লেখক নয় , লেখাই মূলধন

কবি জয় হার্জোর সাক্ষাৎকার

ভাষান্তর: ঋতো আহমেদ

[জয় হার্জো দ্বিতীয়বারের মতো আমেরিকার পোয়েট লরিয়েট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন এ বছর (২০২০)। তিনি একজন নেটিভ আমেরিকান কবি। জন্মগ্রহণ করেছেন ৯ই মে, ১৯৫১ সালে ওকলাহোমার তুলসায়। পড়াশুনা করেছেন ইন্সটিটিউটস অব আমেরিকান ইন্ডিয়ান আর্টস (১৯৬৮), নিউ মেক্সিকো বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৭৬) এবং আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৯৭৮)। একাধারে তিনি কবি ও সংগীতশিল্পী। প্রকাশিত অ্যালবামগুলির মধ্যে রয়েছে “রেড ড্রিমস”, “এ ট্রায়াল বিয়ন্ড টিয়ারস” ইত্যাদি। তাঁর উল্লেখযোগ্য কবিতার বইগুলোর মধ্যে “কনফ্লিক্ট রিসলিউশন ফর হোলি বিয়িংস”, “অ্যান আমেরিকান সানরাইজ”, “হাউ উই বিকাম হিউমেন” অন্যতম। তিনি রুথ লিলি প্রাইজ, ওয়ালেস স্টিভেন্স এওয়ার্ড, পেন ইউএসএ লিটারেরি এওয়ার্ড-সহ বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। হার্জো আমেরিকান কবিদের একাডেমির একজন চ্যান্সেলর এবং নেটিভ আর্টস অ্যান্ড কালচার্স ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা বোর্ডের সদস্য। তিনি ওকলাহোমার তুলসায় থাকেন, যেখানে তিনি তুলসা আর্টিস্ট ফেলো।

আসুন, এই কবির একটি সাক্ষাৎকার পড়ি আজ। ২০১৯ সালের ৩০শে জানুয়ারি ছোটো, কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন জেন শ্যাপল্যান্ড।]

জেন শ্যাপল্যান্ড: আপনি যখন নিউ মেক্সিকোতে ছিলেন তখনকার সেই সময়টা আপনার কাজকে কীভাবে প্রভাবিত করেছিল? আপনি কি নিজেকে কিছুটা হলেও নিউ মেক্সিকোর লেখক মনে করেন?

জয় হার্জো: আংশিকভাবে, হ্যাঁ, এখনও আমি নিজেকে নিউ মেক্সিকোর লেখক মনে করি। আমার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় এটি। পরিকল্পনা আছে সেখানে সামান্য আশ্রয় গড়ে মাঝেমাঝে সময় কাটানোর। আমার ছেলেমেয়েরা তাদের পরিবার-সহ ওখানেই আছে। আমার অধিকাংশ নাতি-নাতনিরাও ওখানে। অনেক আগে, ষাটের দশকের শেষ দিকে আমি সান্তা ফে-র ইন্সটিটিউট অব আমেরিকান ইন্ডিয়ন আর্টস-এ ছাত্র হিসেবে যোগ দিই। সমসাময়িক দেশীয় শিল্প পুনর্জাগরণের সময় আমি সেখানে ছিলাম যা শিল্প জগতের সমস্ত কিছুর পরিবর্তন করে। আইএআইএ-তে থাকার এক উত্তেজনাপূর্ণ সময় ছিল সেটা। এমনকী আমরা উচ্চবিদ্যালয়ের তরুণ ছাত্ররা জানতাম যে, আমরা ইন্ডিয়ান দেশীয় রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনার গুরুত্বপূর্ণ এক সময়ের মাঝামাঝি রয়েছি। আমরা এক দারুণ প্রগতিশীল প্রজন্মের অংশ ছিলাম। সার্বোভৌমত্ব কথাটি আমাদের মুখে আওড়াতে আওড়াতে সাধারণ হয়ে যাওয়ার অনেক আগে তখন আমরা সংস্কৃতির সার্বোভৌমত্ব নিয়ে ভাবতাম। আমার আঁকা ছবিগুলোর ভিত্তিতে আমাকে সেখানে ভর্তি করা হয়েছিল। আমি কোনো লেখার ক্লাস করিনি কিংবা লেখক হওয়ার চিন্তাও করিনি তখন। কেবল গান লিখতাম।

আমি হাই স্কুল থেকে স্নাতক শেষ করে ওকলাহোমা ফিরে আসি, একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিই, এবং এরপর শৈল্পিক সম্ভাবনার জীবন ফিরে পেতে নিউ মেক্সিকো ফিরে যাই। সেরিলোস রোডের মিনি স্কার্টে গ্যাস পাম্প করা, নার্সিং সহায়ক হয়ে ওঠার জন্য কাজ এবং প্যালেস অ্যাভিনিউয়ের পুরোনো সেন্ট ভিনসেন্টের হাসপাতালে শিফট করা-সহ আমি সান্তা ফে-তে বেশ কয়েকটি চাকরি করেছি। আমি নিউ মেক্সিকো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রি-মেড মেজর হিসাবে ভর্তি হয়েছিলাম এবং দ্বিতীয় সেমিস্টারের পর আর্ট স্টুডিওতে ফিরে আসি।

স্টুডিও আর্ট মেজর হিসাবে আমার দ্বিতীয় বছর নাগাদ হঠাৎ আবিষ্কারের মতো কবিতাকে পেয়ে যাই আমি। বলতে পারেন, সর্বদাই কবিতার প্রেমে ছিলাম আমি এবং নেটিভ সাহিত্যের কথাটি বলার পরে যেমনটি বলা হয় ঠিক তেমনই “সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায়” থাকতে হয়েছিল আমাকে। তখন “আমেরিকান ইন্ডিয়ান সাহিত্যের পুনর্জাগরণ” শুরু হয়েছিল। এন স্কট মোমাদে, লেসলি সিলকো, জেমস ওয়েলচ এবং সাইমন অর্টিজ-রাই ছিলেন এর মাধ্যমণি। আলবুকার্কের লিভিং ব্যাচের বইয়ের দোকানে এই কবিদের অনেকের আতিথ্য ছিল এবং নিউ মেক্সিকো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংলিশ বিভাগের একটি সক্রিয় সিরিজও ছিল। আমি সেখানে আই, অ্যান ওয়াল্ডম্যান, গালওয়ে কিন্নেল-সহ আরও অনেককে শুনেছি। কিভা ক্লাব আর নেটিভ স্টুডেন্ট ক্লাবের সদস্য ছিলাম আমি। এগুলো তখন আদিবাসী শিক্ষার্থীদের জন্য একটি সামাজিক ক্লাব হিসাবে শুরু হয়েছিল এবং স্থানীয় অধিকারের জন্য রাজনৈতিক পদক্ষেপের কেন্দ্র হিসাবে পরিণত হয়েছিল।

আর, হ্যাঁ, বুঝতে পারছিলাম কবিতা হচ্ছে অন্তর্গত ক্ষত পরিষ্কার আর নিরাময়ের জন্য এক-ধরনের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে।

এই সবকিছু আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। আমি কবিতা লিখতে শুরু করি কারণ, এটি আমাদের স্থানীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে কী ঘটছে তা ব্যক্ত করার একটি উপায়ও ছিল। আমি প্রায়শই স্যান্ডিয়া পর্বতমালার ছবি তুলতাম আর ছবি আঁকতাম, আর আমার জিন্সের পকেটে জেমেজ পর্বতমালার একটি চিত্র নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম সবসময়। একবার যখন বার্নালিলো থেকে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলাম, দেখলাম নীল আকাশে লালের অদ্ভুত সুন্দর বেঁকে যাওয়া। অসম্ভব ভালো লেগেছিল আমার। পাহাড়গুলি ছিল নীলাভ কল্পনার দ্বার। আজও ঠিক তেমনই আছে— নিউ মেক্সিকো আমাকে অন্য যেকোনও জায়গার চেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করে। আমি একে আমার কবিতার জন্মস্থান হিসাবে বিবেচনা করি, যদিও অবশ্যই আমার কবিতা আমার পূর্বসূরি সমস্ত বক্তা, গায়ক এবং শিল্পীদের মাধ্যমে প্রজন্ম ধরে প্রবর্তিত হয়েছিল। উপজাতি প্রধান আর চিত্রশিল্পী থেকে শুরু করে বারান্দার গিটারিস্ট পর্যন্ত— অনেকেই রয়েছেন এর মধ্যে।

জেন শ্যাপল্যান্ড: আজকালকার দুনিয়ায় কবিতার ভূমিকা আসলে কী? কবিতা কেন লেখেন আপনি?

জয় হার্জো: আমি বিশ্বাস করি কবিতার ভূমিকা যা আছে তা সবসময়ই ছিল: কেন-না, এই পৃথিবীর জীবনকে যাপন করতে গিয়ে আমাদের হৃদয় তো প্রায়শই ভেঙে যায়, আর, কবিতার মাধ্যমে আমরা তা আবারও একত্রিত করতে পারি। কবিতা হচ্ছে সংগীতের সবচেয়ে কাছের শিল্পমাধ্যম। এটি বক্তব্যকে ছড়িয়ে দেয়। শোক, পরমানন্দ, উদযাপন, হতাশা বা আনন্দ-কে বহন করতে পারে। ক্ষত পরিষ্কার এবং নিরাময় করবার জন্য হাতিয়ার হিসেবেও কাজ করে। ভবিষ্যদ্বাণী করে: কীভাবে জানব আমরা আমাদের মধ্যে কে রয়েছে প্রজন্মের ব্যবধানে এগিয়ে। কবিতা ছাড়া, আমরা আসলে মানুষ নই।

আমি কবিতা লিখি কারণ, এটি এক-ধরনের অন্তর্গত আহ্বান, যা আমি নিজে থেকে বেছে নিইনি। অন্য একটি শিল্প-পথে ছিলাম প্রথমে। পেইন্টিং এবং ফটোগ্রাফিতে আমার আগ্রহ ছিল। কবিতা আমার কাছে ধরা দেয় সংগীতের মাধ্যমে। জীবনের শুরুর দিকের আমার প্রথম বছরগুলিকে আমার মায়ের গান-রচনা এবং কবিতার প্রেম দিয়ে চিহ্নিত করতে পারি। হ্যাঁ, কবিতা আমি পছন্দ করতাম ঠিকই, কিন্তু কবি হওয়ার কোনো ইচ্ছে তখনও ছিল না। তারপর, একসময় যেন কবিতা আমার উপর অবতীর্ণ হল আর যেন বলতে লাগল তাকে আগলে রাখতে। এমনই মনে হয়েছিল আমার। আর আজ, কবিতা আমার সবচেয়ে দাবিদার শিক্ষক হয়ে উঠেছে, নিজেকে সম্মানিত বোধ করি আমি— কবিতায় এবং সংগীতে।

জেন শ্যাপল্যান্ড: আপনার কবিতাগুলি প্রায়শই অন্যের জন্য এবং নিজের জন্যও মমত্ববোধের একটি মৌলিক রূপ হিসেবে প্রকাশ পায়। আপনার কাজের প্রতি সহানুভূতির ভূমিকা সম্পর্কে আমাকে কিছু বলুন।

জয় হার্জো: সহানুভূতি হল মাতৃভূমি, আমাদের প্রস্থান আর প্রত্যাবর্তন স্থল। সহানুভূতি এক ধ্রুব শিক্ষক, যখনই আমরা উদ্যোগী হই, আমাদের শুধরে দেয় সে। চুরি হওয়া জমিতে আদিবাসী হওয়ার ফলে নেটিভ এবং অ-নেটিভদের জন্য জীবনের সমস্ত দিককে প্রভাবিত করে, কারণ এটি এখানকার নাগরিক হওয়ার অর্থ এবং ভিত্তি গঠন করে। কবিতা আমার শিক্ষক। যখন আমি ডুবে যাই এতে, তখন এটি কবিতা, সংগীত বা যে-কোনো শিল্পের অর্থ উন্মুক্ত করে তাতে নৈপুণ্য এবং অনুপ্রেরণার মধ্য দিয়ে আমাকে পথ দেখায়। আমি বিশ্বাস করি পবিত্রতা আর অপবিত্রতার ভেতর দিয়ে বয়ে চলা আমাদের সমস্ত পথ, আমাদেরকে উন্মুক্ত করে সহমর্মীতায়। যদি অতীত জীবনের হয় তবে তারা অতীত নয়, তারা বর্তমান এবং ভবিষ্যতের। কেন-না, শেষ পর্যন্ত আমরা সবাই— সবাই হয়ে উঠব, পৃথিবীরে দিকে তাকাবো সমস্ত প্রাণীর চোখ দিয়ে। কেবল তখনই জানতে পারব আমদের প্রকৃত পরিচয়…

জেন শ্যাপল্যান্ড: আপনার টাচস্টোন কারা? উত্তর আমেরিকান কবিতার সমীক্ষায় আপনি কাকে অন্তর্ভুক্ত করবেন এবং কেন? আপনার ক্যানন কী?

জয় হার্জো: “মজার কথা জানতে চাইলেন”… আমি এক বছর ধরে নেটিভ অ্যান্টোলজির নেটিভ কবিতার উপর কাজ করে যাচ্ছি। (আমাদের কাজের এখনও কোনো শিরোনাম নেই যদিও) আমি টেনেসি বিশ্ববিদ্যালয়ের নেটিভ কবি এবং আমার ছাত্রদের অন্তর্ভুক্ত করে একটি দল গঠন করেছি। প্রায় এক বছর ধরে কাজ করছি আমরা। হেইড এর্ডরিচের মতো নেটিভ কবিতার দারুণ এক সংকলণ প্রকাশিত হয়েছে এ বছর। গ্রেউল্ফ প্রেস থেকে বেরিয়েছে “নিউ পোয়েটস অব নেটিভ নেশনস”। এক ঐতিহাসিক প্রয়াস বলতে পারেন।

যদ্দুর সম্ভব পুরোনো থেকে শুরু করে একেবারে নতুন আর আগামী দিনের কবিদের সংযুক্ত করা হয়েছে এখানে। এমন একটি সংগ্রহে যা যা অন্তর্ভুক্ত হওয়া দরকার মনে হয়েছে তার সব আমরা অন্তর্ভুক্ত করতে পারিনি অবশ্য। আমাকে আনন্দ জুগিয়েছেন অসংখ্য কবি এবং তাঁদের কবিতা। সারা বছর অজানা সব কবিদের আবিস্কার করেছি আমি। অতি-আধুনিক থেকে শুরু করে সব সময়ের কবিদের জেনেছি আমি। প্রিয় কবিদের নাম উল্লেখ করতে গিয়ে সবসময়ই একটু লজ্জা লাগে যদিও, আমি আমার এক বইয়ের এক কবিতায় নেটিভ কবিদের নামের তালিকা লিখে ভুল করে ফেলেছি। পরবর্তী সংস্করণে ওটা সংশোধন করে দেব। নামের তালিকা করাটা অশোভন দেখায়। আমরা একের পর এক প্রতিটি প্রজন্মই একসাথে এই কাজের ভেতর রয়েছি। নিঃসন্দেহে কিছু কবি ও কবিতা আছে যা রেফারেন্স-পয়েন্ট হয়ে যায়। লেসলি সিল্কোর জাদুকরী কবিতা তাঁর উপন্যাস, অনুষ্ঠান, এর মধ্যে অন্যতম। এছাড়া রয়েছে সায়মন অর্টিজের বই, স্যান্ড ক্রিক থেকে, যা মূলত তাঁর অসুস্থতার সময় ভিএ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় রচিত একটি দীর্ঘ কবিতা, যার শিকড় আমাদেরকে স্যান্ড ক্রিক এবং তার অ্যাকোমা পুয়েব্লো বাড়িতে অবস্থিত কসাইখানার দিকে নিয়ে যায়। এই সংকলণে রয়েছে লায়লি লং সোলজারের ‘৩৮’ কবিতা; টমি পিকোর ‘প্রকৃতির কবিতা’; ডায়ান বার্নস; নোরা ডাউনহাউয়ার; ডিজি নানৌক ওকপিক; রেক্স লি জিম, যিনি বেশিরভাগ নাভাজোতে লেখেন; এবং ষাটের দশকে প্রকাশিত আমেরিকান ইন্ডিয়ান আর্টস ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীদের কবিতা সংগ্রহ থেকে নেয়া কবিতা।

Facebook Comments

পছন্দের বই