দেখ ওটা বদ্রি, আরে এটা তো গুয়ে শালিক। কিন্তু আমি পারি না। পাপান কটা পাখি পুষেছে। রোজ খেতে দেয় ওদের, নামও দিয়েছে। আমি দেখি, কিন্তু ভাল লাগে না। বলেছিলাম ছেড়ে দিতে, উড়িয়ে দিতে। দেয়নি। কেঁদেছে। যাক্ গে। থাকুক। তো, ঐ যে একজন, পাখিদের চিনত, ও কিন্তু খাঁচায় পাখি পুষত না। একদিন হয়েছে কী, ওর পাশের বাড়ির মেয়েটা, যাকে দেখলেই ও নিজেই পাখি হয়ে যেত, আর এল না খেলার মাঠে। সেই থেকে খাঁচা কেনে যারা তাদের দেখলেই ও ক্ষেপে যায়।


সূর্যাস্ত হবে হবে। ছাদ থেকে দুটো ঘর পেরোলেই মেঘগুলোতে কেমন লাজুক রং ধরেছে। একটু দূরে ওখানটা এমন নীল, খাতায় কালি পড়েছে, ক্লাস টু, নিব পেনের। চেলপার্ক। অন্য ব্র‍্যান্ড কি? এখন আর এসব দেখি না। দশপাতা হাতের লেখা করা ছেলেটাকেও। হাত কাঁপে আজকাল লিখতে গেলেই। না, নার্ভের প্রবলেমটা অতটা নেই। কিন্তু, তাও। সাবধানি নিব পেন হারানোর পর আর মিথ্যে লিখতে ইচ্ছে করে না। পাপান কার্সিভে লিখছে, “আই লাভ মাই ফাদার।” অনেক ছোটো ছিলাম যখন আমিও এরকমই লিখতাম। বড়ো তাড়াতাড়ি সন্ধ্যে নেমে আসছে আজকাল। ছাদের দরজা বন্ধ করতে টর্চ জ্বালতে হবে দেখছি। অবশ্য মোবাইলটা অন করলেও চলে।


না এখনও আলো ফোটেনি। তা না ফুটুক, এই অল্প অচেনা,অস্পষ্ট প্রহর চপলতার কতোটুকুই বা টুকে রাখবে হাফ খোলা ডাইরিতে? ভোর হতে পারে জেনে সারা রাত ঘুমাতে পারি না— এ-বিষয়ে লিখিনি আগে। অথচ প্রস্তুতি ছিল না কি? জোরালো আলো কোনোদিনই সেভাবে রিয়েল ফিল আনতে পারেনি দিনের। এই পাথরের চৌকোনো ঘের, তার পাশে আরেকটা, তারপর আরও একটা প্যারালাল মহাবিশ্ব।তার ওপর আরও হাইরাইজ, স্কাই স্ক্র‍্যাপার। ক্রমশঃ দমবন্ধের একটা শহর নিজের ছায়া দেখে হাঁপাচ্ছে।


স্বপ্নের কপিরাইট থাকে না। দুঃস্বপ্নের থাকে কি? না থাক, তবু তার একটা রিকনস্ট্রাকশন থাকে। ভয় পেয়েছ বলছ, কিন্তু এরকম নিষ্পাপ একটা মিথ্যে তোমাকে ঘিরে ধরেছে বলেই তো ঘেঁয়ো সত্যিটা ব্যথা
দিচ্ছে না আর। জানো তো, এই ব্যথা একদিন তোমার মাথা থেকে শেষ স্নায়ুপ্রান্তটিকেও গিলে ফেলবে।তাও ঐ দুঃস্বপ্নকে ও-পড়াতে ব্যস্ত থাকবে তুমি। এ ব্যস্ততা মহান। এ ব্যস্ততাই বাঁচিয়ে রেখেছে আমাদের। নইলে নিঃশ্বাস নেওয়ার আর প্রয়োজন তো দেখি না।


আরেকটু আগে কার্ফু জারি করে গ্যাছে সিস্টেম। জবুথবু মোড়ে গুটি কয় ত্রিফলা ঘাড় কাত করে মেনে নিয়েছে এ ব্যবস্থা। নিবু নিবু তার আলো, নীচে একজন নাগরিকও বসে নেই। একটু আগে ‘ডেকামেরন’ দেখছিলাম। প্রতিষ্ঠান ভাঙছেন যেন, পাসোলিনি। তার আগে আরেকটু শুয়ে নিচ্ছে ওরা। টুকরো হওয়ার আগে মিরাকল কীভাবে বাঁচিয়ে দেয় ওদের, মরে যাওয়ার আগে কীভাবে বেঁচে থাকার লোভ ইম্মরালের হাতে স্নেহচুম্বন এঁকে দেয়— বয়ে চলে হাইড্রেন নদীর বিকল্পে, সে চ্যাপ্টার বাদ দিয়ে ধর্মগ্রন্থ পড়ি আমি আর ভয় পাই যাবতীয় মিথে। ইতিহাসে তার কে জানে কী রক্ত লেগে আছে শরম, বেশরমের। বিশ্বাসের ভেতরে আরেকটা বিশ্বাস, তার ভেতর আরেকটা। ডি.এন.এ তে সর্বনাশ চুপ মেরে বসে, সিস্টেম নিজেও জানে না। অথচ কার্ফুটা উৎসব ছিল না।


একটা হ্যাপি হলি ডে। নির্বান্ধব সকাল ঘুম ঘুম। অথচ ঘুমোনোর আগে হাজার মাইল অতিক্রম— নেহাত বিপ্লবের গান নয়। এ খেপে, নাইট জার্নিটাই প্রেফার করার কথা ছিল। কিন্তু ঐ যে মেটে রঙের রাস্তা, রাস্তা পেরিয়ে উঠোনের ছিঁটেবেড়া, শাড়ির খুঁটে হলুদ গন্ধ, দুদ্দাড় ঝাঁপিয়ে পড়া সাঁতার— ঠায় বসিয়ে রাখে ট্রেনের জানলায়। এসব গ্রামবাংলা, এসব রোজছবি— কবেকার, কোন গোপনে একবাটি স্নেহ ঢাকা রেখে বসে আছে, কবে থেকে— জানা নেই। জানা থাকে না। খালি বেলা বেড়ে এলে মাথাতে তেল মেখে ফেলে আসা গামছা কোমরে বেঁধে ঝাঁপ দিতে হয়।


পাপান একটা গাছ এঁকেছে। সুন্দর একটা গাছ। আচ্ছা, ছবিতে গাছটা এ্যাতো সুন্দর লাগছে কেন? আমি যে গাছ দেখেছি, সে এক গম্ভীর গাছ। সোজা উঠে গেছে আকাশে। দৃঢ়, ঋজু। ভরসার হাত বলতে গ্যালে অনেক ঝুরি, আকাশ থেকে মাটিতে নেমেছে। প্রশস্ত বুক, পাখিদের বাসা নিয়ে খুব একটা সুন্দর ছিল না গাছটা। পাপানের আঁকা ছবি দেখছি, পাশে মোমরঙ, ২ বি ৬বি পেন্সিল, ইরেজার, ওর মা, ক্যালেন্ডার। আমার গাছটায় ঘামের গন্ধ, দু-দিনের শুকনো রক্ত, হাঁপানিতে মৃত্যুর একটা ঘোরও ছিল। সুন্দরের আয়োজন ছিল না।


একটা পিংক চাঁদ আশকারায় তিনতলার ছাদ চেয়ে নিলে, স্বাভাবিক, গম্ভীর হবে বাকী আকাশ। ভালোমানুষিও তাই চোরাবালি। টেনে নিতে নিতে একটা স্তরের স্নেহ, পরের স্তরের দুর্ভাবনাকে নিজের করে ভুলের পর ভুল করে যাচ্ছে— এ দেখে হেসেছ তুমি, তোমার স্বাতী নক্ষত্রও। হাত ছেড়েছে বন্ধুসকাল আর অপমানের দমকা হাওয়া স্বস্তি দেয়নি চিরকাল বন্ধ্যা, আনপ্রোডাক্টিভ ক্ষমাগুলোকে। কে যেন বলছিল— বৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল সেদিন।

১০
মাটির ভেজা গন্ধ রোমান্টিসিজম। তবে সেভাবে আর ভিজিয়ে দিতে পারে না এখন। পাপানকে বলছিলাম, কাদামাঠে ফুটবল খেলার দৃশ্যগুলো। দৃশ্যই। ঐ তো পাস দিচ্ছে রাহুল, বল আটকে গেছে জলে, গুবলু আর আমি বল ছেড়ে জলে লাথি মারছি। কাদা মাখছি। ঘোলাটে হচ্ছে দেখাটা। আয়নায় আমার মুখ। বাষ্প জমেছে বাথরুমে। গিজার অফ করে নিজের মুখের দিকে তাকাচ্ছি। কাদা সরে সরে যাচ্ছে।এককোণে সাদা দাড়ি। সময়ের অনস্লট। দাপানোর চিহ্ন। আমাদের খেলাগুলো বাথরুমের নালা বেয়ে হারিয়ে গেছে কবে, দেখিনি। ফিরে তাকানোর চ্যাপ্টারটা মরা নদীর সাথে শুকিয়েছে একরাতে।

১১
তবে তিনি এসেছিলেন। একান্ত অনুরোধের চেয়েও গোপনে। অথচ সে সুযোগে একটাও বাড়তি অপশন
ছিল না। তিরতির করে বয়ে যাওয়া অপেক্ষায় শেষ অব্দি না থাকলেও একটা সাঁকো রেখে এসে তাকে বলেছিলাম, “এই নাও তোমার রাস্তা। এই নাও তোমার সাহস। ” উপন্যাসের শেষ পাতায় এখনও গোঁজা অশোকফুলের লাল।

১২
তারপর থেকে কথা সব জমে আছে আইস-ট্রেতে। সুরক্ষিত। ২০টা গ্রীষ্ম চলে গেল। আরও জমাট বাঁধছে বোবা চাঁইয়ের কিউবগুলো।

Facebook Comments

পছন্দের বই