লেখক নয় , লেখাই মূলধন

সাক্ষাৎকার

বিপ্লব চৌধুরী

“যেমন গাছপালা, পাখি না থাকলে পৃথিবী থাকবে না, কবিতা না থাকলেও পৃথিবী থাকবে না”

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কুণাল বিশ্বাস

[পরিকল্পনা ছিল, নির্দিষ্ট কিছু প্রশ্নকে ভিত্তি করেই হবে আলাপ-বিস্তার। তার সঙ্গে কিছু আনুষঙ্গিক প্রশ্নও উঠে আসবে। কোথায় কী! আমার সাংবাদিক-প্রবণতা ভেঙে গেল খুব তাড়াতাড়ি। ফোনের ওপারে, কথক-ঠাকুরের মতো ক্রমশ নিজেকে মেলে ধরলেন বিপ্লবদা… কবি বিপ্লব চৌধুরী…]

কুণাল: বিপ্লবদা, আপনার ছোটোবেলার কথা, শৈশবস্মৃতি, প্রতিবেশ কীভাবে আপনার এবং আপনার কবিতার মনোজগৎ তৈরির নেপথ্যে আছে?

বিপ্লব: দ্যাখো, আমার শৈশব, কৈশোর এবং যৌবনের একটা বড়ো অংশ কেটেছে দুটো জায়গায়— কালিয়াগঞ্জ আর শিলিগুড়ি। আমার জন্ম কালিয়াগঞ্জে। পরবর্তীতে আমরা চলে যাই শিলিগুড়ি। ওখানেই প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হই। সরাসরি ক্লাস ওয়ানে। ক্লাস এইট অবধি ওখানেই পড়েছি। যদিও ক্লাস এইটে আমাকে দু-বার পড়তে হয়েছে।

কুণাল: কীরকম?

বিপ্লব: আমার বাবা অন্য এক ব্যক্তির সঙ্গে যৌথভাবে একটা বইয়ের দোকান চালাতেন। দোকানটার নাম ‘পুঁথিপত্র’। শিলিগুড়ির হিল কার্ট রোডে। মূলত বাবাই চালাতেন। স্কুল-কলেজের বইখাতা, ম্যাগাজিন, সাময়িকপত্র এইসব পাওয়া যেত। রোজগার ভালোই হত। কলকাতা থেকে সকালের খবরের কাগজ শিলিগুড়ি পৌঁছাত বিকেলবেলা। প্লেনে করে। তখন বাবার সঙ্গে এয়ারপোর্টে যেতাম। একদিন প্লেনের ভিতর ঢুকে দেখলাম প্লেন জিনিসটা কেমন…। তারপর হিল কার্ট রোডের যখন এক্সটেনশন হয়, তখন দোকানটাকে উচ্ছেদ করে দেওয়া হয়। এখন ওই জায়গায় রেলের বিশাল সিটি বুকিং কাউন্টার। বুঝতেই পারছ, ওই দোকানটাই ছিল আমাদের রোজগারের মূল উৎস। অর্থনৈতিক অবস্থা হঠাতই খুব খারাপ হয়ে যায়। ফলত আমরা কালিয়াগঞ্জে ফিরে আসি। তখন ছিল বছরের মাঝামাঝি সময়। সেই বছর তো কোথাও ভর্তি হতে পারলাম না। পরের বছর আবার ভর্তি হতে হল।

কুণাল: প্রথম প্লেন দেখার স্মৃতি মনে আছে?

বিপ্লব: তখন কোনো প্লেন উড়ছিল না। দু’টো প্লেন দাঁড়িয়ে ছিল। কলকাতা থেকে যে-প্লেনটা কাগজ নিয়ে আসত, তার লোকেরা বাবাকে চিনত। বাবা অনুরোধ করায় ওরা বলল, ঠিক আছে যান। মই লাগানোই ছিল। ভিতরে গিয়ে দেখলাম। একটু সিটে বসলাম। এই হল প্রথমবার। আরেকবারের কথা মনে আছে… আমি তখন ক্লাস ফাইভ-সিক্স। লতা মঙ্গেশকর, কিশোরকুমার এসেছিলেন শিলিগুড়িতে। ওঁদের প্লেন যখন নামে, তখন এয়ারপোর্টে গেছিলাম। ওঁদের দেখতেই গেছিলাম।

কুণাল: ক্লাস এইট থেকে কালিয়াগঞ্জেই?

বিপ্লব: না, একটানা নয়। এইচ.এস. পরীক্ষার ছ-সাতদিন আগে বাড়ি থেকে পালিয়ে আবার শিলিগুড়ি চলে গেলাম। ‘ডানপথ’ নামে একটা খবরের কাগজে কাজ করা শুরু করলাম। তুষার প্রধান নামে এক সাংবাদিক আছেন। খুবই বড়ো সাংবাদিক। দীর্ঘদিন যাবৎ ‘আজকাল’ কাগজের সাংবাদিক ছিলেন। উনি শিলিগুড়ির ‘ধৃতরাষ্ট্র’ নামের বিখ্যাত পত্রিকা চালাতেন। ওখান থেকে অমিয়ভূষণ মজুমদারের বইও বেরিয়েছিল। এমনকী, উত্তরবঙ্গের হাংরিরা যাঁরা ছিল… হাংরি তো নয়… হাংরিদের সম্প্রসারণ… তাঁরাও প্রায় সবাই ‘ধৃতরাষ্ট্র’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিল। তো এই তুষার প্রধানই ‘ডানপথ’ কাগজের সম্পাদক ছিলেন। একটা সান্ধ্য দৈনিক পত্রিকা। ওখানে তিনশো টাকা মাইনেতে কাজ শুরু করলাম।

কুণাল: কতদিন ছিলেন?

বিপ্লব: ওখানে বছরখানেক থাকার পরে ওটা বন্ধ হয়ে গেল বিভিন্ন কারণে। শিলিগুড়ি থেকে তখন অনেক কাগজ বেরোত। দৈনিক কাগজ, সাপ্তাহিক কাগজ। ওগুলোয় লিখতাম। তারপর ‘উত্তরবঙ্গ সংবাদ’-এ লিখতাম। ‘বসুমতী’ পত্রিকা কলকাতা থেকে বন্ধ হয়ে শিলিগুড়িতে চলে আসল। তখন ‘বসুমতী’-তে প্রচুর লিখতাম। বিভিন্ন বিভাগে লিখে রোজগার করতাম।

কুণাল: সেই সময়ের যা লেখা, তার সবই কি সংস্থানজনিত?

বিপ্লব: না, কবিতাও লিখছি তখন। প্রথম যৌবনের তাড়নায় এককথায় প্রচুর কবিতাই লিখছি তখন।

কুণাল: প্রথম কোথায় বেরিয়েছিল আপনার কবিতা?

বিপ্লব: শিলিগুড়িতে, ক্লাস সিক্সে পড়ার সময়। ‘উত্তরবঙ্গ সংবাদ’-এ ছোটোদের পাতায়। তারপর কালিয়াগঞ্জে থাকাকালীন, এই ধরো ক্লাস নাইন-টেন, তখন প্রচুর পত্রিকা বেরোত। গুণমান যাই হোক, প্রচুর কাগজ। কালিয়াগঞ্জের মতো একটা ছোটো জায়গা, সেখান থেকেই সাপ্তাহিক পত্রিকা বেরোচ্ছে গোটা পাঁচেক, ত্রৈমাসিক পত্রিকা অন্তত দশটা। সেইসব জায়গায় লিখতাম। শিলিগুড়ি যাওয়ার পর ওখানকার অনেক কাগজে লিখতাম। শিলিগুড়ি থেকে তখন রীতিমতো ভালো ভালো কাগজ বেরোত।

কুণাল: কালক্রমের হিসেবে আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সিন্ধু ও সমূহ’। এই বইয়ের সবচেয়ে পুরোনো কবিতা কোনটা?

বিপ্লব: ‘পথদুর্ঘটনা’। এই কবিতাটা তিরানব্বই সাল নাগাদ ‘দেশ’-এ বেরিয়েছিল। এর পিছনে একটা কাহিনিও আছে। বাকি সব লেখাই পঁচানব্বইয়ের পরে লেখা। পঁচানব্বই, ছিয়ানব্বই, সাতানব্বই…

কুণাল: ‘পথদুর্ঘটনা’ কবিতায় একটা লাইন ছিল— ‘ভেসে আসে অবরুদ্ধ কামারশালার গান’। আবার এই বইয়ের অন্তর্গত আমার খুব প্রিয় কবিতা ‘পাঠক’-এ আপনি লিখছেন— ‘আমার আতিথ্যে যদি হও অর্ধেক সোনার নকুল/বাকি পথ পূরণের শ্রমে কামারশালায় হব শিক্ষানবীশ’। খুবই আক্ষরিক কথা, তবু বলি, এই পঙ্‌ক্তিগুলো লেখার সময় আপনার অবচেতনে কি কোনো কামারশালার স্মৃতিছবি সংশ্লিষ্ট ছিল?

বিপ্লব: এইচ.এস পরীক্ষার আগে সেই যে শিলিগুড়ি পালিয়ে গেলাম, তারপর একটানা তিন বছর ওখানে ছিলাম। তারপর কালিয়াগঞ্জে ফিরে এসে বছর দেড়েক। তখন তো আর পড়াশোনা করতাম না, টিউশনি করতাম। মাঝে মাঝে লিখতাম, পত্রিকা করতাম। টিউশনি করে আমি ফিরতাম অনেক রাতে। ফেরার পথে চায়ের দোকানে আড্ডা মারতাম দশটা-সাড়ে দশটা অবধি। মফস্‌সলের পক্ষে অনেক রাত। আমার বাড়ি যাওয়ার পথে একটা নদী পড়ে। শ্রীমতি নদী। স্থানীয় উচ্চারণে চিরামতী। ওই নদীর বাঁ-দিকে একটা শ্মশান, ডানদিকে একটা কামারশালা। সেই কামারশালা এখনও আছে। এমনকী সেই পুরোনো কামারও আছে। এইবার গিয়েও দেখে আসলাম। তার বয়স এখন প্রায় সত্তর। এখনও সক্রিয়। বয়সের কারণে একটু ন্যুব্জ হয়ে গেছে। এইবার কী শোনো… রাত্তিরে যখন ফিরতাম, বেশিরভাগ দিনই দেখতাম বাঁ-দিকে একটা চিতা জ্বলছে। কাঠের চিতা। আর ডানদিকে ওই লোকটা কিন্তু কাজ করছে তখনও। এই ছবিটা আমার মনে বারবারই ঘুরে ফিরে আসত। মনে হত ওই লোকটা লোহা পিটিয়ে শুধু দা, কোদাল, শাবল তৈরি করছে না। যেন আরও বড়ো কিছুতে মগ্ন আছে। ‘গুহালিপি’ পত্রিকায় আমি সম্প্রতি ‘লোহা’ নামে একটা কবিতা লিখেছি, যেখানে ওই কামারকে ঈশ্বর হিসেবে উপস্থাপন করতে চেয়েছি। যেন সে লোহা পিটিয়ে পিটিয়ে মানুষ তৈরি করছে রোজ। ফলে এখন টের পাই, ওই লোক, ওই কামারশালা, ওই ছবি ঘুরে ফিরে আমার কাছে আসছে। তার চেয়েও অদ্ভুত লাগে ওকে যখন দেখি। ভাবি এই একটা মানুষ, বিহারী মানুষ, শ্মশানের ধারে থাকে… যে আমার কবিতায় আছে, অথচ যার সঙ্গে আমার সেই অর্থে কোনো ব্যক্তিগত পরিচয় নেই, হয়তো দু-একবার কথা হয়েছে অনেক বছর আগে কোনো কাজের সূত্রে… এ এক অদ্ভুত অনুভূতি!

কুণাল: ‘লাঙল ফলার মতো তীক্ষ্ণধার রোদে আমি অনেক পোড়ার পর/আরও দূর শীতের সন্ধ্যায় তোমার সন্ততি পাবে সেই তাপ।’… ‘লাঙল ফলার মতো তীক্ষ্ণধার রোদে’— এই উপমা নির্মাণের প্রেক্ষাপটে কোথাও কি সেই বিহারী কামার রয়ে গেছেন?

বিপ্লব: হ্যাঁ, তা বলাই যায়। রয়ে গেছেন।

কুণাল: আর ওই শ্মশান?

বিপ্লব: সেই অর্থে কোনো স্মৃতি নেই। তবে ভয় কোনোদিন ছিল না। তখন আমার বয়স কত! বড়োজোর সতেরো-আঠেরো। মাঝেমাঝে দেখতাম চিতা জ্বলছে। স্ফুলিঙ্গ। দুপুরের দিকে অনেকসময় গিয়ে বসেও থেকেছি। বটগাছ, চিরামতী নদী, নির্জন বাঁশঝাড়। শ্মশানের পরিবেশ আকর্ষণ করত। এর বেশি কিছু না।

কুণাল: কালিয়াগঞ্জ থেকে প্রথম কলকাতা কবে আসলেন?

বিপ্লব: কালিয়াগঞ্জ থেকে না, শিলিগুড়ি থেকে আসলাম। পঁচানব্বই সাল নাগাদ। বছরখানেক কলকাতায় থেকে ফিরে গেলাম। আর থাকতে পারছিলাম না। তখন তো নির্দিষ্ট কোনো আস্তানা নেই। আজ এর বাড়ি, কাল ওর মেস। বেশিরভাগই কবিবন্ধু। তখন তো তারাও কেউ প্রতিষ্ঠিত নয়। মাঝেমাঝে, খুবই বিক্ষিপ্তভাবে ‘আজকাল’ ইত্যাদি কাগজে লেখা। কিন্তু তা সংস্থানের পক্ষে মোটেই যথেষ্ট নয়। ফলে কলকাতায় এক বছর থেকে আবার কালিয়াগঞ্জে ফিরে গেলাম। তার আগে টিউটর হিসেবে মোটামুটি নামডাক হয়ে গেছিল। আমি তো ক্লাস এইট থেকে টিউশন পড়াতাম। প্রাইমারি স্কুলের বাচ্চাদের সব সাবজেক্টই পড়াতাম। তা এইবার যখন গেলাম, তখন এই বাচ্চাদের ব্যাচ ছাড়াও হঠাৎ একদিন ক্লাস ইলেভেনের কিছু ছেলেমেয়ে এসে বলল বাংলা পড়বে। আমি বললাম, আমি নিজেই এইচ.এস. পরীক্ষা দিইনি, তোরা আমার কাছে কী পড়বি! তো যাইহোক, এইভাবে প্রায় দশজনের একটা ব্যাচ হল। এইভাবে চলার পর একটা সময় গিয়ে মনে হল ভীষণ আটকে পড়েছি। কালিয়াগঞ্জের জীবন আর ভালো লাগছে না। তার আগে দীর্ঘদিন শিলিগুড়িতে কাটিয়েছি। বুঝতেই পারছ… তারপর সাতানব্বই সাল নাগাদ কলকাতায় চলে আসি। আর এই কথা আমি আগেও বলেছি, আবারো বলব, আমার এই দ্বিতীয় পর্যায়ে কলকাতা আসার পিছনে প্রধান অবদান শুভাশীষ ভাদুড়ীর।

কুণাল: কবি শুভাশীষ ভাদুড়ী?

বিপ্লব: হ্যাঁ। আসলে ওই যে আগে এক বছর থেকে গেছিলাম, তখন এদের সবার সঙ্গেই পরিচয় হয়ে গেছে। অয়ন, শুভাশীষ, মণিশংকর, সাম্য, অনির্বাণ…। শোভনের সঙ্গে তার পরের পর্যায়ে। তো শুভাশীষ আমার কলকাতায় থাকার ইচ্ছার কথা জানত। ও আমার জন্যে একটা চাকরি ঠিক করে। ‘প্রতিযোগিতা পরিপ্রেক্ষিত’ বলে একটা পত্রিকা বেরোত। এখনো বেরোয়। তার সম্পাদক তিনজনেই ডব্লুবিসিএস অফিসার। আলাদা আলাদা জায়গায় কর্মরত। ফলে কাগজের মেটেরিয়াল তৈরি করে দিলেও কাগজ সংক্রান্ত বাকি কাজগুলো তাদের পক্ষে করা দুষ্কর ছিল। ওদের মধ্যে কেউ একজন শুভাশীষের চেনা থাকার সুবাদে একটা সুযোগ খুলে গেল। একটা কাজ পেতে পারো… সতেরশো টাকা মাইনে— এই মর্মে শুভাশীষ আমাকে চিঠি লিখল। সাতানব্বই সালে সতেরশো টাকা অনেকটাই। মানে চলে যাওয়ার পক্ষে। আমিও ওই চিঠিটা পাওয়ার পরে কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব না করে দু-তিন দিনের মধ্যে কলকাতায় ঢুকে কাজে যোগ দিলাম। এবার দ্যাখো, সব মিলিয়ে কাজটা তো বোরিং… প্রুফ দেখা, সেটিং করা, পাতিরামে পৌঁছে দেওয়া থেকে শুরু করে সবকিছু। পুরো পত্রিকাটা দেখাশোনা আরকী! বছর দেড়েক করেছিলাম।

কুণাল: এই সময় থাকতেন কোথায়?

বিপ্লব: কালিকাপুরে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতাম।

কুণাল: কলেজ স্ট্রিট নিয়ে তখনকার স্মৃতি কেমন?

বিপ্লব: দ্যাখো, আগের পর্যায়েই অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেছিল। এবার কাগজগুলো নিয়ে পাতিরাম বা অন্যত্র যেতাম। সব মিলিয়ে প্রায় দশ হাজার কপি পৌঁছে দিতে হত। টাকা আনতে যেতাম। কলেজ স্ট্রিটের সঙ্গে যোগ ছিলই। তখন তো সবারই বয়েস কম। দিনরাত কফি হাউসে আড্ডা হচ্ছে। প্রেসিডেন্সির ভিতরে ক্যান্টিন, হিন্দু হোস্টেল সবই আড্ডাস্থল ছিল। তখন কলেজ স্ট্রিটে আত্মীয়তা, কর্মকাণ্ড, ক্রিয়েটিভিটি সবকিছুই অনেক বেশি। ফুটপাথে বসে কবিতা পড়া হচ্ছে, গান হচ্ছে, বুড়োদার চায়ের দোকানে বসে রাত অবধি আড্ডা হচ্ছে।

কুণাল: ‘গান্ধার’ পত্রিকা তো তখন বেরোচ্ছে?

বিপ্লব: হ্যাঁ, ‘গান্ধার’ বেরোচ্ছে। যদিও আমি নিজে ‘গান্ধার’-এর শেষ সংখ্যাটার সঙ্গেই যুক্ত ছিলাম… যেটার পরে ‘গান্ধার’ আর বেরোয়নি। ওই দু-হাজারেই শেষ সংখ্যা বেরোয়। ওটাতে আমি লিখেওছিলাম। সেই বছর কিছু ফোল্ডারও বেরোয়।

কুণাল: আপনার প্রথম বই ‘সিন্ধু ও সমূহ’ তো ‘গান্ধার’ থেকেই বেরিয়েছিল?

বিপ্লব: ‘সিন্ধু ও সমূহ’, ‘ভবতরঙ্গ’— দুটো বই-ই ‘গান্ধার’ থেকেই বেরিয়েছিল। যদিও ‘ভবতরঙ্গ’-এর সময় ‘গান্ধার’ পত্রিকা আর বেরোত না। অর্পিতাদির (অর্পিতা ঘোষ) ‘পিকাসো’ নামে একটা প্রিন্টিং ইউনিট ছিল। সিলভার স্ক্রিনে খুব ভালো কাজ করতেন। ওখান থেকেই বইগুলো ছাপা হয়।

কুণাল: ইবন বতুতার একটা কথাই আছে ‘নতুন কোনো জায়গা ভ্রমণ করার পরে সংবেদনশীল মানুষমাত্রই একজন কথক হয়ে ওঠে।’
… কর্মসূত্রে বা এমনিতেই পশ্চিমবঙ্গ-সহ ভারতের বিভিন্ন জায়গা আপনি ঘুরেছেন। এই অভিজ্ঞতাগুলো কি লেখায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কখনো এসছে?

বিপ্লব: অবশ্যই এসেছে। অল্পস্বল্প নয়, ব্যাপকভাবেই এসেছে। বর্তমান চাকরির সূত্রে পশ্চিমবঙ্গের সব জায়গাতেই গেছি। কতরকম ভূপ্রকৃতি, মানুষ, কথা বলার ভাষা। পশ্চিমবঙ্গে একরকম, বিহারে আরেকরকম। প্রত্যেকটা গ্রাম আলাদা। চলতে চলতে কোনো দৃশ্য ভেসে ওঠে। বহু বছর পর কোনো একটা লেখায় হয়তো সেটা কাজে আসলো। ভ্রমণ সবসময়ই সাহায্য করে। আরেকটা ব্যাপার। একদম নিশ্চল, ঘরে বসে লেখা আমার দ্বারা হয় না। আমার অধিকাংশ লেখা চলতে চলতেই তৈরি। অন্তত আমার কবিতাগুলো চলমান অবস্থাতেই বেশি লেখা হয়েছে। যেমন একসময় আমি খুব দূরপাল্লার বাসে যাতায়াত করতাম। তখন তো এত ট্রেন ছিল না, শিলিগুড়ি থেকে কলকাতায় আসতে গেলে অধিকাংশ সময় রকেট বাসেই আসতে হত। ওই গরমকাল, রাত্রিবেলা, জানালার ধারে সিট, হু হু করে হাওয়া…। আমার অনেক লেখার বীজ ওখান থেকেই তৈরি হয়েছে।

কুণাল: যেমন?

বিপ্লব: যেমন ‘সিন্ধু ও সমূহ’-এর ‘পথদুর্ঘটনা’ লেখাটার কথাই ভাবো। ওই বাসে বসেই লেখা। লেখাটার পিছনে যদিও অন্য উৎস আছে। তখন অল্প বয়স (হাসি)…। ‘ডানপথ’ কাগজে কাজ করার সময় আমি শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ির হাংরিদের দ্বারা খানিকটা প্রভাবিত হয়ে গেছিলাম। ফলত জীবনযাপনও কিছুটা অন্যরকম। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উলটো দিকে এখন অনেক দোকানপাট। আগে কিছুই ছিল না। বালাসন নদীর একটা ক্ষীণ রেখা বয়ে গেছে। সবুজ ঘাসে ঢাকা পাড়। আর দু-একটা ছোটো ছোটো ধাবা। ধাবাগুলোয় বাংলা মদ পাওয়া যেত। আর বিভিন্ন মাংসের ছাঁট দিয়ে তৈরি অপূর্ব একটা খাবার। রাতের পর রাত আমরা কয়েকজন মিলে ওই নদীর পাড়ে বসে মদ আর ওই ছাঁটমাংস খেতাম। মাথার উপরে জ্যোৎস্না। ইউনিভার্সিটির মেইন গেট টপকে ভিতরেও ঢুকে পড়তাম। তখন আমরা একটা বিপজ্জনক খেলা খেলতাম। ওই রাস্তাটা তো হাইওয়ে। চৌত্রিশ নাম্বার জাতীয় সড়ক। আমরা চার-পাঁচজন মাতাল টানটান হয়ে রাস্তার উপরেই শুয়ে পড়তাম। দু-দিক থেকে ট্রাকগুলো দাঁড়িয়ে গেছে। রাস্তায় নেমে আমাদের খিস্তিখেউড় করছে। তখন মেরে দিলেও আমাদের কিচ্ছু করার ছিল না। এটা আমাদের এক প্রিয় খেলা ছিল। ওই যে ‘পথদুর্ঘটনা’-র লাইনটা ‘শক্তিমান কোনো ট্রাক আমার পালক পিষে এখানে থামুক’… এটা সরাসরি ওই অভিজ্ঞতা থেকেই এসেছে।

কুণাল: পুরুলিয়ার সঙ্গেও তো আপনার দীর্ঘ সংশ্লিষ্টতা। আগে একবার বলেছিলেন সেই সেমসাইড ডাকাতির ঘটনা। ছৌ-নৃত্যদলের উপর ভুলবশত আক্রমণ করে পরেরদিন অনুতপ্ত ডাকাতেরা সবকিছু ফিরিয়ে দিতে আসছে। এরকম কিছু…

বিপ্লব: ২০০৪-০৫ সাল নাগাদ পুরুলিয়ায় খুব ডাকাতি হত। রাস্তার উপর গজাল পেরেক ফেলে রেখে দিত। টায়ার ফেঁসে গেলেই গাড়ির উপর হামলা। তা ওই ছৌ-এর দল খুব বিখ্যাত। বীণাধর কুমারের দল। উনি ঝালদার বামনিয়া গ্রামে থাকেন। ওঁর জনপ্রিয়তা এমনই লেভেলের যে, মা মারা যাওয়ার পর বীণাধর কুমার মাথা ন্যাড়া করলে গোটা পুরুলিয়া জেলা জুড়ে ওঁর কয়েক হাজার ভক্ত মাথা ন্যাড়া করে ফেলে। ডাকাতের দল ভুল করে ওঁর দলের উপরেই আক্রমণ করে বসল। এখন, ২০০৪ সাল থেকেই ছৌ আর ঝুমুর নিয়ে কাজ করার সুবাদে অনেকের সঙ্গেই আমার আলাপ। পরেরদিন মালপত্র ফিরিয়ে আনতে যাওয়ার সময় বীণাদা আমাকেও নিয়ে গেলেন। চাকলতোড়ের কাছাকাছি কোনো গ্রামে ডাকাতের দল ওয়েট করে আছে। আর আমরা বাইকে চড়ে যাচ্ছি। সে এক অভিজ্ঞতা বটে! বীণাদার বয়স এখন পঞ্চাশের উপর। এখনো পুরোদমে পারফর্ম করেন। তাছাড়া গত কয়েকবছর যাবৎ কাশীপুর ব্লকের মাজুরামুড়া নামের একটা গ্রামে আমরা কাজ করছি। চল্লিশ ঘর মতো পটচিত্র শিল্পী আছে। এরা একেবারেই দরিদ্র, ভাঙাচোরা ঝুপড়িতে থাকে। সরকার থেকে ইদানীং পাকা বাড়িও করে দিয়েছে ওদের জন্য। কিন্তু, সেখানে ওরা থাকে না।

কুণাল: কেন?

বিপ্লব: এইটাই তো সরকার ভুল করে। যে মাটির ঘরে থাকতেই অভ্যস্ত, তার পক্ষে চট করে পাকা ঘরে থাকা সম্ভব নয়। এইটাই সরকার বুঝতে পারে না। কখনো খুব বৃষ্টি হলে পাকা ঘরের বারান্দাগুলোকে ওরা ছবি আঁকার কাজে ব্যবহার করে। এক প্রকার ভিক্ষা করেই জীবনধারণ। পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর জুড়ে ওদের বিশাল বড়ো নেটওয়ার্ক আছে। কেউ মারা গেলে ওরা ঠিক খবর পেয়ে যায়। তারপর পুরুষ/স্ত্রী ভেদে আলাদা আলাদা পট বয়ে নিয়ে যায় মৃতের বাড়ি। গিয়ে বাড়ির লোকদের বলে, এইটা তোমার বাবা বা এইটা তোমার মা। এর চক্ষুদান না করলে আত্মার শান্তি হবে না। তারপর একটা চোখ এঁকে দেয়। একটা গান করে। ওই চোখআঁকা পটের বিনিময়ে মৃতের কাপড়-চোপড়-সহ আরো যা যা জিনিস পায় নিয়ে আসে।

কুণাল: এই রীতির কোনো বিশেষ নাম আছে?

বিপ্লব: চক্ষুদানই বলে। আর ওই পটকে বলে চক্ষুদান পট। এই শিল্পীরা আসলে যাযাবর শ্রেণির। ভারতবর্ষের অধিকাংশ পটচিত্র শিল্পীরাই যাযাবর। ঘুরতে ঘুরতে হয়তো কোনো একটা জায়গায় এসে থিতু হয়ে গেছে। এদের পদবী ‘চিত্রকর’। পশ্চিমবঙ্গের যত পটচিত্রশিল্পী আছে, সবার পদবীই ‘চিত্রকর’। আবার ধর্মাচরণ মুসলিম। কিন্তু, নাম শুনে বুঝবে না। যেমন দুখুশ্যাম চিত্রকর, রাধেশ্যাম চিত্রকর। নামে হিন্দু, সিঁদুর পরে, কেউ কেউ মনসা পুজো করে। আবার নমাজও পড়ে। এদের মধ্যে আবার কারো নাম সালেমা, কারো নাম ফতেমা। হিন্দু দেবদেবী, পুরাণ বিষয়ে অনেক ছবি আঁকলেও এদের কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। আবার বায়োস্কোপের কায়দায় পটচিত্র দেখিয়ে দেখিয়ে অনেকে সুর করে শ্রীকৃষ্ণের জন্ম, কংসবধ এইসব অভিনয় করে। পুরুলিয়া, বাঁকুড়া ছাড়াও মেদিনীপুরের পিংলা আর মঠচণ্ডীপুর গ্রামেও এরা আছে। এক অদ্ভুত জনজাতি!

কুণাল: আপনার জীবনের দীর্ঘ একটা সময় উত্তরবঙ্গে থেকেছেন। আপনার কবিতায় অনেক সময় অভিশ্রুত শব্দ, ক্রিয়াপদ ইত্যাদির বদলে আঞ্চলিক শব্দ, ক্রিয়াপদ উঠে এসছে। মানুষ, ভূপ্রকৃতি, ভাষা ইত্যাদি প্যারামিটারে উত্তরবঙ্গের স্বাতন্ত্র্য কোথায়?

বিপ্লব: আমরা যখন ছোটোবেলায় শিলিগুড়িতে থাকতাম, তখন প্রায় কোনো বাড়িতেই ফ্যান ছিল না। ফ্যান ছাড়াই আমরা গ্রীষ্মকাল কাটাতাম। এমনই আবহাওয়া ছিল। সেই পরিবেশ তো এখন নেই। তখন শিলিগুড়িতে বেশিরভাগই ছিল একতলা বাড়ি। একটা-দুটো দোতলা বাড়ি। তাও কাঠের। তখন তো শীতকালে পরীক্ষা হত। পরীক্ষার আগে কাকভোরে উঠে জানালা খুলে পড়তে বসছি। চাদর মুড়ি দিয়ে। সামনেই দেখা যাচ্ছে পাহাড়। আগে তো প্রচুর নদী ছিল। পাহাড় থেকে নদীগুলো নেমে আসছে। বিভিন্ন জনপদের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ে বৃষ্টি হলে শিলিগুড়ি শহরে তখন কিছুক্ষণের জন্য একহাঁটু জল জমে যেত। ঠান্ডা জল… তারপর কিছুক্ষণ পর জল নেমে গেল। আর ডায়ালেক্টের ক্ষেত্রে বলি, উত্তরবঙ্গে মূলত দু-রকম ডায়ালেক্ট আছে। একটা হল ভূমিপুত্র, যারা রাজবংশী সম্প্রদায়, যারা গোটা উত্তরবঙ্গ জুড়েই আছে, তাদের একটা ভাষা। আর আমরা যারা ওখানকার হিন্দু বাঙালি, তারা বেশিরভাগই তো উদ্বাস্তু। নাইন্টি পারসেন্টই উদ্বাস্তু। জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়িতে কিছু কিছু লোক ছিল যারা আগে থেকে আছে। আমাদের ওরিজিন ছিল রাজশাহী। যদিও আমার ঠাকুরদা সাতচল্লিশ সালের আগেই চলে এসছেন। গড় হিন্দু বাঙালির বরাবরই একটা প্রবণতা ছিল ওখানকার ভূমিপুত্রদের একটু নীচু চোখে দেখা। ফলে ছোটো থেকে তো বটেই, একটু বড়ো হওয়া পর্যন্ত এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে মেলামেশা দেখতে পাইনি। যেটা এখন অনেকটা হয়েছে। এখন ওদের সাহিত্য হচ্ছে অনেক। গান তো ওদের বরাবরই ছিল। ভাওয়াইয়া। এবার উত্তরবঙ্গের গড় বাঙালিদের যে-ভাষা, যেমন এখানে বলে ‘খেয়েছি’, আমরা বলতাম ‘খাইচি’… ‘দিব’, ‘নিব’… আর প্রত্যক্ষভাবে যদি বলো, তাহলে ‘মদ’ বইয়ের ওই কবিতাটার কথা বলব। দ্বিতীয় লেখাটা… ‘বন্ধু’… ‘তখন তোমাকেই পড়াই আমার লিখা…’। এই ‘লিখা’ শব্দটা কিন্তু উত্তরবঙ্গের। বা যেমন ধরো, বাঁকুড়ায় থাকার সময় আমি একটা কবিতা লিখলাম। ‘দু’টি উপহার’ নামে। এখনো কোনো বইতে আসেনি। ছাতনা থেকে তাঁতিদের যে-গ্রামটায় আমরা যেতাম, কেঞ্জাকুড়া, ওই রাস্তাটা খুব সুন্দর। দু-পাশে ঘন পলাশের জঙ্গল। মাঝখান দিয়ে রাস্তা। ছাতনা থেকে সাত কিলোমিটার। আমরা রোজই যেতাম টোটোয় করে। এইবারে তোমার বসন্ত চলে এসছে, অথচ পলাশ ফুটছে না। রোজই সবাই ভাবছে পলাশ ফুটবে, কিন্তু ফুটছে না। এইসব নিয়ে একটা লেখা হল ‘পলাশ এখনো ফুটছ না কেন…’ তারপর ওই লেখাটার শেষে আছে… হঠাৎ করেই দেখা যাচ্ছে একটা গাছে মাত্র দু-টো পলাশ ফুটে আছে। তখন লেখাটা শেষ হচ্ছে এইভাবে যে, গাছটা বলছে একটা পলাশ তোমার জন্য, আরেকটা টোটোচালকের জন্য। ওইখানে ‘বটে’ শব্দটা এসছে। এই দু-টো প্রত্যক্ষ উদাহরণ মনে পড়ছে। তাছাড়া ভিতরে ভিতরে তো মিশে থাকেই।


কুণাল: আচ্ছা বিপ্লবদা, ‘সিন্ধু ও সমূহ’, ‘ভবতরঙ্গ’ এগুলো তো আপনার প্রথম পর্যায়ের লেখা। এই লেখাগুলো আপনার এখন কেমন লাগে? কখনো কি মনে হয় যে আপনি বিবর্তিত হয়ে গেছেন কিংবা ওই লেখাগুলো আর আপনার নয়?

বিপ্লব: না, আমার সেটা মনে হয় না। কখনোই মনে হয় না। কারণ, সেটা আমার একটা পর্যায়। একটা পর্ব। আমি তো আর চল্লিশ থেকে চারের দিকে যেতে পারব না। চার থেকে চল্লিশের দিকে যাব। হ্যাঁ, হয়তো একটা-দু-টো লেখা সম্পর্কে মনে হতে পারে না থাকলেও হত… আসলে কিছু লেখা হয়ে যায়, বহু পরে সেগুলোর মধ্যে আর প্রবেশ করা যায় না… তবে ওটাও একটা ধাপ… আমার লেখা বলে অস্বীকার করছি না। ওই বইগুলো লিখে আমি যথেষ্ট আনন্দ পেয়েছি।

কুণাল: আপনার প্রথম দিকের অনেক কবিতার অনেক পঙ্‌ক্তি যেমন ‘আরও দূর শীতের সন্ধ্যায় তোমার সন্ততি পাবে সেই তাপ’ কিংবা ‘স্পষ্ট প্রেতের চেয়ে আবছা পরীকে তাই এত ভালোবাসি’— এইসব স্মরণীয় পঙ্‌ক্তি অনেক পরিণত, এমনকী নবীন কবিতা-পাঠকেরা মুখস্থ বলে। মোটের উপর আমাদের এক সাধারণ প্রবণতা রয়েছে কবিতার ভিতর কোট-আনকোট কাব্যগুণ খোঁজা, অথবা স্মরণযোগ্য, উদ্ধৃতিযোগ্য পঙ্‌ক্তি খুঁজে বের করা। কিন্তু ‘মদ’ বইয়ের কবিতাগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যায় কবিতাগুলো তাদের আপাদমস্তক অস্তিত্ব-সহ পাঠককে টানছে, আলাদা করে কেউ বলতে পারছে না শেষ লাইনটা ভালো, ওই দু-লাইন অসামান্য ইত্যাদি। উপরন্তু, উদ্ধৃত করতে হলে গোটা কবিতাটাই করতে হচ্ছে…

বিপ্লব: আসলে লেখালিখির প্রথম দিকে… ভ্রান্ত বলব না, কিন্তু সেই সময়ের উপযোগী কিছু ধ্যানধারণা থাকে। যেমন এইসব স্মরণযোগ্য পঙ্‌ক্তি, কবিতা… তখন হয়তো আমাদের মধ্যে ওইসব কাজ করেছিল। আমাদের সময় কবিতাকে শাশ্বতের দিকে, অনন্তের দিকে নিয়ে যেতে হবে এমন একটা ধারণাও কিন্তু কাজ করেছিল। তখন অভিজ্ঞতারও অভাব ছিল। তখন পৃথিবী সম্বন্ধে ধারণা এত স্পষ্ট ছিল না। যত দিন যাচ্ছে, এই বস্তুপৃথিবী, তার অন্তঃসারশূন্যতা থেকে একটা সহজ, সরল জীবনের দিকে টান অনুভব করছি। সত্যি বলতে একটা গ্রামে যখন যাই… কোনো একটা বাড়িতে গিয়ে হয়তো থাকলাম… তার বারান্দার মধ্যে শুয়ে থাকলাম… পাঁচটা লোকের সঙ্গে বসে খেলাম, তার আনন্দ কিন্তু তুমি, আমি একটা বারে বসে পাব না। অনেক টাকা খরচ করে খেয়েও পাব না। এই জীবনের দিকে আকর্ষণ আমার বাড়ছে। আর এই যে আমাদের মেকি জীবন… তুমি গ্রামের একটা লোকের সঙ্গে তো আর কফি হাউসের মতো ভাষায় কথা বলতে পারবে না। তার ভাষায় কথা বলতে হবে। সেই ভাষাটা হয়তো আমার মধ্যেই ছিল। আমার মধ্যে তাকে জাগিয়ে তুলল ওই মানুষটা। সেইভাবে লেখার ক্ষেত্রেও স্মরণযোগ্য পঙ্‌ক্তি লেখার চেয়ে আমি কী বলতে চাইছি সেই ভাবটুকু প্রকাশ করাই জরুরি বলে মনে হচ্ছে। ফলে লেখাও পালটে যাচ্ছে। ‘মদ’ বইয়ের ‘আশা’ লেখাটার প্রসঙ্গে বলি। আসলে আমার বেশিরভাগ লেখার পিছনে একটা কাহিনি আছে। কালিয়াগঞ্জে আমাদের বাড়ির কাছে একটা বিশাল হাট বসত। ধনকৈল হাট। সেই হাটে চারটে রাস্তা এসে মিশেছে। বালুরঘাট থেকে একটা, রায়গঞ্জ থেকে একটা, বাংলাদেশের দিকে রাধিকাপুর বর্ডার আর ডালিমগাঁ থেকে দু’টো। মাঝখানে প্রায় পাঁচশো একর জায়গা জুড়ে হাট। আবার এই হাটে আসবার পথে, কেউ হয়তো সাইকেলে আসছে, কেউ ভ্যান নিয়ে, কেউ হয়তো গরুর গাড়িতে করে, কারো হাতে হয়তো দু’টো মুরগি, কেউ হয়তো একধামা চাল… আর এই রাস্তার দু-পাশেও কিন্তু একটা হাট বসে যায়। যারা পাইকার, তারা কী করে, তারা ওই পথচলতি লোকদের বলে, ‘আরে দু’টো মুরগি নিয়ে তুই অতদূর হাঁটবি… দশ টাকা কম নিয়ে এখানেই দিয়ে যা।’ ফলে ওই হাটটা কিন্তু ছড়িয়ে যায়। আর ওই হাটে যেহেতু রাজবংশী, এমনি বাঙালি, আদিবাসী সাঁওতাল মিলে এক মিশ্র জনজাতি আছে… আর রাস্তার দু-পাশে ফাঁকা অনাবাদী জমি… প্রচুর বড়ো বড়ো শিমুল, পাকুড়, বট এই ধরনের গাছ। তা ওই আদিবাসী মহিলারা ওইসব গাছের নীচে বসে হাঁড়িয়া, তাড়ি এইসব বিক্রি করে।

‘আহার-পানি’ বইতে দেখবে আমার একটা লেখা আছে ‘সোমবার’ বলে… ‘হাটবারে, বাসন্তী মুর্মুর কাছ থেকে ঘরে তৈরি মদ/আর অলকা মুন্ডার ভাজা চুনোমাছ খাই’। আমার খুব আকর্ষণের জায়গা ছিল ওইগুলো। সকালবেলা উঠে ওই ঠেকগুলোতে চলে যেতাম। এক টাকায় এক গ্লাস। ওদের ব্যবহারও খুব সুন্দর। একটু চুনোমাছ দিচ্ছে। এই যে হাটের জীবন, নিবিড়তা… এই অভিজ্ঞতাগুলো থেকেই হয়তো কখনো এই লেখাটা লিখে ফেললাম। সব লেখার পিছনেই একটা অন্তর্গত গমন, একটা পর্যটন আছেই।

কুণাল: বিপ্লবদা, যতদূর জানি, আপনার প্রিয় কবিদের তালিকায় প্রথম কয়েকটি নাম বিনয়, উৎপল, শক্তি, মণীন্দ্র গুপ্ত। যখন প্রথম লিখতে আসছেন, তখনো কি এঁরাই আপনার প্রিয় কবি?

বিপ্লব: হ্যাঁ… তবে পড়াশোনা তো আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে… আগে কখনো শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায় পড়িনি। যত সময় যায় তত প্রিয় কবির সংখ্যাও বাড়তে থাকে।

কুণাল: আবার কেউ কেউ বাদও পড়ে যায়?

বিপ্লব: না, চলে যাওয়ার ব্যাপারটা এখনও হয়নি। বছর ত্রিশের পর থেকে বুঝেই গেছিলাম এরা আমার সাথে থাকবে, আর এরা না হলেও চলবে। উৎপল, বিনয়, শক্তি তো ছিলই… কিছুদিন পরে মণীন্দ্র গুপ্ত যুক্ত হয়েছেন।

কুণাল: মণীন্দ্র গুপ্তের কোন কাব্যগ্রন্থ আপনার সবচেয়ে বেশি প্রিয়?

বিপ্লব: মণীন্দ্র গুপ্তের প্রায় সব লেখাই আমার ভালো লাগে। ওই যে পৃথিবীর মধ্যে কীভাবে একটা অতিপ্রাকৃত পৃথিবী চলে আসছে। একটা অদ্ভুত রহস্যের জগৎ। আবার প্রণবেন্দুর যে বলার ভঙ্গি, যেন কথাই বলছেন নিভৃতে, মুখোমুখি বসে… কিন্তু তার ভিতরে যে অদ্ভুত গভীরতা, অনুভবের জায়গা…

কুণাল: প্রবীর দাশগুপ্ত?

বিপ্লব: প্রবীর দাশগুপ্ত তো একটা ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছেন। আমরা যখন কলেজ স্ট্রিটে আসছি, তখন প্রবীর দাশগুপ্তের নাম হাওয়ায় ভাসছে। অবশ্যই… প্রবীরের কয়েকটি লেখা, অন্ততপক্ষে চার-পাঁচটা লেখা তো সারাজীবনই সঙ্গে সঙ্গে থাকবে। সম্ভাবনাময় একজন কবি, যার বিবর্তনটা আমরা দেখতে পেলাম না।

কুণাল: উৎপলকে নিয়ে ‘সীমাহীন ভালোবাসার কবি’ নামে আপনার লেখা একটা প্রবন্ধ পড়েছিলাম। উৎপলকে তো অনেকে শুধুই ক্র্যাফট-সচেতন কবি বলে ট্যাগ করে দেয়, কবিতা নেই, শুধু শৈলী আছে, শুধুই বুনন… তাদের উদ্দেশেই আপনি ওই জায়গাটা ভারি অদ্ভুত লিখেছিলেন, একদম শেষের দিকে… ‘রুক্ষ্ম মাটির বুকে কৃষক যেভাবে জাগান সবুজ ধানক্ষেত, যেভাবে নীলাম্বরী বুনে তোলেন শান্তিপুরের তাঁতি, উৎপলকুমারের দক্ষতা, কবিতাকৌশল সেভাবেই জেগে আছে মাটির কাছাকাছি। সীমাহীন ভালোবাসায় আর্দ্র ও আকুল।’

বিপ্লব: হ্যাঁ, পুরুলিয়া লিটল ম্যাগাজিন মেলার স্মারকপত্রে বেরিয়েছিল…

কুণাল: আবার বিনয় ভালো লাগার কারণ আলাদা, শক্তি ভালো লাগার প্রেক্ষাপট আলাদা। বিনয়ের কবিতা আপনার কেন ভালো লাগে?

বিপ্লব: দ্যাখো, কবিতা তো সারা পৃথিবী জুড়েই লেখা হচ্ছে। বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন ভাষায়… চেসোয়াভ মিউজও কবিতা লিখছেন, বোদল্যেরও কবিতা লিখছেন, নেরুদাও কবিতা লিখছেন। কিন্তু বিনয়ের কবিতা শুধুই কবিতা নয়। শুধুই পাঠকদের জন্য নয়। এমনকী শুধুই লেখকদের জন্য নয়। জীবনানন্দের মতোই বিনয়ের অনেক কবিতাই বৃহত্তর মানব সমাজের জন্য। আসলে এই বস্তুসমাজে আমরা হয়তো ভাবি কবির কোনো অবদান নেই। কবিতা লেখা না হলেও পৃথিবী হয়তো বেঁচে থাকবে। কিন্তু, আসলে তো থাকবে না। যেমন গাছপালা, পাখি না থাকলে পৃথিবী থাকবে না, কবিতা না থাকলেও পৃথিবী থাকবে না। এই বিশেষ জায়গাটাতে খুব কম কবিই পৌঁছাতে পারেন। উৎপল-সহ আরো কেউ কেউ কবিতার অনেক দিক আবিষ্কার করেছেন, কিন্তু আমার মনে হয় না ওই জায়গাটায় পৌঁছাতে পেরেছেন। বিনয় মজুমদার যখন লেখেন, ‘মানুষেরা কিন্তু মাংসরন্ধনকালীন ঘ্রাণ সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে’ এবং ফুলের গন্ধের চেয়েও উপরে তাকে স্থান দেন, তখন আমাদের সমাজ, ভোগবাদ, তার অন্তঃসারশূন্যতা, মেকি জীবনের থেকে আমাদের যেভাবে সতর্ক করে দেন, সেটা কেবলই কোনো কবিতা-রচয়িতার কাজ থাকছে না, সেটা একজন সন্তের কাজ হয়ে যাচ্ছে। বিনয়ের এই জায়গাটাই আমাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে। বিনয় একটা অমোঘ বাক্য উচ্চারণ করে গেছেন, ‘ভালোবাসা দিতে পারি, তোমরা কি গ্রহণে সক্ষম?’… এই পৃথিবী যে ভালোবাসা গ্রহণে সক্ষম না, তা জীবন দিয়ে বুঝেছি। এই জায়গাটায় বিনয়। বিনয় আমার কাছে শুধু একজন কবি না। বিনয় আমার ফ্রেন্ড, ফিলোজফার, গাইড।

কুণাল: আপনার সঙ্গে বিনয়ের স্মৃতি বলতে তো ওই একবারই ঠাকুরনগরে আসা…

বিপ্লব: হ্যাঁ, আমি আর মণিশংকর গিয়ে বসলাম খাটটাতে। আর সামনে ওই ফুলওয়ালী দিদি গৃহস্থালির কাজকর্ম করছিলেন। এই ঘর ঝাঁট দেওয়া… সকাল তো তখন, বেশি বেলা নয়, ন-টাও বাজেনি। চারপাশে যা দেখছেন তাই-ই বর্ণনা করে গেলেন উনি। নির্ভুল পয়ারে। তাও একঘণ্টার উপরে।

কুণাল: ‘গান্ধার’-এর পুরো দলই তো সেবার গেছিল?

বিপ্লব: না, ওইবার না। ওঁরা অন্য আরেকবার গেছিল। ওইবার শুধু আমি আর মণিই গেছিলাম। আগেরদিন কফি হাউসে আড্ডা মারতে মারতেই মণি বলল, চলো আমার বাড়ি। তখন তো আমাদের কিছুই ঠিক ছিল না। রাতে ওঁর বাড়ি গিয়ে থাকলাম। সকালবেলা উঠে মণির সাথেই গেলাম।

কুণাল: বিনয় কি আপনার কোনো কবিতা পড়েছিলেন?

বিপ্লব: এইসব নিয়ে কোনো কথাই হয়নি। আমার কাছে একটা চিঠি ছিল। ‘গান্ধার’ থেকে আমরা ভেবেছিলাম কিছু বই বের করব। ওই চিঠিতে লেখা ছিল, আমরা আপনার একটি বই করতে চাই। চিঠিটা খুললেন, পড়লেন, রেখে দিলেন। তারপর এই নিয়ে আর কোনো কথাই বললেন না। ‘মণিশংকর, তুমি কবে এসছ?’… মণি বলল, ‘বিনয়দা, ও আমার বন্ধু বিপ্লব। কবিতা লেখে।’… বাক্যালাপ এইটুকুই। তারপর বাকি সময়টুকু উনি পয়ারে কথা বলে গেলেন। তারপর একসময় বোঝাই গেল, উনি চাইছেন আমরা উঠে যাই।

কুণাল: এতে আপনার বিরূপ কোনো অনুভূতি হয়নি?

বিপ্লব: একেবারেই না। একজন সাধুর যখন ধ্যানের সময় হবে, তখন সে আর কাউকেই চাইবে না। সে তো রূঢ় নয়। ঠিক সেরকম। বুঝেই গেলাম আমাদের উঠতে হবে। সেই স্মৃতি আমার মনপ্রাণ ভরেই ছিল আর আছে।

কুণাল: উৎপলকুমার বসুর সঙ্গে কোনো স্মৃতি?

বিপ্লব: উৎপলদার সঙ্গে স্মৃতি বরং অনেক বেশি। তিনি কফি হাউসে আসতে পারতেন। তারপর ওঁর একটা বই আমরা ‘গান্ধার’ থেকে বের করেছিলাম। ‘নাইটস্কুল’। সেই বইটা করার সূত্রে ওঁর সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা হয় কফি হাউসের তিনতলায় বসে। মূলত সৌম্যসুন্দর মুখোপাধ্যায় আর আমি মিলে বইটার কাজ করেছিলাম। সৌম্য আমাদেরই বন্ধু। তখন প্রেসিডেন্সিতে পড়ত বাংলা নিয়ে। ওঁর সঙ্গে তারপর বিভিন্ন জায়গায় দেখা হয়েছে। রাহুলদার সূত্রে দু-একবার অটোমোবাইল ক্লাবে মদ্যপানের অভিজ্ঞতাও আছে। উৎপলকুমার বসু অনেক বাস্তব আমার কাছে। কিন্তু, বিনয় মজুমদারের সঙ্গে ওই একবারের আলাপ অতিলৌকিক একটা ব্যাপার আমার কাছে।

কুণাল: শক্তির লেখা প্রিয় কবিতা কী?

বিপ্লব: চতুর্দশপদী ভালো লাগে। আবার মাঝে মাঝে ওই কাঠামো রক্ষার জন্য একটা প্রয়াসও চোখে পড়ে। প্রথম দিকের পরপর ছ-সাতটা বই-ই ভালো লাগে।

কুণাল: কাঠামোর রক্ষার ক্ষেত্রে একটা নির্মাণচিহ্ন থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে?

বিপ্লব: দ্যাখো, বিনয় মজুমদারের ক্ষেত্রে তো হয়নি! এটা পুরোপুরি লেখকের উপর নির্ভর করে। তার অতিক্রমণের উপর নির্ভর করে। স্ট্রাকচারে লিখলেই যে প্রয়াসচিহ্ন থাকবে, এমন কখনোই নয়।

কুণাল: আপনার অনেক কবিতা অক্ষরবৃত্ত ছেড়ে বেরিয়ে এসছে। অথচ পড়ার ক্ষেত্রে, কবিতার ক্ষেত্রে কোনো অন্তরায় হচ্ছে না। ছন্দ বা ছন্দকাঠামো কি কবিতার ক্ষেত্রে অপরিহার্য মনে হয়?

বিপ্লব: না, আমি তো কখনোই করিনি। সত্যি বলতে আমার যেটুকু কবিতা রচনার শিক্ষা, তা একমাত্র কবিতা পড়া, বন্ধুবান্ধবদের কবিতা শোনা। তাছাড়া আমি নিজে কখনোই সেইভাবে ছন্দচর্চা করিনি। আর আমি লেখার পর ভাবিও না। দু-তিনবার নিজে নিজে পড়লাম। জোরে জোরে উচ্চারণ করে। পড়তে পড়তে যদি ভাবি পালটানোর দরকার, তো পালটাই। ছন্দ ব্যাপারটা নিয়ে অত ভাবিই না। শক্তির কবিতার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করছিলে। শক্তির কবিতার যে-বিষয়টা সবচেয়ে ভালো লাগে, তা হল সততা। ভিতর থেকে উৎসারিত কিছু উচ্চারণ তিনি নিবেদন করছেন বলতে পারো। আসলে শেষ কথা ওইটাই। আসলে আমরা ভাবি কবিও আমাদের মতো হাত-পা-ওয়ালা সাধারণ মানুষ। কিন্তু, কবি তার ঊর্ধ্বে। সে তো প্রকৃতির সন্তান। আমাদের সমস্যা হচ্ছে যে, কবি বলতে আমরা ভাবি, ওই তো ফেসবুকে কবিতা দেয়, অনুষ্ঠানে কবিতা পড়ে। কবি মানে শুধুই তো তা নয়। একজন কবির সঙ্গে প্রকৃতির, চাঁদ, সূর্য, আকাশের যে-যোগাযোগ— এই বিশাল জিনিসটা আমরা এই আর্বান কালচার দিয়ে ছোটো করে ফেলছি। এর ফলে কবি সম্পর্কে মানুষের শ্রদ্ধাবোধ কমে যাচ্ছে দিন-কে-দিন। কিন্তু আমি নিজের জীবনেই দেখেছি, এমন অনেকেই আছে যারা হয়তো কবিতা পড়ে না, তাদের কাছে কবি একটা বিরাট ব্যাপার, শ্রদ্ধার পাত্র। সেই জায়গাটাকে বুঝতে হবে। আর একটা কবিতা লেখা মানে, সেই কবিতাটা তার এক মুহূর্ত আগেও পৃথিবীতে ছিল না, এবং সেটা একমাত্র আমারই সৃষ্টি। আর সেটা দ্বিতীয় আর কেউ করতে পারবে না। এইটা কত বড়ো একটা ব্যাপার তুমি ভাবো। এটা একটা অত্যাশ্চর্য ব্যাপার। কবিতার ব্যাপারটাকে খুব সাধারণ পর্যায়ে নামিয়ে আনলে চলবে না। সূর্য ওঠা আর কবিতা লেখা একই ব্যাপার।

কুণাল: আপনার প্রিয় গদ্যকার কারা?

বিপ্লব: সবার প্রথমে বঙ্কিম। বঙ্কিমের লেখা আমি এখনো পড়ি। বারবার পড়ি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কিছু লেখা অসামান্য লাগে। সতীনাথ ভাদুড়ী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শহীদুল জহির। কমলকুমার মজুমদারের লেখাও আমার প্রিয়। দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটোগল্প ভীষণ ভালো লাগে। আত্মজীবনীমূলক লেখা আমাকে বেশি টানে। প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর ‘মহাস্থবির জাতক’… আহা! কী অসামান্য বই! বাংলায় বড়ো গদ্যকার অনেকেই এসছেন। সমকালীনদের মধ্যে লুৎফর রহমান তো আছেই, সাদিক হোসেনের লেখাও আমার ভালো লাগে।

কুণাল: আপনি থিয়েটার দেখেন?

বিপ্লব: হ্যাঁ, নিজেও করেছি ছোটোবেলায়। সে তো সবাই করে। তাছাড়া থিয়েটার আমি দেখি। আমি থিয়েটারের ভক্ত।

কুণাল: আপনার প্রিয় মঞ্চশিল্পী কারা?

বিপ্লব: অভিনেতাদের প্রসঙ্গে যাব না। বাংলা থিয়েটারে অনেক ভালো অভিনেতা আছে। কিন্তু, ডিরেকশনের কথা যদি বলি, মানে আমরা আগে তো দেখিনি, শম্ভু মিত্র বা উৎপল দত্তের নির্দেশনা তো দেখিনি, কিন্তু তারপরে ধরো, যখন থেকে দেখছি, অশোক মুখোপাধ্যায়ের (থিয়েটার ওয়ার্কশপ) পরিচালনা আমি দেখেছি। ওঁদের একটা প্রযোজনা ছিল ‘বেলা অবেলার গল্প’ বলে। ক্ষয়িষ্ণু কমিউনিজমের একটা গল্প। সেইখানে মায়া ঘোষ একজন অভিনেত্রী ছিলেন। উনি ‘চাকভাঙা মধু’-তেও অভিনয় করেছিলেন। যদিও সেটা আমি দেখিনি। খুবই বড়ো একজন অভিনেত্রী ছিলেন। মনোজ মিত্রের পরিচালনা বা এই ফর্মের বাইরে প্রবীর গুহ-র (অল্টারনেটিভ লিভিং থিয়েটার) কাজ আমি খুব পছন্দ করি। এখন ওঁর ছেলে বাবান (শুভদীপ গুহ) খুব ভালো সুর দিচ্ছে। ডিরেকশনের ক্ষেত্রে দেবাশিস রায়ের (থিয়েটার প্ল্যাটফর্ম) কাজ খুব ভালো লাগে। আরেকজন কাজ করছে না এই মুহূর্তে। অভিষেক বসু। ওঁদের ‘নৌটঙ্কি’ বলে একটা দল ছিল। ওঁরা ‘ঢোঁড়াইচরিত মানস’-এর প্রথম পর্বটা করেছিলেন। অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা। ওঁরা ‘দুর্গেশনন্দিনী’ করেছে। একদম অন্য মাত্রার নির্দেশনা। সুমন মুখোপাধ্যায়ের কিছু প্রযোজনা অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’, ‘মেফিস্টো’, ‘কাঙাল মালসাট’…। অতি সম্প্রতি আমার ভালো লাগছে কৌশিক করের প্রযোজনা। ‘কুকুরের লেজ’ বলে একটা নাটক করেছে। তার আগে নবারুণের গল্প অবলম্বনে ‘অটো’ বলে একটা নাটক করেছে। কৌশিকের অভিনয়ও খুব ভালো। আসলে সিনেমাই বলো আর থিয়েটার, বাস্তব সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা খুব গভীর হওয়া চাই। আমি বাংলা সিনেমা দেখি না। বলো তো বর্তমানে ক-জন নির্দেশক পাঁচ মিনিট নদীর পাড়ে গিয়ে বসেছে বা কোনো বস্তিতে গিয়ে একটা সন্ধ্যা কাটিয়েছে! তুমি যদি হিন্দি সিনেমা বলো, তাহলেও দেখবে অনেক ভালো। কিছুদিন আগেই ‘মাশান’ দেখলাম। কী সুন্দর! কত বাস্তব! ঋতুপর্ণ ঘোষের তবু সামান্য বাস্তবজ্ঞান ছিল। ‘রেইনকোট’ ভালো লেগেছে। তার আগের যত পরিচালক, ঋত্বিক ঘটকই বলো বা অন্য কেউ, প্রত্যেকেই কোনো-না-কোনো ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে উঠে আসছে। কমিউনিস্ট আন্দোলন, কেউ হয়তো ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত, শ্রমিকদের সম্পর্কে ওয়াকিবহাল… মানুষের মধ্যে থেকে উঠে আসছে। থিয়েটারের সঙ্গে জড়িত দু’টো অভিজ্ঞতা তোমাকে বলি। পরিচালনায় অভিনবত্বের দু’টো নমুনা। দেবাশিস রায়। ‘থিয়েটার প্ল্যাটফর্ম’। ওঁদের প্রথম দিকের একটা প্রযোজনা ছিল ‘তুমি কী করেছ’… বাবড়ি মসজিদ ঘটে গেছে এরকম একটা সময়… ওই নাটকে দাঙ্গা একটা বড়ো ব্যাপার ছিল… অঙ্গন মঞ্চে হচ্ছে… কোনো স্টেজ নেই, চারিদিকে দর্শকরা বসে আছে… এইবারে সেইখানে একটা দৃশ্য ছিল, দাঙ্গাবিধ্বস্ত একটা সকাল… আগের দিন দাঙ্গা হয়েছে, তারপরের দিন একটা মহল্লায় ভোর হচ্ছে… একটি মুসলিম ছেলে দুধভরা একটা গ্লাস নিয়ে আসছে… আর অন্যদিক থেকে একটা হিন্দু ছেলে… মুখোমুখি দেখা হল… কোনোরকম কথা নেই… দু-জনেরই চোখে ভয় আর ঘৃণা… হঠাৎ ওই হিন্দু ছেলেটা গ্লাসটা কেড়ে নিয়ে আচমকা মুসলিম ছেলেটার মুখের মধ্যে দুধটুকু ছুঁড়ে দিল… তার যে-এফেক্ট হল, অনেক তরোয়াল, অনেক গুলিবন্দুক দেখিয়েও এই দৃশ্যটা করা যেত না… এই বীভৎসতা দেখানো যেত না… চিরদিন মনে থাকবে… আরেকটা হল প্রবীর গুহর ‘অল্টারনেটিভ লিভিং থিয়েটার’। প্রবীরদার সঙ্গে অফিসের সূত্রে বিভিন্ন কাজ করেছি। ওঁর একটা নাটক হত… নামটা আমি ভুলে যাচ্ছি… পদাতিক থিয়েটারে হত এবং মাত্র কুড়িজনকে ঢুকতে দেওয়া হত… অন্তরঙ্গ থিয়েটার… নাটক চলাকালে হঠাৎ বলা হল, আপনারা চোখ বন্ধ করে ফেলুন… নাটকটা ছিল একজন বৃদ্ধার বয়ানে… তিনি দেশভাগের পর এপার বাংলায় এসছেন। তিনি তার নাতনিকে তার জীবনের গল্প বলছেন… ‘আর বুঝলি আমার দিদিমা ছাদের মধ্যে আচার রোদে দিত…’ আমাদের তো চোখ বন্ধ… হঠাৎ করে আমাদের ঠোঁটে আচারের গন্ধ পেলাম… আচার খাইয়ে দেওয়া হল আমাদের… আবার একটা সময় বৃদ্ধা বলছেন, ‘আমাদের পাড়ার মধ্যে একটা বেকারি ছিল, সকালবেলা চারিদিক পাউরুটির গন্ধে ম ম করত…’ আর সঙ্গে সঙ্গে ছোট্ট ওই হলটা জুড়েই পাউরুটির গন্ধ… আর দেশভাগ, রাজাকারদের প্রসঙ্গে বলছে, ‘কত মেয়ে যে তখন ধর্ষণ হয়েছে… বুঝলি?…’ বলতে বলতে উনি কাঁদছেন… আমাদের তো চোখ বন্ধ… কী হল, প্রত্যেকের মুখের সামনে এসে একটা কাপড় ফ্যাঁশ করে ছিঁড়ে ফেলা হল… পিছনে ব্যাকগ্রাউন্ডে বৃদ্ধা ধর্ষণের গল্প বলে যাচ্ছে… এটা যে কী এফেক্ট বলে বোঝানো যাবে না… ভাবো গন্ধ, স্বাদ, শব্দ— কীভাবে একটা নাটকের উপাদান হয়ে গেল… এটা কোনোদিন ভুলব না…

কুণাল: উৎপল দত্ত নাট্য-সমালোচকদের উপর খানিকটা বিরক্ত হয়েই একবার বক্রোক্তি করে বলেছিলেন যে, কলকাতার সবচেয়ে বড়ো নাট্য পরিচালক হলেন বেট্রোল্ট ব্রেখট। কেন-না, বাংলা নাটক পরিচালনায় অভিনব কোনো ইম্প্রোভাইজেশন দেখা গেলেই সবাই বলে বসতেন এটা ব্রেখটীয় রীতি। অথচ, শ্রীচৈতন্যের কথাই যদি ধরি, নবদ্বীপে পণ্ডিতদের তর্কযুদ্ধ হচ্ছে, মহাপ্রভুর ভাবসমাধি, চারিদিকে দর্শকরা গোল হয়ে বসে, কিংবা কবিয়ালরা ডুয়েল লড়তে লড়তে দর্শকদের মধ্যে ঢুকে পড়ছেন। মনে হয় না যে, থিয়েটারে এইসব পদ্ধতির উদ্ভাবন, দর্শকসজ্জা আসলে পাশ্চাত্য নয়, প্রাচ্যের অবদান?

বিপ্লব: একদম ঠিক। এগুলোর অনেককিছুই এখানকার। ভরতের ‘নাট্যশাস্ত্র’ তো এখানকারই। শূদ্রকের ‘মৃচ্ছকটিক’… আসলে তথাকথিত রেনেসাঁসের পর থেকেই শুরু হয়েছে সবকিছুকে ইউরোপীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা… আর ওই যে মধ্যবিত্ত বাঙালি শ্রেণির উদ্ভব হল… এগুলোর প্রায় কোনোকিছুই আমদানি করা নয়…

কুণাল: এবং এই যে অতীত গৌরব বিষয়ে স্বীকার করা, এটা কোনোভাবেই ভারত-অস্মিতা নয়…

বিপ্লব: তা কেন হবে! যদি মুঘলরা না থাকত, তাহলে কি ভারতীয় চিত্রকলা এই জায়গায় যেতে পারত? আবার আমি ধর্মনিরপেক্ষ বলেই কিছু বিষয়কে চেপে দিতে হবে, এটাও ঠিক না। এটাও রাজনীতি। নিজের বক্তব্যকে মান্যতা দিতে প্রায় সবাই ইতিহাস বিকৃত করছে। মুঘলরা অকাতরে অর্থব্যয় করে গেছে, অকাতরে পৃষ্ঠপোষকতা করে গেছে শিল্পের। আর শিল্পীরা তো বেশিরভাগই হিন্দু ছিল।

কুণাল: একদম…

বিপ্লব: বলা হল না… থিয়েটারের প্রসঙ্গে অচ্যুতদার (কবি অচ্যুত মণ্ডল) সঙ্গে একটা স্মৃতি মনে পড়ে। শিলিগুড়িতে সেদিন ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ হবে। সেই পুরোনো ‘নান্দীকার’-এর প্রযোজনা। কম বয়সের গৌতম হালদার। আমি তার আগে দেখেছি কোলকাতায়। দুপুরবেলা একটা বারে বসে আমি আর অচ্যুতদা মিলে বিয়ার খাচ্ছি। অচ্যুতদাকে অনেক বলা সত্ত্বেও শো দেখতে যাবে না। খুব একরোখা মানুষ। নাটক দেখে সময় নষ্ট করবে না… শেষমেশ গেলেন। আমি জোরজার করেই নিয়ে গেছি নাটক দেখাতে। একমুখ বিরক্তি নিয়ে গিয়ে বসল। তারপর কী বলব, শুরু থেকে শেষ অচ্যুতদার চোখের পাতা পড়েনি। বেরিয়ে আমাকে বলল, বিপ্লব, ‘আমি একটা উন্নাসিক লোক, এত খুঁতখুঁতে লোক কোনো কিছু বলতে পারছি না!’… মানে অচ্যুতদার এত ভালো লেগেছে (হাসি)…

কুণাল: দারুণ অভিজ্ঞতা! আচ্ছা, একজন প্রকৃত কবি বা লেখক কি নিজেকে খুন করতে চান? নিজের কমফোর্ট জোন থেকে বেরোতে চান? নাহলে ‘ফিরে এসো, চাকা’-র অমন পাঠকপ্রিয়তা সত্ত্বেও বিনয় কেন ‘অঘ্রানের অনুভূতিমালা’ লিখলেন? কিংবা ‘চিলেকোঠার সেপাই’-এর গদ্যশৈলী ছেড়ে ইলিয়াস কেন সম্পূর্ণ আলাদা ন্যারেটিভে ‘খোয়াবনামা’ লিখলেন? এই ডিপার্চার কি জরুরি? আপনার কী মনে হয়?

বিপ্লব: দ্যাখো, একজন কবি বা লেখকের জীবনই তো তার লেখা। এইবার তার জীবনে যত অভিজ্ঞতা, অভিঘাত, ঘটনাপ্রবাহ আসবে, ততই পরিবর্তন হবে। যে-কোনো অবস্থাতেই তো সে নিজেকে প্রকাশ করতে চায়। আমি যেমন নিজের ক্ষেত্রে বলতে পারি। আমার প্রথম যৌন অভিজ্ঞতা হয় ত্রিশ বছর বয়সের পরে। এবার যৌন অভিজ্ঞতার আগে আমার দেখা পৃথিবী, আর পরে দেখা পৃথিবীর মধ্যে কিন্তু আকাশ-পাতাল পার্থক্য। সেটা কিন্তু বলে বোঝানো যাবে না। কিন্তু বিশাল পরিবর্তন ঘটে গেছে আমার অবচেতনে, আমার মনোজগতের মধ্যে। আমার প্রেম সম্পর্কিত ধারণা, নারী সম্পর্কিত ধারণা সবকিছুই কিন্তু পরিবর্তিত হয়ে গেছে। নারী মানে যদি প্রকৃতি ধরি, তাহলে আমার একটা গাছকে দেখাও পালটে গেছে। আমার কোনো একটা কবিতায় আছে… ‘গাছের পাতার স্পর্শ এত রোমশ মনে হল কেন’… সত্যি একটা গাছের পাতায় হাত দিয়ে আমি রোমশ স্পর্শ টের পেলাম। তার আগে গাছের পাতার স্পর্শ আমার কাছে অন্য সজীবতা, অন্য কোমলতা নিয়ে আসত। আসলে এগুলো জীবন থেকেই উঠে আসা। জীবনের মধ্যে দিয়েই বিবর্তিত হয়ে ওঠা।

কুণাল: আপনার লেখার একটা লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট্য হল গতিশীলতা। তারা ভীষণই জঙ্গম।

বিপ্লব: আগেই বললাম না, আমার বেশিরভাগ লেখাই রাস্তায় চলতে চলতে। ‘মদ’ বইয়ের লেখাগুলো যেমন। তখন ‘একদিন’ পত্রিকাতে কাজ করতাম। তা ওই ‘একদিন’ থেকে আমাদের রাত দশটা নাগাদ ছুটি হত। তারপর একটা গাড়ি আমাদের যাদবপুর থানা অবধি ছেড়ে দিত। তারপর হাঁটতে হাঁটতে যাদবপুর স্টেশনে এসে ট্রেন ধরে সোনারপুর যেতাম। তখন সোনারপুরে থাকতাম। আমার সঙ্গে সৌম্য চক্রবর্তীও থাকত। কবি সৌম্য চক্রবর্তী। দু-জনে গাড়ি থেকে নেমে একটু চা খেতাম। হাঁটতে হাঁটতে যেতাম। ‘মদ’ বইয়ের অধিকাংশ লেখাই যাদবপুর থানা থেকে যাদবপুর স্টেশনের মধ্যে বসে হয়েছে। ওই চলমান অবস্থায়।

কুণাল: আপনার বইগুলোর প্রচ্ছদ অনেকেই করেছেন। মানস আচার্য, সঞ্জীব চৌধুরী, শুভেন্দু সরকার…। আবার ‘ভবতরঙ্গ’-এর প্রচ্ছদ আপনার নিজের করা। ‘বড়ু’ পত্রিকার অলংকরণ আপনার নিজের করা। ‘কাম’ এবং ‘তিরিশটি প্রেমের কবিতা’ বই দুটোর প্রচ্ছদও আপনার করা। ছবি আঁকার প্র্যাকটিস কি আপনার বরাবরই ছিল?

বিপ্লব: ছোটোবেলায় একটুআধটু আঁকতাম। আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা তো খুবই খারাপ ছিল। তার মধ্যে দিয়েও আমাকে একটা আঁকার ক্লাসে ভর্তি করা হয়েছিল। কিন্তু সেখানে একদিন গিয়েই বুঝলাম, ওই একসঙ্গে দশজন বসে, ওই একটা আপেল দিয়ে দিচ্ছে… সবাই আঁকছে বা একটা সূর্য আঁকো, পাহাড় আঁকো, এটা আমার ভালো লাগেনি। আমি আর যাইনি। নিজের মতোই আঁকতাম। এই প্র্যাকটিসটা স্কুলজীবনের পরে আর ছিল না। বছর বারো-তেরো আগে শিলিগুড়ি বসে সৌম্যই আমাকে বলল, বিপ্লবদা, তুমি ছবি আঁকতে আগে, আবার শুরু করো। ওই আমাকে জোর করে সমস্ত জিনিসপত্র কিনে দিল। তারপর আমি কাজে চলে গেলাম ত্রিপুরায়। ওই সময় আবার আঁকা শুরু করলাম।

কুণাল: আপনার প্রিয় চিত্রশিল্পী কারা?

বিপ্লব: ভ্যান গঘ এবং বাকিরা। দেশের ভিতরে রামকিঙ্কর এবং বাকিরা। আসলে আমাদের দেশে ক্লাস একটা ফ্যাক্টর। কে কোন শ্রেণি থেকে উঠে আসছে সেটা একটা বড়ো ব্যাপার। রামকিঙ্করের প্রকৃত মূল্যায়ন এখনও হয়নি। রামকিঙ্কর সংক্রান্ত অনেক বই আমার কাছে আছে। রামকিঙ্কর এমন শিল্পী যে তাঁকে পিকাসো ফোন করছেন। এটা লিখিত তথ্য। পিকাসো তখন মধ্যগগনে। রামকিঙ্করকে ফোন করতেন। রামকিঙ্কর তখন হয়তো মাটির কাজ করছেন বা অন্য কিছু। অফিস থেকে একজন এসে বলল, ‘স্যার, পিকাসো ফোন করেছেন!’… তখনকার দিনে ট্রাঙ্ককল, বিদেশ থেকে ফোন… রামকিঙ্কর ‘অ আচ্ছা আচ্ছা’ বলে হাত ধুয়ে, গামছা দিয়ে গায়ের ঘাম মুছে, টোকাটা মাথায় দিয়ে একটা বিড়ি ধরিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে ফোন ধরতে যাচ্ছেন। যেন কোনো ব্যাপারই না… এবং তাঁদের মধ্যে নাকি অনেক, অনেকক্ষণ ধরে কথা হত। রামকিঙ্কর পৃথিবীর নিরিখেই একজন শ্রেষ্ঠ শিল্পী। আর বিদেশে ভ্যান গঘ ছাড়া পল গগ্যাঁ, মার্ক শাগাল ভালো লাগে। মুঙ্ক আমার খুব ভালো লাগে। পল সেজান। গোইয়ার ছবি আমার খুব প্রিয়। তুলুস লোত্রেক ভালো লাগে, যাঁর জীবন নিয়ে বিখ্যাত উপন্যাস ‘মুলা রুজ’। এর বাংলা অনুবাদও হয়েছে ‘দীপায়ন’ থেকে। মানে ওই যিনি ছোটোবেলায় পড়ে গিয়ে বেঁটে হয়ে গেছিলেন, পতিতালয়ে থাকতেন। ওখানকার মেয়েদের ছবি আঁকতেন। সেইসঙ্গে ওঁর আঁকা বেশ কিছু পোস্টার আছে লিথোসে করা। মদিগ্লিয়ানিও দারুণ লাগে। ওঁর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের আঁকা নারী মুখাবয়বের কিছুটা মিল আছে। দালির কিছু ছবিও আমার ভালো লাগে। শুধু ছবি নয়, দালির জীবনও খুব টানে। যতটুকু পড়েছি, খুবই অকপট একজন লোক। দেশের মধ্যে পরিতোষ সেন, যামিনী রায়, অতুল বসুর কিছু কাজ খুব ভালো লাগে। নন্দলাল তো অবশ্যই আছেন। অবনীন্দ্রনাথ। গগনেন্দ্রনাথের কিছু কাজ অসম্ভব ভালো। রবীন্দ্রনাথও অসাধারণ। সমকালীনদের মধ্যে দীপ্তিশ ঘোষদস্তিদার, দেবনাথ বিশ্বাস, সৌরভ জানা। দীপ্তিশদার সমস্ত কাজই লো অ্যাঙ্গেল থেকে ধরা। এঁদের কাজ খুবই ভালো। পারলে কখনো দেখো। অসাধারণ কাজ করছেন!

কুণাল: ‘দূরত্ব প্রকাশন’ থেকে চিত্রশিল্পের উপর বেশ কয়েকটা বই আপনি করেছেন…

বিপ্লব: ভ্যান গঘের উপরে কাজ করেছি। গঘের চিঠি অনুবাদ করেছিলেন দেবীপ্রসাদ বসু। তারপর গগ্যাঁর জার্নাল ‘নোয়া নোয়া’। অনুবাদক অরূপরতন ঘোষ। মার্ক শাগালের আত্মজীবনী অনুবাদ করা হয়েছে। শুভেন্দু সরকারের অনুবাদ। মাইকেল এঞ্জেলোর চিঠি আর কবিতা অনুবাদ করেছিল সৌম্য চক্রবর্তী। তোমাকে দেব। মাইকেল এঞ্জেলোর কিছু কবিতা পৃথিবীর শেষ দিন অবধি পড়বার মতো কবিতা। চিরকালীন কবিতা!

কুণাল: ‘বড়ু’ পত্রিকার প্রথমে লেখা আছে ‘এ প্রয়াস আদি-মধ্যযুগের মহাকবির প্রতি এক বিনম্র শ্রদ্ধা’। এই পত্রিকা করার পিছনে আপনার কি ভাবনা ছিল? বৈষ্ণব পদাবলীর প্রতি আপনার আকর্ষণ কবে থেকে?

বিপ্লব: কর্মসূত্রে ছাতনায় থাকা একটা কারণ। স্বরাজ মিত্র ছাতনার লোক। ও একটা ভালো কাজ করছে। আসলে বড়ু চন্ডীদাসের পদ আমরা পড়ি ঠিকই, কিন্তু ওখানে এমন কিছু কিছু শব্দও আছে যার মানে আমরা ঠিক ধরতে পারি না। অনেক আঞ্চলিক শব্দ আছে যেটা বোঝা যায় না। স্বরাজ ওই পদগুলোকে একটা সহজ বাংলায় ভাবানুবাদ করার চেষ্টা করছে। অনেকটাই করেছে। ও আমার কাছে এসে বলল, চলো বিপ্লবদা, একটা পত্রিকা করি। সুতরাং, এই পত্রিকার পিছনে স্বরাজের একটা বড়ো ভূমিকা আছে। চণ্ডীদাসের জন্মস্থান নিয়ে বিতর্ক আছে, কিন্তু আমরা যখন ছাতনায় আছি, তখন ছাতনাকে কেন্দ্র করেই না হয় শুরু হোক… তাছাড়া ‘কৃত্তিবাস’ নামে যদি কোনো পত্রিকা হতে পারে, তাহলে ‘বড়ু’ নামেই-বা হতে পারবে না কেন! (হাসি)… আর বৈষ্ণব পদাবলীর প্রসঙ্গে বলি… বই তো কিনতে পারতাম না। কিন্তু ওই লাইব্রেরি… জ্ঞানদাসুন্দরী গ্রামীণ গ্রন্থাগার… নানারকম বই তুলতাম, পড়ে ফেরত দিতাম। এই করতে করতে ‘বৈষ্ণব পদাবলী’… হয়তো বুঝতে পারছি না, কিন্তু ওর যে ধ্বনিমাধুর্য, সেইটা তো একটা আকর্ষণ করত… আর আমার বরাবরই একটা অভ্যাস ছিল খুব জোরে জোরে পড়া। এইবার বৈষ্ণব পদাবলীর ওই সংকলনটা নিয়ে এসে, বোধহয় হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়… রাজ্য পুস্তক পর্ষদেরও একটা সংকলন ছিল, চটি সংকলন… ছোটোবেলায় তো না বুঝেই জোরে জোরে পড়ছি… ক্লাস ফাইভে তখন… বই নিয়ে এসে জোরে জোরে পড়ছি… তারপর যেমন গিরীশ রচনাবলী নিয়ে এসে ‘আবু হোসেন’ নাটকটা পড়ছি। ওই যে আছে না আবু হোসেন হঠাৎ করে খুব বড়োলোক হয়ে গেছে… জীবনযাপন পালটে গেল… সেইখানে একটা সংলাপ ছিল… ‘হুইস্কি লে আও, ব্রান্ডি লে আও…’ এবার আমি তো হুইস্কি চিনি না, ব্রান্ডি চিনি না, পিছন থেকে সপাট করে একটা থাপ্পড়। বাবা! বৈষ্ণব পদাবলীর ক্ষেত্রে একটা কথা মনে আছে। ‘এমন পিরীতি কভু নাহি দেখি শুনি/পরাণে পরাণে বান্ধা আপনা আপনি’… আমি তো এর মানেও বুঝি না… এবার ‘পিরীতি’ তো আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজে শুচিতার প্রশ্নে যায় না (হাসি)… বেমক্কা এক থাপ্পড় খেলাম মায়ের কাছে… এই বয়সে ‘পিরীতি’ আবার কী কথা (হাসি)…

কুণাল: আপনি ২০২০-তে দাঁড়িয়ে বৈষ্ণব পদাবলীর এক দিকপাল কবিকে নিয়ে কাজ করছেন। আবার কেউ হয়তো চর্যাপদ নিয়ে কাজ করছেন। আপনার কি মনে হয়, কবিতায় আধুনিকতা আদৌ ভাষা, প্রকরণ ও সময়ের উপর নির্ভর করে? কেউ কি চর্যাপদের ভাষাতে বর্তমানে কবিতা লিখতে পারে?

বিপ্লব: আধুনিকতা বিষয়টাই আপেক্ষিক। বর্তমানে যা আধুনিক, আজ থেকে পনেরো বছর পরে তা আধুনিক নাও থাকতে পারে। আর পুরোপুরি চর্যাপদের ভাষাতে এখন লেখা হয়তো যাবে না, কিন্তু কুশলী গদ্যকার বা প্রতিভাবান কবি তাঁদের লেখায় ওই ঘরানার প্রয়োগ করতেই পারেন। রবীন্দ্রনাথ তো ‘ভানুসিংহের পদাবলী’-কে অনেকটা আধুনিক করেই লিখেছেন। আর গীতিকাব্য হিসেবে তার যথেষ্ট মূল্য আছে। আবার যদি বাংলা গানের কথা বলো, ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ কিংবা কবীর সুমনের চেয়ে আধুনিক কিছু কি এতদিনেও তৈরি হয়েছে!

কুণাল: আপনি কখনো শিশুসাহিত্য লেখার কথা ভেবেছেন?

বিপ্লব: বহুবার ভেবেছি। অফিসে কাজের সূত্রে একবার করতে হয়েছে। রায়বেশে নাচ, পুতুল নাচ— বাংলার এইসব লোকায়ত শিল্পগুলোকে বইয়ের আকারে বাচ্চাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমাদের কিছু বইয়ের সিরিজ আছে। বাংলা, ইংরেজি দুই ভাষাতেই। সেই প্রোজেক্টের সূত্রেই একটা গ্রাফিক নভেল লিখতে হয়েছিল। ‘লালন নামে মানুষটি’। বড়ো ক্রাউন সাইজের কুড়ি পাতা। ছোটো কাজ। তাছাড়া জীবনানন্দের জীবনকথাকে ছোটোদের উপযোগী করে লেখার ইচ্ছে বহুদিন ধরেই আছে। আমাদের মধ্যে এত বিপুল ক্লেদ চলে এসছে… এর থেকে মুক্তি না পেলে ছোটোদের জন্য কাজ করা সম্ভব নয়। সত্যি বলতে ছোটোদের নিয়ে কাজ করতে গেলে আগে ছোটো হতে হয়। ছোটোদেরকে বড়োদের সমান, এমনকী তার চেয়ে বেশি মর্যাদা দিয়ে কাজ করা উচিত।

কুণাল: আলাদা করে আত্মজীবনী লিখতে চান?

বিপ্লব: আত্মজীবনী কিনা জানি না, তবে একটা লেখা লিখছি। এ-ফোর শিটের হিসেবে চল্লিশ পাতা লেখা হয়ে গেছে। টুকরো টুকরো গদ্য। যেমন ছোটোবেলার বিভিন্ন স্মৃতি, বাউল-ফকিরদের আখড়ায় ঘোরার কথা… এইসব।

কুণাল: কীরকম?

বিপ্লব: যেমন ছোটোবেলায় তেনজিং নোরগেকে দেখার স্মৃতি। ক্লাস ফোরে পড়ি। বাবার সঙ্গে শিলিগুড়িতে বাজার দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। হঠাৎ বাবা বললেন, ‘সামনের ওই লোকটা কে বলতো?’… আমি বললাম, ‘কে?’… বাবা বলল, ‘তেনজিং নোরগে!’… আমি সাথে সাথে ছুটে গিয়ে দেখছি। ততদিনে ওঁর কথা পাঠ্যপুস্তকে পড়া হয়ে গেছে। একটা ভারী জ্যাকেট পরা, সঙ্গে আরো কেউ একজন ছিল। হেঁটে যাচ্ছিলেন। আসলে তেনজিং নোরগে দার্জিলিঙে থাকতেন। তখন আরো বেশি শীত পড়ত। শীতের ওই তিনমাস পাহাড়ের লোকজন শিলিগুড়ি নেমে আসত। তেনজিংও সম্ভবত ওভাবেই এসেছিলেন। এইরকম টুকরো টুকরো লেখা আর কী!

কুণাল: ‘এসথেটিক থিয়েটার’-এর যে ট্যাগলাইন ‘আর্ট ফর আর্ট’স সেক’, অর্থাৎ নন্দনতত্ত্ব, তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে সমাজমনস্ক শিল্পীরা বলেছিলেন, শিল্প শুধুই শিল্পসৃষ্টির আনন্দেই তৃপ্ত থাকবে না, মানুষের কল্যানের কথাও ভাববে। বোদল্যেরও বলছেন, ‘একজন সমালোচক কবি হয়ে উঠলে তা অস্বাভাবিক। অন্যদিকে কবির ভিতর যদি একজন সমালোচক জেগে না ওঠে, তা আরও অস্বাভাবিক।’
… আপনার কী মত?

বিপ্লব: দ্যাখো, সুভাষ মুখোপাধ্যায় বা সুকান্ত ভট্টাচার্য… এঁরা তো সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আর তখন সবে একটা নতুন রাজনৈতিক মতবাদকে এই দেশে প্রতিষ্ঠা করার কাজ শুরু হচ্ছে। ওঁরা কিন্তু মাঠে নেমে কাজ করেছেন। ওঁদের লেখায় কোথাও কোথাও যদি শিল্পগত গুণ কিছু কমও থেকে থাকে, তাতেও কিন্তু কিছু যায় আসে না। সততা ও আন্তরিকতা ছিল। ওঁরা কেউ-ই কিন্তু ড্রয়িংরুমে বসে হুইস্কি খেতে খেতে চটকলের শ্রমিকদের জন্য লেখেননি। আর ‘আর্ট ফর আর্ট’স সেক’ কিংবা এর বিপরীতে শুধুই বার্তামূলক শিল্প— কোনোটাই পুরোপুরি ঠিক নয়। আগে আমাদের দেশেই যে বিভিন্ন কথকতা, পালাগান, লোকনাট্য হত, সেগুলো সবই ভীষণ পলিটিক্যালি কনশাস ছিল এবং শিল্প হিসেবেও উৎকৃষ্ট ছিল। ধরো মালদার জেলার যে গম্ভীরা পালার গান… জরুরি অবস্থার সময় সেই গানের ভিতরে, অভিনয়ের ভিতরে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, ইন্দিরা গান্ধীর নাম করে, চরিত্র বানিয়ে জরুরি অবস্থার তীব্র বিরোধিতা করা হচ্ছে। এত এত মানুষ, আবালবৃদ্ধবনিতা সেই পালা দেখতেও যাচ্ছে। অর্থাৎ তার মধ্যে শিল্পগুণও আছে। চারণ কবি মুকুন্দ দাস মাঠে-ঘাটে গান করে ইংরেজ শাসনের বিরোধিতাকরছেন। তার মধ্যে শিল্পগুণ ছিল বলেই মানুষ শুনত। শুধুই বার্তা দিলে তো আসত না মানুষ। বার্তা আর শিল্পগুণ— দুটোই মিলেমিশে থাকতে হবে। কবিতার মধ্যে রাজনীতি না থাকলে কবিতাও হবে না। সবকিছুই রাজনীতি। রাজনীতি তো কেবল একটা দল, মত তা নয়। এই যে গোটা পৃথিবী একটা ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে… এই যে প্রকৃতিকে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে, সেটা একটা বড়ো রাজনীতি। এখন একজন কবি যদি প্রকৃতির কথা বলেন, একটা ফুল নিয়ে কবিতা লেখেন, সেখানে শুধু ফুলটার সৌন্দর্য বর্ণনা করলেও তার মধ্যে রাজনীতি ঢুকে পড়বে। এটাও একটা প্রতিবাদ। বিপন্নতার বিরুদ্ধে এটাও একটা শিল্প। এটাই বুঝতে ভুল করা হয়। আসলে অধিকাংশ মানুষ সবকিছুকে প্রত্যক্ষভাবে বুঝতে চায়, পোস্টার হিসেবে দেখতে চায়। সংকেতধর্মিতাকে বুঝতে পারে না। এমনকী কংগ্রেস তার জাতীয় অধিবেশনে ডেকরেশনের দায়িত্ব দিচ্ছে নন্দলাল বসুকে। তার মানে নন্দলালের এসথেটিক সেন্সের পাশাপাশি রাজনৈতিক জ্ঞান ছিল। উনি তো শুধু হাত চিহ্ন এঁকে বসে থাকবেন না! (হাসি…) তুমি সোমনাথ হোড়, চিত্তপ্রসাদের মতো বলিষ্ঠ শিল্পীদের কথা ভাবো! কী ভীষণ পলিটিক্যাল ওঁদের ছবি! ওঁরাও পোস্টার এঁকেছেন। তবে তা শুধুই বার্তা হিসেবে সীমাবদ্ধ নয়। আমাদের ছোটোবেলায় ভারতীয় গণনাট্য সংঘের অনেক নাটক ছিল। অসম্ভব শিল্পগুণসম্পন্ন নাটক। শুধুই জমিদার খতম হচ্ছে, কৃষক জিতে যাচ্ছে, এমন না। আসলে অনেক লেখক-শিল্পীই মধ্যবিত্ত মানসিকতার লোক। সে না বোঝে জমিদারকে, না বোঝে কৃষককে। বাস্তব থেকে বিচ্যুত হলেই সমস্যা!

কুণাল: বিপ্লবদা, আপনার সবক-টি বইয়ের উৎসর্গের ভিতর ‘আহার-পানি’ বইয়ের উৎসর্গটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য… ‘ইলামবাজারের সেই বৃদ্ধ বাপজানকে’… কে এই বাপজান?

বিপ্লব: তখনও তো জানি না ‘আহার-পানি’ নামে বই হবে… একটা কাজে বীরভূম গেছিলাম… ওই ইলামবাজার… বিডিও অফিসে একটা প্রোগ্রাম হবে মেয়েদের নিয়ে যারা কাঁথাস্টিচের কাজ করে… গ্রামাঞ্চলের মহিলারা বাড়িঘর, সংসার সবকিছু সামলে তো আসে… তা সময় পেরিয়ে গেছে… ওরা আসছে না… উলটো দিকে একটা চায়ের দোকান, বিডিও অফিসের ভিতরে যেমন হয়… বেঞ্চে বসে চা খাচ্ছি… আরও কিছু লোকজন আছে… একটা রাস্তার কুকুর আদর করেই সামনের দুই পা দিয়ে আমার গায়ে উঠে পড়ছে… আমি কুকুর যে খুব একটা পছন্দ করি তা নয়, আবার ভালোবাসি না তাও নয়… এমনকী কোনো বাড়িতে চেনবাঁধা বিলেতি কুকুর আছে জানলে আমি সে-বাড়িতে যাই না… কিন্তু রাস্তার কুকুর আমি ভালোবাসি… কিন্তু গায়ে ওঠায় আমার একটু অস্বস্তি আছে… আমি তো আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছি… আমার উলটো দিকে এক বয়স্ক মুসলিম ভদ্রলোক বসে ছিলেন… খুবই বয়স্ক… বাবার বয়সী… উনি খুব মিষ্টি করে, এত মধুর কণ্ঠস্বরে, অত সুন্দর যে মানুষের কণ্ঠস্বর হতে পারে ভাবাই যায় না… আমাকে হঠাৎ বললেন, ‘বাবাআআআ… ও কিছু না… ওকে একটু আহারপানি দিন… ও একটু আহারপানি চায়…’ ভাবো তুমি, ভাষাটা কী সুন্দর! ওই যে শব্দটা পেলাম, ভদ্রলোকের তো আর নাম জানি না… ওঁকেই উৎসর্গ করা…

কুণাল: এই বইয়ের প্রবেশক লেখা হিসেবে একটা উদ্ধৃতি ছিল, ‘দেখ, আমি দ্বারে দ্বারে দাঁড়াইয়া আছি/ও আঘাত করিতেছি; কেহ যদি আমার/রব শোনে ও দ্বার খুলিয়া দেয়, তবে আমি তাহার সহিত ভোজন করিব, এবং সেও/আমার সহিত ভোজন করিবে।’

বিপ্লব: হ্যাঁ, প্রভু যীশু, প্রকাশিত বাক্য ৩:২০। নিউ টেস্টামেন্ট!

(এরপর ফোনের লাইন কেটে যায়। মঞ্চের মতোই যবনিকা নামে। কার্টেন কল! একে একে ঢুকে পড়ে উচ্চারিত কথা, শব্দ, স্মৃতি… অনুল্লেখিত কিছু মেঘ, কাশফুলের বন্ধু…)

 

Facebook Comments

আলাপচারি: কুণাল বিশ্বাস

কবি বিনয় মজুমদারের স্মৃতিপুষ্ট ঠাকুরনগরে বাড়ি। প্রেম: কলনবিদ্যা। এর আগে ‘এই সময়’ কাগজে রিপোর্টাজ ঘরানায় কিছু গদ্য, ‘কৌরব অনলাইন’, ‘এই সহস্রধারা’ ও ‘হাওয়া ৪৯’ পত্রিকায় কয়েকটি গল্প, ‘ভাষালিপি’, ‘সর্বনাম’ ইত্যাদি পত্রিকা এবং ‘চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম’, ‘আপনপাঠ’ ও ‘চলভাষ’ ওয়েবজিনে গুচ্ছ কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত কবিতার বই: ‘ভ্যান গঘের প্রিয় রঙ’ (ভাষালিপি)।

 

পছন্দের বই