লেখক নয় , লেখাই মূলধন

সৌমাভের গুচ্ছকবিতা

হ্যারিকেন

বাড়ির প্ৰাচীন হ্যারিকেনটির নাম ছিল শিব,
সাদাসিদে গোলগাল শান্ত সমাহিত সৌষ্ঠব,
ঝুপ করে নেমে আসত সন্ধেবেলায় পড়ার ঘরে,
শিবঠাকুরের চারদিকে আমরা গোল হয়ে বসতাম,
বোজা চোখে সে তখন নির্বিকল্প সমাধি,
বাতি স্থির হয়ে থাকে নয়নের হলুদ অন্তর্দৃষ্টি হয়ে,
ধ্যান ভেঙে মাঝেমধ্যে মৃদু চোখে তাকিয়ে থাকে সহজ পাঠের দিকে,
বিকালে মা, জ্যেঠিমারা তার কাচের ভুঁড়িটিকে ঘসেঘসে চকচকে করে তুলত,
কেরোসিনের গন্ধে বুঁদ হয়ে থাকে সে,
আমরা ফুঁ দিই কলমের যে শিসগুলিতে কালি ফুরাত,
আগুনের স্পর্শে ছোটো ছোটো বেলুনে ভরে যায় ঘর,
বেলুনে চড়ে শূন্যে উড়ে যায় তাঁর কানের হলুদ কলকে ফুল…

কোনোকোনো দিন বাতি বাড়িয়ে দিয়েছি প্রবল
প্রবল তাপে ফেটেছে কাচের ফানুস, আঁধারে ও ধোঁয়ায় ভরে উঠছে ঘর,
নেমে আসে চাঁদ ও দেবী গঙ্গা শিবের মাথা থেকে,
চাঁদের ভেলায় চড়ে আমরা বেয়ে চলি তালবন, পারিজাত বন পেরিয়ে
আলোর অশোক ফুল আর নাম তার মোতিবিলের দেশে…
পৃথিবীর কোথাও নতুন একটা রূপকথার গল্প লেখা হয় আর দূরে কোথাও
রেডিও বেজে ওঠে— ‘আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে’

***

মুখ

উপন্যাসের মাঝখানে প্রিয় সেই পাতা,
সাদা পাতার ওই পারে শালবন, বনের কিনারে জল-নেই নদী,
দীর্ঘ দুপুরিয়া আলাপ পেরিয়ে কালো পাখিটি ধরেছে মনমর্জিয়া রাগ,
এখন পৃথিবীর সমস্ত রঙ হলুদ, আর সমস্ত হলুদ পর্ণমোচী,
এইসময় বাতাসকে মলয় বলে ডাকতে ইচ্ছে হয়…

তোমার মুখ উপন্যাসের প্রিয় সেই পাতা,
কতবার শেষ হয়েছে উপন্যাস তবু শেষ হয়নি ওই পাতা, শেষ হয়নি ওই মুখ,
মুখের শালবন, অনুচ্চ টিলাটির নীচে পাশ ফিরে শুয়ে থাকা নদী,
কাঁধে হাওয়া-মিঠাই নিয়ে মেলা ভাঙার পর এপারে আসছে মলয়কাকু,
দূর থেকে তার পরাজিত মুখকে দেখায় এক জল-নেই-নদী…

***

জ্যামিতি শেখার ক্লাস

কম্পাস, চাঁদা ও স্কেল নিয়ে শুরু হয়েছিল জ্যামিতি শেখার ক্লাস
তারপর বহুদিন আমাদের সম্পর্ক ছিল বৃত্ত, অর্ধবৃত্ত, ত্রিভুজ কিংবা চতুর্ভুজের মতন,
অনেক দিন হল কোনো দেখা নেই, যোগাযোগ নেই,
তবুও কোনো এক বৃষ্টি নামবে নামবে গোধূলির দিকে
স্টেশন কিংবা ব্রিজের তলায় দেখা হয়ে যায় কারো কারো সঙ্গে হঠাৎ,
আলতো চোখের ইশারা, হাতে নিতান্ত সামান্য স্পর্শ,
যেভাবে আঁকা শেষে স্কেলের দুপাশ ছুঁয়ে থাকতো পেন্সিলের তুচ্ছ দাগ,
বাড়িতে ফিরে স্কুলের জ্যামিতি শেখার খাতা খুলে দেখি
মুছে গেছে সব বৃত্ত, বর্গক্ষেত্র, সমকোণ, বিষমবাহু…
বন্ধুরা সকলে সমান্তরাল রেখা হয়ে শুয়ে আছে
সাদা খাতার উপরে এক মস্ত সাদা ইরেজার…

***

যে অভিমানে আছে

যে অভিমানে আছে তার কাছে এখন যেয়ো না
তার মন-শালুকের পাতার ওপরে জলের আয়না হয়ে থাকো,
শান্ত হয়ে বোসো গোধূলির পাশে কেননা তার মন এখন পাখি হয়ে ফিরছে কোথাও,
তার মনের ভিতরে এক বাজপড়া তালগাছ নিশ্চুপ, নিয়ে যাও তাকে জ্যোৎস্নার প্রান্তরে,
তার মন এখন এক গহন রাত্রি, তাকে শুধু উপস্থিতি দাও দূর টাওয়ারের লাল আলোর মতো,
যদি তার মন ফুল হয়ে থাকে, তুমি তার ঝুঁকে থাকাটির নীচে মাটি হয়ে থাকো…

তারপর এক ‘ঘর ভরা শূন্যতার রাতে’ সমস্ত অভিমান জমে জমে হবে এক মাটির কলসি,
না জেনে ঘরে ঢুকতে গিয়ে তোমার পায়ে লেগে ভাঙবে শীতল মৃৎপাত্র, গোটা ঘরময় জল,
জল উঠে আসবে কোমর বেয়ে, বুক বেয়ে… গলা চোখ মুখ বেয়ে,
একে অপরের নিঃশ্বাসকে মনে হবে পৃথিবীর কঠিনতন অথচ সুমধুর এক আলাপ
যাকে উপরে নীচে ডাইনে বামে শূন্যে পূর্ণতায় সমস্ত অস্থিরতায় বাজানো যায়…
গলায় ফাঁস লাগিয়ে কী শান্তি কী আগুন কী সবুজ বেঁচে উঠতে চাইছো দুজন!

***

শরীর-বিষয়ক

কাল যে শরীর ছিল বৈশাখীর আজ তা আমি মালতিকে দিয়ে এসেছি,
শরীর বিষয়ে আমি এতটাই সৎ যে
যখন জোৎস্নাকে শরীর দিই মনে পড়ে না চাঁদের কথা
মেঘকে যখন শরীর দিই মনে পড়ে না আকাশের কথা
সূর্যাস্ত কে যখন দিই মনে পড়ে না গোধূলির কথা
পলাশ শিমুলকে শরীর দেওয়ার সময় মনে পড়ে না বসন্তের কথা
পাথরের সঙ্গে সঙ্গমকালে মনে পড়ে না পাহাড়ের কথা
ঢেউকে শরীর দিলেও মনে আসে না সমুদ্রের কথা
পাতাকে শরীর দিই যখন মনে পড়ে না গাছের কথা, এমনকি
শরীরকে শরীর দেওয়ার সময় মনে পড়ে না ছায়ার কথা
তবে,
প্রতিবার জ্যোৎস্না, মেঘ, সূর্যাস্ত, শিমুল, পলাশ,পাথর, ঢেউ, পাতা ও শরীরকে
শরীর দিয়ে আসার পর পৃথিবীর নিরপেক্ষতম প্রান্তর থেকে আমার মনকে
দেখায় চাঁদ, আকাশ, গোধূলি, বসন্ত, পাহাড়, সমুদ্র, গাছ অথবা ছায়ার মতো

***

সাপ

ফুলের গন্ধ শুঁকতে এসেছে অভুক্ত যে সাপ মেরো না তাকে,
অন্ধকারে, কী অপরূপ ওর জ্বলন্ত চোখ, যেন ঝড়বৃষ্টির রাতে
গল্প বলার ঠিক পূর্বমুহুর্তে ঠাকুরদার খাঁ খাঁ মাঠের মতন স্বপ্নালু দুই চোখ;
সে আসলে নিখোঁজ সীতাকে খুঁজতে বেরিয়ে নয়নাভিরাম সরোবরের
সৌন্দর্য দেখে দাঁড়িয়ে যাওয়া নিস্পলক, বিমূঢ় শ্রীরামচন্দ্র,
কিংবা দুদিন খেতে না পাওয়া অবহেলিত পরাজিত কবি,
হাজারবার কবিতা ছাড়ার শপথ নিয়েও সাদা পাতার গন্ধ কিংবা
মৃদু বৃষ্টির ভিতরে বাতাবিফুলের গন্ধে মন্ত্রমুগ্ধ, স্থবির এক মহাপ্রাণ।

***

সম্পর্ক

ঘুমিয়ে থাকা কুকুরের ছায়া দেখে মায়া এসেছিল,
আমি মায়াকে বাড়ি নিয়ে এসেছি

যত নিরাময় বাড়ে তত বেশি ক্ষয়,

কুকুরের আত্মাটি ফিরে গেছে,
আত্মার কুকুরটি রয়ে গেছে কাছে,
সে ছায়াও নয়, সে মায়াও নয়…

Facebook Comments

পছন্দের বই