লেখক নয় , লেখাই মূলধন

সৌমাল্য গরাই-এর গুচ্ছকবিতা

আকাশ

নিঃসঙ্গ বৃদ্ধের মতো বসেছেন একা
এত বিষ নীলে নীল সমগ্র শরীর
অথচ উজ্জ্বল চোখ দশদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে
পাগল মানুষ যেন শূন্য থেকে শুরু করে
ফেলে যাওয়া কার, সিঁথির সূর্যাস্তটুকু আজীবন জড়িয়ে রেখেছে

***

সঙ্গমকালীন

সারারাত আলোড়ন শেষ হলে
ভোরের নিসর্গে শালুকেরা ফোটে
লাজুক হাওয়ায় কেউ চুপিসারে কাঁদে

ব্যথা তো মৈথুন খোঁজে চিরকাল
নিরন্তর সঙ্গমের পর, শরীরে কবিতা জেগে ওঠে

***

অসম্ভব

সামান্য ফাঁককে ফাঁকি ভেবে
ভেবো না সহজ
এ বেশ রহস্য নারী, আড়াল করেছ যত
যতই খুলেছ তাকে ভেতর ভেতর
যে পাখি পালাবে ভাবে
বুকে তার লাগানো পিঞ্জর…

***

রমণ

তুমি অই লুকানো কান্নার মেঘ। অদূরে দেখেছি দো ফসলি অনুর্বর বুকে অনার্য কিশোর শ্রীঅঙ্গে কর্ষণ করছে বীজ
শরীর পেয়েছ সেইদিন। সমগ্র জরায়ু বৃষ্টিতে মুখর। উন্মুক্ত স্তনের মধ্যে ছলোছলো দীঘি। নাইতে এল ফুলেরা,

কোনো এক উদাসীন কবির স্মরণে, দু’খানি হাতেই বেঁধেছ আখর। শব্দহীন যার, কোথাও কলম নেই,
তার বিষণ্ণতা বেঁধে রাখো চুলের কালোয়
চোখের নদীতে কী স্নান রেখেছ ! এমন মায়াবী তরলে ডুবে যায় মানুষ, ডুবে যায় আকাশ।

আবৃত শরীর খোলো তুমি, এ ব্যথা নামে না
আমাকে বমন করো চিরদিন, সম্পূর্ণ শরীরসুদ্ধ

***

লজ্জাপুরাণ

নির্জন চারাগাছ কার কথা বলো
অন্ধকারে কে অই মেয়েটি এল সন্ধে গায়ে
নীচু চিরাগের কাছে অশ্বত্থের ঝুলে থাকা দুঃখে
ফসলবিহীন মাঠের উপরে প্রতিবেশী চাঁদ
জ্যোৎস্নার কবর থেকে পাঠ করে মানুষ ও শিয়ালের ভয়ার্ত কাঁদুনি

চিরুনি হারালো যার নিয়মিত সোজা পথ
তুমি কী শোনোনি সেইসব বেহুলার ভাঙা ঘুঙুরের নাচ
ভেঙে ভেঙে তৈরী হয়, নিকানো অভাব,উনুনের আঁচ
মড়কের করোটির ভেতর পড়ে আছে খুলি ও কঙ্কাল
কী দিয়ে বানাব দেহ, ফুল, মাটি, শ্রমের পুতুল
এসো, কে ওই মেয়েটি কালো, এসো আরও বুকের গভীরে,
দু পা দাও, দাও দিব্যচক্ষু, অলৌকিক ঋজু মেরুদণ্ড বিদ্যুতে কাঁপাক
অবনত নিষ্ঠুর লজ্জায় আমাদের জিহ্বাগুলি একে একে খসে যাক

***

জল

ভেসে থাকা প্রকৃত কঠিন
প্রতিদিন বিশুদ্ধ নৌকায়
যায় যারা, ঠেলে ঠেলে উঁচু নীচু জল
প্রবল দাঁড়ের ক্ষত, কবে কার ব্যথা কোথায় নামিয়ে
হারিয়ে এলাম নীল বিষ, সময়ের অধিক সময়

নিথর প্রস্থানে—
জানে শুধু চোখ বিঁধে থাকে সূঁচালো তরল
সহজে পেরোনো যায় না যা, আসলে তা জল

***

সানাই

সংশয় রাখিনি কোনো, মুছে নেওয়া জলে
পরিস্রুত দাগ, যেন শরীর বল্কলে
দু-হাতে কুড়োয় পাতা, অর্ধনিমীলিত বনে

মুগ্ধ ময়ূরীর স্নান শেষে এই
ত্রিভঙ্গ ছলাচ্ছলের সম্মুখে জানাই
অরণ্য বিধুর তোর মনে পড়াটুকু , বিবাহ সানাই

***

গর্ভিনী

জলের অতলে থাকে শাপলা রঙের মেয়েটি— যেন কালো রঙের একটা ঘরে, অন্ধকারের সাথে তার বসবাস

অন্ধকার চিরকাল বড় একা— আলো নেই কোনওদিন। দীঘির ভিতর নাগকন্যা ফুল তুলে আনতে গিয়েছিল মেয়ে। রক্তজবা পায়ে, রোদ্দুরের আলতা মেখে ঘাটে পা দিতেই, অপূর্ব একটা দুয়ার খুলে গেল

জগতের বিশাল দুয়ার— যেন একটা পদ্মযোনি মা হতে পেল। গর্ভ দিল মেয়েটি।চিরকালীন যে অন্ধকার সে পেল নতুন মা,
ঠিক তখনি একটা প্রজাপতি উড়ে বসলো লাজুক নোলকে

দীঘির জল সেই প্রথম প্রসব বেদনা অনুভব করল। শালুক ফুটল চারদিকে।
ভোর এল, সন্তানের মতো…

Facebook Comments

পছন্দের বই