লেখক নয় , লেখাই মূলধন

সৌমনা দাশগুপ্তর সিরিজ কবিতা

মেঘলাকলোনি


দূরত্ব বুঝিনি তাই কফির কাপের থেকে
টেবিলের সমকোণ থেকে বারবার সরে গেছি
ভুল ছিল! আমার রঙের চাষে ভুল ছিল

আমি হাঁটু জলে ডুব মারিলাম গো সাঁই, জল ছুঁইল না পরাণে। একশো আশি ডিগ্রিতে বেক করা এই কলিজা এক মালভূমি, শুধু ভাপ ওঠে, পুড়ে যায় সমূহ কুয়াশা। পতঝর কাকে বলে দিগন্ত! আমাদের মেঘলাকলোনিতে এ’সব শব্দের কোনো অর্থ নেই। আমাদের একটাই ঋতু। পাতা খসানোর দিনে আমি শুধু কেঁপে কেঁপে উঠি। উচ্চারণস্থান খুঁজতে খুঁজতে আমি তো হারিয়ে ফেলেছি সবকটা শব্দ। এখন দিন না রাত্রি, রাত্রি না দিন! আমার সর্ষেফুলের ক্ষেতে, আমার এই সূর্যমুখীর বনে কে যেন রগড় করে বারবার কুঁড়ি খেয়ে যায়। বুদ্বুদ মুছে গেলে জলে কী জীবন থাকে সাঁই


ভাসিয়ে দাও ভাসিয়ে দাও
ও তো আলোর গল্প জানে
ও তো উড়বে বলেই ফানুস

দু’দুটো বাস আমি ছেড়ে দিলাম দিগন্ত। বেকুবের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছি সেই লাল রং। এমনকী একটা ফাঁকা ট্যাক্সি হুস করে চলে গেল, আমি দেওয়ালের দিকে ঘুরিয়ে দিলাম সময়। সবিতারানি গেয়ে উঠলেন, কলসি রে তোর পায়ে ধরি, নিয়ে চল মোর বন্ধুর বাড়ি। এখানে শুধু গান হয়। এখানে ফাটা রেকর্ড থেকে পৌনঃপুনিক।এই তনহাইয়া এই বেতাবিয়া ঢেলে দিচ্ছে কোন পিরিতির নদীতে এক ইনসমনিয়াক, বিশুদ্ধ উন্মাদ! পিতলের কলসি কিমাঝেমাঝে কথা বলে নেয় জলের সঙ্গে!বন্ধুর বাড়ি আর কতদূর দিগন্ত?উত্তল অবতল কতগুলো লেন্স কে যেন আমার রাস্তার ভেতর ভরে দিয়েছে। এই মশকরা আমি আর নিতে পারছি না


তুমি কি তুমি কি তুমি কি
এই দিদারের পানে কথা বলো
এই চকিতের পানে

জল ঝরিয়ে ফেলার প্রকরণ আমি শিখে গেছি দিগন্ত। আর লোকায়ত যাপনের দিকে চলে গেল ঘুঘুপাখি। বয়ানের থেকে মিথ্যেটুকু মুছে দিতে দিতে এ কোন নিঝুয়া পাথারে এনে ফেলো হে সুর, হে ঈশ্বর আমার! যেন মাংসের দোকানের পাশে ইতস্তত পড়ে আছে একটা ভাওয়াইয়া গান, যেন ক্ল্যারিনেট ভেঙে ছড়িয়ে পড়ছে, যেন বিষণ্ণতার একপাশে লেগে যাচ্ছে ঠাট্টা। যেন অবিচুয়ারি লিখতে বসে, লিখে ফেলছ, খেউর খেমটার এক বিস্তৃত শিলালিপি


জল বলো মদ বলো
কিছুই থাকে না
কাঁচা ছিল, এই মাটি কাঁচা ছিল

বসন্তের হার্ডডিস্ক লিখি, লিখি গরাদ রঙের মেঘ। সলমা জরির এই আমন্ত্রণপত্র আমিই বা আর কতবার এড়িয়ে যাব! উৎসবের মরশুমে গুলাল মাখিয়ে দিতে দিতে সেই তিরন্দাজ আমাকেই শেষ অবধি নিশানা করে বসল, আর নিশানাই বা বলি কী করে, আমি নিজেই খুলে ধরেছি এই দ্রাক্ষাঋতু। চুম্বনের সাপেক্ষে নিয়োগ করে দিয়েছি লোধ্ররেণু আর প্রজাপতি। নির্দিষ্টকে এড়িয়ে যেতে গিয়েও বারবার দাঁড়িয়েছি আলপিনের নীচে, সূক্ষ্ম আঘাত বটে, সুরেলাও, তবু কলসগাছের খিদে, মাংসের গান থেকে আমিও তো সরতে পারিনি। আকাশ বলো আকাশ, মাটি বলো মাটি, আমি তো বারবার চারকোল দিয়েই ভরিয়ে ফেলেছি এই ক্যানভাস


তুমি কি কলিজা জানো
জানো কীভাবে মারুয়ার মদে
একদিন রক্ত এসে মিশে যায়

সবকিছু একদিন বেচে দেব মাইরি, এই চাষাবাদ, এই গোলাভরা রোদের বেসাতি, এই রতি-খেলা, সব একদিন ঠিক কিলোদরে বেচেবুচে দিয়ে সিপিয়া রঙের দিকে চলে যাব। আহ ভূর্জপত্র, এই ভেঙে যাওয়া গান, এই ভ্রষ্ট সাবার্ব থেকে পতনের যতটুকু ধ্বনি ভেসে আসে, তুমি কি লিখেছ তাকে, এই জরা, প্রমোদ, প্রমাদ! অসম্পূর্ণ মূর্তির পাশে আমি শুধু নিঃশ্বাস রেখে যেতে পারি। হাওয়া তো ছলনামাত্র, সে কেবল ইঙ্গিত দেয়, আসা আর যাওয়া। অথচ আমারও তো যাওয়ার কথাই শুধু আছে। প্রপেলারে সেটুকুই ঝড় লেখা হয়। বন্দর নগরী থেকে আমি তো এনেছি এই আকরের ধুন, মাটিমাখা ডানা। লোভ চিলে চোখ খেয়ে নেয়। এইবার চলে যাব, বিষাদের শ্যাওলা-সবুজ রং খুলে রেখে চলে যাব।আমি তো যেটুকু হাওয়া, তার সবটাই নিলামে তুলেছি।

Facebook Comments

পছন্দের বই