লেখক নয় , লেখাই মূলধন

সোহম চক্রবর্তীর কবিতা

প্রেমের স্লোগান হবে

সারারাত জেগে থাকা মেয়েটির নখে
লিখে যাব প্রেমিকের কোঁকড়ানো চুল, কাটাকুটি খেলা—
হয়তো গানের খাতা এই ভিড়ে কিছু অগোছালো
তবুও ক্লান্তিহীন শরীরের শেষে
একফালি ভালোবাসা লিখে রেখে যাব।
যদি বা জানত কেউ, কেউ নাই জানে
গোপনে এসেছে আজও হাওয়া মৌসুমী,
হাতে হাতে দিয়ে গেছে প্রেমিকের বিজয়পতাকা—
সারারাত জেগে থাকা টেবিলের আলো
জানে শুধু, এ শতক বয়ে গেছে জমাখরচের দায়ে…
সেইসব লিখে যাব, লিখে যাব যত যত ভাঙা পথঘাট
কাল ঠিক ভেসে যাবে হাতে-হাত বিজয়মিছিলে,
প্রেমের স্লোগান হবে আমাদের বাংলা কবিতা।

প্রেম-কে

শিয়ালের দীর্ঘশ্বাসে দুলে ওঠে আঙুরের থোকা,
শিকেটির দিকে চেয়ে দিন গোনে উদাসী বিড়াল…
আমি তো রাখাল ছেলে, মনে মনে ভাবি—
একবার ঝাঁপিয়ে পড়ো, হে নেকড়েবাঘ!

পঁচিশে বৈশাখ

বাবা ও আমার মাঝখানে বসে
গান গাইছেন জর্জ বিশ্বাস।

আশির দশকে বাবার কলেজ,
আশির দশকে বাবা আমার মতো বড়ো;

গান গাইছেন জর্জ বিশ্বাস –

এপার থেকে বাইশ বছরের আমি

দেখতে পাচ্ছি, ওপার থেকে আশির দশকের বাবা
ঠায় দেখছেন পঁয়ত্রিশ বছর পরের আমায়;
কথা-কাটাকাটি হ’লে বলছেন, বুঝবি বুঝবি,
আরেকটু বয়স হোক…

গান গাইছেন জর্জ বিশ্বাস –

গান গাইছে বাবার কলেজ, গান গাইছে
একুশ শতক, আমার ওই না-হওয়া বয়েস
গান গাইছে; আমাদের কেটে যাওয়া কথা
ভেসে যাচ্ছে মুহুর্মুহু গানে…

আশির দশকের বাবা কি গেয়েছিল এমনই কোনও গান?
এমনই কোনও গান গাইতে গাইতে
আমারও কি কেটে যাবে আরও আরও পঁয়ত্রিশ বছর?
না-হওয়া ওই একটু বয়সের পর
আমিও কি খুঁজে পাব চিঠি? – ধুলো-ধুলো, ভুলে যাওয়া কতকাল…
অমন গানের গলা – সবটুকু গেছে, অমন লেখার হাত,
দিনে দিনে চ’লে গেছে তা-ও…

বাবা ও আমার মাঝখানে বসে
গান গাইছেন জর্জ বিশ্বাস;

মা পড়ছেন চিঠি – আমার জন্মের চেয়েও প্রাচীন, কোঁচকানো
সম্বোধনে লেখা ‘চিরসখা হে’… যেন কিছুই
ফুরিয়ে যায়নি, এই কথা তোমাকে বলতে গিয়েও মনে হয়, থাক্!

বাবা ও আমার মাঝখানে ব’সে
গান গায় পঁচিশে বৈশাখ।

দাহ

এবারে পালিয়ে গেলে ভুলে যাব কোথায় ছিলাম…
আদুল মাঠের শেষে, আকাশের পায়ের পাতায়
বিন্দু বিন্দু জ্বলে ওই ঘরদোর, আঙিনা-উঠান—
ঠিক যেন তারা হয়ে ফুটে আছে বামুনপাড়াটি…

গতকাল কারা এল— কারা এসে দাঁড়াল আঁধারে—
সেটুকুই মনে আছে, তারপর ত্রাহি চিৎকার…
সব ঘর তারা হয়ে জ্বলে ওঠে মাঠের কিনারে!

কথক গানের বোল ফেলে যায় ময়মনসিং-এ…

বিষ

দাঁতের নীচে বিষ রেখেছি, শিরার নীচে ঢেউ—
হিমশীতল জলের মতো ভিতর দিয়ে কেউ

হেঁটে যাচ্ছে, তুমি তো নও, তোমার অনুরূপ
একটি মেয়ে আমার বুকে এক্কেবারে চুপ

হেঁটে যাচ্ছে, তোমার মতো গলার কাছে তিল,
খুঁজলে পরে কত যে আরও অসাবধান মিল

বেরিয়ে যেত— সে-কথা থাক… হেঁটে যাচ্ছে—এই…
হিমশীতল জলের কুয়ো খুঁড়তে গেছি যেই,

অমনি সে কী স্রোতস্বিনী রক্তধারাপাতে
তারাবাজির আগুন হয়ে ছিটকে আসে হাতে!

আগুনে-জলে-রক্তপাতে এই যেটুকু স্নান,
দাঁতের নীচে সেটুকু বিষ রাখেন ভগবান।

সেটুকু বিষ উগড়ে দেব কী দংশনে, কাকে?
তোমার মতো একটি মেয়ে আমার বুকে থাকে…

তুমি তো নও, সেই মেয়েটি আমার বিষে নীল—
তোমার সাথে তার যে এই একটা গরমিল

রয়ে গিয়েছে— সেই বাঁচোয়া, বিষরক্তঘাম
শিরার জলে মিশিয়ে তাই কবিতা লিখলাম!

Facebook Comments

পছন্দের বই