লেখক নয় , লেখাই মূলধন

সুপ্রিয় মিত্রের কবিতা

ভুতুড়ে গাছ ও দু’শালিখ

সে’ দেখলে কেউই একা থাকতে পারে না।
একচোখ বন্ধ ক’রে এক শালিখ দেখে দিন কাটে। দু’চোখ খুললে দেখি— রাস্তায় পাগল নেই ব’লে রাস্তা পাগল হয়ে গেছে।
তাকে সামলাতে নেমেছে আলাভোলা ট্রাফিক পুলিশ। গাড়ি থামাতে গিয়ে অন্যজনের টা-টা-তে ঢুকে পড়ছেন।
এ বড়ো সংশয়ের কথা…
শেষ ভাড়াটে ফেলে গেছল জুতো। একপাটি
কুকুরে নিয়ে গেছে। সেই থেকে পরিত্যক্ত বাড়ি…
এভাবেও দু’ শালিখ দেখি।

দেখলে প’রে কেউই একা নয়।
আমাকে সঙ্গ দেয় ছোটোবেলার মৃত শিউলি গাছ।
ভুলবশত ভুলচুকের কাছে মাইক্রোফোন স্ট্যান্ডের ভেতর কখনও তার আত্মা ঢুকে পড়ে। কখনও চলন্ত ট্রেনে ঠেস দেওয়া দেওয়ালের মাঝে
সে আমার পিঠ ধরে রাখে।
প্রকৃতির অপমানে গাছ থেকে ফুল ঝ’রে পড়ে।
ভুতুড়ে গাছের নীচে ফুল কেউ কখনও তোলে না।
গাছের রুমাল ওই মেঝে-মাটি। ভাঁজ করাও যায় না কিছুতেই।

বিধিসম্মত সতর্কীকরণ

লেখা নেই

অক্ষত সিগারেটের সাদা ফিল্টার দেখে ভেবেছে
রবার। আগুন ধরালে পেন্সিল সূচাগ্র হবে।
ধোঁয়ার কালিতে তার
কত কত উঁচুনীচু লাইন টানা হয়ে
কুয়াশায় মিশে যেতে দেখা গেছে, ইয়ত্তা নেই।

দূর থেকে তুলসীমঞ্চ দেখে মা ভেবেছে দোয়াত।
হাওয়ার কাগজে
তিনবেলা তাঁকে ধূপের ধোঁয়ায় লিখতে পড়তে
দেখা গেছে—
চাকরি, চাকরি, একটা হিল্লে করে দাও।

কিন্তু উনি কোত্থাও নেই।
এমনকী ধূপের প্যাকেটে নেই কোনো ফুসফুসের ছবি।

ম্যাপ

কোনো অকারণ রহস্যে চারদিক ঝিম হয়ে আছে…

শোভাবাজারের গলিতে যে মেয়ে তাকিয়ে হাসছে,
সেই হাসি নন্দনের বইঘরে দাঁড় করিয়ে দিলে
মনে হবে ভালোবাসা ধুয়ে যাচ্ছে ভালো অপেক্ষায়…

পাশে, ভিখিরির ছেলেটির হাত দুটো কাটা
পয়সা ঝাঁকানোর তালিম তাকে তার বাপ দিতে পারেনি।
যেহেতু তার মৈথুনও নেই,
তাকে এক অর্থে বালক ব্রহ্মচারী ডাকতে ইচ্ছে হয়।
ইচ্ছে হয় সন্ন্যাসী বলি, ডাকি পরিব্রাজক।

ময়লা হয়ে যাওয়া প্যান্টে ফুটে উঠেছে
উথলে ওঠা কৈশোরের ছোপ। দূর থেকে দেখতে যেন ম্যাপ।
মেয়েটি আড়চোখে চেয়ে খুঁজে নিচ্ছে কলকাতা?
কত দূরে বর্ডার? বাংলাদেশ?

চলে যাব

গাছের তলায় পাতা জমে আছে হেমন্তের।
আমার মনখারাপের অনুঘটনে তারা আরেকটু তাড়াতাড়ি
পচে গিয়ে মিশে যেতে পারে, প্রায়ই মনে হয়।
তারপর পরোক্ষভাবে গাছ নিজেকেই ভক্ষণ করে।
আমিও তো তোমাদের ভালোবাসি।
জন্ম দেব ব’লে বারবার ভক্ষণ করি।

মনখারাপের ভেতর একটা দুপুর শুধু ক্রিকেট ক্রিকেট।
ব্যাটের গুমোট জায়গায় লেগে সবুজ বল ছিটকে হারিয়ে গেছে সবুজতর ঝোপে।
খেলোয়াড়রা ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে।

মনখারাপের ওপর একটা রাত।
স্বপ্নের ভেতর মৃত বন্ধু ঝোপ থেকে বেরিয়ে এসে বলে—
‘চলে আয়… কতদিন ক্রিকেট খেলিনি!’

দিকভুল

রাস্তার কোনও অন্ধকারই বলছে না—
কখন ভিখারি-ভিখারিনী রাতের সঙ্গেও গাঢ় হয়।

প্রসঙ্গত, দিকভুল ক’রে তাদের সন্তান পেট চিরে বেরিয়ে পড়েছে।

রাস্তা পিচের হলে ব্ল্যাকবোর্ড,
ইট ভাঙলে চক তার আবিষ্কার।
খবরকাগজে যা লেখা তা বাংলা, ইংরেজি বা হায়ারোগ্লিফিক, যা খুশি।

হাঁড়ির পাছা ঘষলে কত যে কালো কালি
দু’হাতে নিয়ে দেওয়ালে লেপ্টে দেওয়া যায়… বইয়ের প্রচ্ছদ।

তারপর ক্লান্তি

দিকভুল ক’রে কত কবিতা যে আসে নিরক্ষর হাতে। কে জানে…
না পারে ফিরতে, বেরোতেও পারে না।

শাক

রোজ রোজ মেলা হ’লে মেলাকে বাজার মনে হতো।
উৎসবের ভেতরে আছে কোনও যন্ত্রণার মাছ
যাকে ঢেকে রাখতে হয়।

‘কেন এত কথা কমে গেছে?’
এই নিয়ে সেদিন কত কথা হল আমাদের…

ঠান্ডা লাগিয়ো

চোখ ছিল কোথাও আর
তার দেখা ছিল আরও কোথাও দূর

এমন কোনও কণা পৃথিবীর কি নেই যে তার একা থাকা ছুঁয়ে দিতে পারে?
ভাবি, এও হয়…
কোনো নৈঃশব্দ্যও নেই যে মধ্যস্থতা করে
তার নেগেটিভ আলোয়


মধ্যস্থতা করে
ছুঁয়ে দিয়ে চলে যেতে পারে,
দূরে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক
যার মগ্নতাকে পরিচ্ছন্ন করে, অথচ
মশা এসে তাকে অবিন্যস্ত করে কিছুক্ষণ
ভুরুর পাহাড় থেকে ওই চোখ নেমে আসতে পারে,
সরে আসতে পারে দেখা থেকে।
এ-সমস্ত পারে—
তবু কোনও মানুষের মুখ তাকে ফেরাতে পারে না।


আমারও মুখ তেমন শ্রী নয় যে
উপহারের বাক্স কোনো,
ফিতে খুললে আত্মা এসে দাঁড়াবে খালি গায়…

— এই ভেবে, কতজন দূরে সরে গেছে
গেছে শ্মশানের নিরীহ আগুনে

সরে যাওয়ার সে-রাস্তা দেখি
আমারও চোখ সেদিকে এখন চেয়ে থাকে
দেখা থাকে আরও কোথাও দূর

যে-রাস্তার শুরু কোনও দরজা থেকে নয়।


দরজা থেকে নয়, কোনও জানলা দিয়ে নয়
তাকে বোঝাও। তাকে বলো
‘চোখ কান খোলা রেখে যাতায়াত কোরো’
অভিজ্ঞ শিশুমুখে বলো—

ঠান্ডা লাগিয়ো
কোনোভাবে শেষ প্রশ্বাস এলে
যেন নাক বন্ধ হয়ে যায়।

কবি পরিচিতি:

সুপ্রিয় মিত্র মূলত রসায়নের ছাত্র, স্নাতকোত্তর। ২০১২-তে ‘উনিশ কুড়ি’ পত্রিকায় প্রথম তার কবিতা প্রকাশিত হয়। ২০১৬-তে প্রথম প্রকাশিত বই ‘ধরে নেওয়া যাক’ গদ্যপুস্তিকা। ওই বছরেই বেরোয় ‘এসেছ জন্ম পক্ষী দোহাই’ কাব্যপুস্তিকা।

Facebook Comments

পছন্দের বই