লেখক নয় , লেখাই মূলধন

সুমন সাধুর গুচ্ছকবিতা

একলা চলার মন্ত্র

৫ ডিসেম্বর

একটা দমকা হাওয়া বেশ চমকাচ্ছে কয়েকদিন ধরে। ধরো, সে তোমার হাত ধরবে। কাঁধে হাত রেখে বলবে মদ খাওয়া যাক? তারপর রাতে সারা বিছানাময় উত্তাপ দেবে। আর এই শীতের হাওয়া জানান দেবে ক্যাম্প ফায়ারের আরেক অর্থ ডিটেনশন ক্যাম্প। আমাদের আদর জল-বাতাসা পাবে?

৭ ডিসেম্বর

নাক থেকে নাভি অবধি পৌঁছে গেছে মাঝরাতের ওয়েস্টার্ন ব্লুজ। আর ঘর জুড়ে একটা ট্রাইপড, দুটো লেন্স আর ফুরিয়ে যাওয়া একখান ব্যাটারি। যেকোনো মুহূর্তে একটা ফ্রেম রচিত হবার সমস্ত উপকরণ তৈরি। এসবই আসলে বাইরের দেওয়াল। ভেঙে গেলেই সেই ইট, রড, পাথর। আজ কতজন ধর্ষিতা হলেন? কতজন কৃষক আত্মহত্যা করলেন? যারা তোমার আদর পায়নি তারা কি চোখের ভাষা বোঝে? জলের ভাষা? অনেক রাত হল। বাড়ি ফেরো। মা রান্না করে দেবে। মা কি এনআরসির ভাষা বোঝে? তাড়িয়ে দেওয়ার ভাষা?

১৫ ডিসেম্বর

বাস হঠাৎ ডানদিকে মোড় নিল। বাস বুঝি একা। কী ভীষণ। এই আমাদের মতোই। একটু পরেই সমুদ্র জ্যোৎস্না পেলে বুঝে যাব কে কার কাছে ঋণী। তারপর ঝগড়া সেরে ব্যস্ততা দেখাব বেশ। এদিকে রাতের ফোনে কেউ বলে ওঠে, ‘সাবধানে থাকিস। সময়টা ভালো না।’ এই দেশ এই ক্ষত নিয়ে আর কত দূর যাব মা? তোমাকে তো মায়ের মতো আদর করতে ইচ্ছা করে। স্নেহের মতো শুঁকতে ইচ্ছা করে। জন্মদাগ বড়ো অস্থির। ব্যথাটিও চিনচিনে। বন্ধুর শরীরে রাষ্ট্রদাগ— পালিও না, এখানেই থাকো। যতদিন একসাথে সেলাই করা যায় এই মরা মরা ব্যবস্থাগুলি।

১৮ ডিসেম্বর

তোমাকে তোমার নামে চেনা যায় না। আগুনে হাত দিলে মরিচীকাও গলে যায়। ঘাতক হায়নার মতো বারবার এই নিশ্বাসের কী দাপট! এই একার পথে সূর্য অস্ত যাবে এবার। ডুবে যাবার সময় হয়েছে। এই অদৃশ্য যাত্রাপথ ভরাট করবে দগদগে সেলাই আর অপমান। মদ খেতে বসা চোখের জল তার সমস্ত জলবায়ু শুষে নেবে। উপহার কেড়ে নেবে রাষ্ট্র। দুজনে পথে নামব। পথ চিনব। হারিয়ে গেলেও আগামী জন্মের অপেক্ষারা জ্বালা জুড়িয়ে নেবে। শ্যাওলায় পিছল খাওয়ার স্বভাব আমার জন্মগত। তাই এক হাতে তালি বাজানো থামবে না হে বৃদ্ধ শালিখ!

২৪ ডিসেম্বর

গ্লাসে গ্লাসে ফোয়ারা ছুটল হাসি আর উদ্বেগ নিয়ে। তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কিছু কম। নেশারা ডানা মেললে একঝাঁক পাখি খসে যাবে, মুহূর্তে উড়ে পড়বে পালক। তাপমাত্রা আরও কিছু কমে আসবে নিশ্চিত। এরপর নিশ্চিন্ত আর সংশয়ের যৌথ কোলাজে বাড়ি ফিরে যাব দুজনে। রাস্তার সুখী জ্যোৎস্না খিলখিলিয়ে উঠে বলে দেবে এখানে মৃত্যু মানে ‘না’। অসুখ মানে অন্ধপ্রেম। বাড়ি পৌঁছেই জেনে যাচ্ছি স্বভাবমতোই কেউ কারোর প্রেমে পড়ছি না। অথচ ফাঁদগুলো পাতা থাকছে আগামীদিনের মতো।

২৮ ডিসেম্বর

সিনেমা বানানোর অছিলায় কেউ কাউকে ছেড়ে যেতে পারছি না। নির্নিমেষ নিরর্থক বোকামি করছি আমরা। আমরা সেই হাওয়ায় গা ভাসানো দুটি বস্তু। যারা চিরকাল শামুক গতিতে হাঁটতে চেয়েও বাধাপ্রাপ্ত হয়েছি। বাবা-মা ছাড়া আর কেউ নেই— সিদ্ধান্ত বারকয়েক ভাবাচ্ছে। চাপ-ফাপ খেয়ে অন্য কারোর দিকে ঢলে পড়ব ঠিক। তখন, নিঃশব্দই হবে যাত্রার একমাত্র অভিমুখ। সিনেমার মতো সিনেমা শুরু হবে সেইদিন। সেইদিন ডিটেনশন ক্যাম্পে গিয়ে বড়ো বড়ো করে লিখব, প্রতিটি হত্যা আসলে গুহার মতো অন্ধকার। ক্যামেরা জুম করে সেইসব দৃশ্য পৌঁছে যাবে দর্শকের কাছে। যারা তোমার মতো নিঃসহায় আর গুটিয়ে থাকা প্রজাপতির ডিম।

৩১ ডিসেম্বর

দুজনের মাথার উপর দিয়ে বছরের শেষ সূর্য অস্ত যাচ্ছে তার নিজস্ব স্বভাবে।

Facebook Comments

পছন্দের বই