লেখক নয় , লেখাই মূলধন

করোনার দিনগুলিতে: মনোরঞ্জন ব্যাপারী

সামনে সময় ভয়ংকর

আমি ভালো নেই। মাথার মধ্যে সব-সময় দুশ্চিন্তা, রাতে ভালো ঘুম হয় না। চোখ বুজলেই ধেয়ে আসে নানান দুঃস্বপ্ন। প্রেশার সুগার খুব বেড়ে গেছে। আমি জানি কোভিদ-১৯-এর আক্রমনে কেউ আর ভালো থাকার কথা নয়। যিনি শারীরিকভাবে আক্রান্ত হননি, মানসিকভাবে চূর্ণ হয়ে আছেন। সময় সবার বুকের উপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে আছে। যা থেকে আর কোনোদিন নিস্তার মিলবে কিনা আমরা কেউ জানি না।

গোটা দেশে প্রায় দু-মাস হতে চলল লকডাউন চলছে। এটা জানা কথা প্রত্যেকটা মানুষের জীবনই অতিষ্ঠ। ঘরবন্দী থেকে হাঁপিয়ে উঠেছে সবাই। তবে এই অবস্থার জন্য আমি শাসকদের কোনো দোষারোপ করব না। কারণ, সব দিন শাসকশ্রেণি যা করে তা তার নিজের স্বার্থের জন্য করে। ভাষণে বক্তৃতায় যতই বলাবলি করা হোক-জনগণ ব্যাপারটা এখানে গৌন—। পাবলিককে বাছাই করার সময় দেখে নিতে হবে কে তার মিত্র কে নয়। ভুল বা অপরাধ যদি করে থাকে সে পাবলিক করেছে। তার পাছায় আছোঁলা সে নিজে আমন্ত্রণ করে এনেছে— তাই আর কেউ নয়, আমি বলব এর জন্য সম্পূর্ণ দায়ী দেশের অধিকাংশ নির্বোধ লোভী স্বার্থপর হিংস্র অপরের অনিষ্টকামনাকারী মন্দবুদ্ধির পাবলিক। যে জানে না অপরের জন্য কুয়ো খুঁড়লে নিজেই সেই কুয়োয় পড়ে মরতে হয়।

একজন বিখ্যাত দার্শনিক বলেছেন— দেশের মানুষ ঠিক তেমনই শাসন পায় যেমন শাসনের সে যোগ্য। এই দেশের পাবলিক ঠিক যেমন তার ভাগ্যে তেমন শাসকই জুটেছে। সে যদি বোধবুদ্ধি সম্পন্ন বিচক্ষণ আর সৎ হত তাহলে তেমন শাসকই পেত। এর পরিণতিতে যা হবার তাই হবে— তাই হচ্ছে। বুদ্ধিমান পাবলিককে কে বোঝাবে যে— শাসকশ্রেণির কাছে তোমার মতো মানুষের মূল্য একটা অচল টাকার চাইতে বেশি কিছু নয়। বারবার সব সরকার এই কথাটা বলতেই থাকে ‘দেশে জনসংখ্যা খুব বেড়ে গেছে। বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য দেশের বিকাশ হচ্ছে না’। তুমি সেই বর্ধিত উদ্বৃত্ত আগাছা ছাড়া বিশেষ কিছু নয়। যে-আগাছা উপড়ে গেলে, নিকেশ হয়ে গেলে তাদের কিছু ছেঁড়া যাবে না।

যে-কারণে দেশের চিকিৎসা খাতে বাজেট রাখা হয় নাম মাত্র। সরকার জানে— যাদের কাছে পয়সা আছে তারা বেসরকারি হাসপাতাল নার্সিংহোমে গিয়ে উন্নত চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারবে— সরকারি হাসপাতালে ওষুধ থাকুক বা না-থাকুক, ডাক্তার থাকুক বা না-থাকুক তাদের কিছু আসবে যাবে না। মরলে মরবে মাত্র গরিব-গুরবো-আগাছা। এতে খানিক জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আসবে। তাই সরকার গরিব নয় যা কিছু উদ্যোগ নেয় তা বড়োলোক বাঁচাবার জন্য। আপনাদের অনেকের জানা নেই— পিয়ারলেস, কেপিসি, মেডিকা, আর এন টেগোর হাসপাতাল— গরিব চাষীদের উৎখাত করে গরিব দরদী বামফ্রন্ট সরকার ওই সব যে-বিশাল বিশাল ভূখণ্ড বিত্তবান বেওসায়িদের বিক্রি করেছিল তার দাম কত নিয়েছিল! এক টাকা— সঠিক পড়ছেন, মাত্র এক টাকায় বিক্রি করা হয় পঁচিশ ত্রিশ পঞ্চাশ একর জমি ওই বাবু ভদ্দরদের চিকিৎসা কেন্দ্র বানাবার জন্য।

আজ করোনাকেও পরিকল্পনা অনুসারে ওই জনসংখ্যা হ্রাসের নিমিত্তে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোন দেশের ল্যাবেটারিতে একে জন্ম দেওয়া হয়েছে, কী উদ্দেশ্যে একে ব্যবহার করা হবে সে এখনও ভবিতব্যের গর্ভে গোপন—। কিন্ত আমাদের দেশের শাসকশ্রেণি একে পেয়ে গেছে ‘ভগবানের আশীর্বাদের মতো’ নিজেদের ত্রাণকারী হিসাবে। দেশে আজ খাদ্য বস্ত্র শিক্ষা চিকিৎসা বাসস্থান বেরোজগারী হাজার একটা সমস্যা। দেশের ব্যাঙ্ক ফাঁকা করে একের পর এক গুজরাতি ভাই লক্ষকোটি টাকা নিয়ে বিদেশে পালাচ্ছে, দ্রব্যমূল্য মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে, যা নিয়ে দিকে দিকে মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে। তারপর আবার সিএএ, এনপিআর, এনআরসি নিয়ে যে-হাজার হাজার গণ আন্দোলন— সব এই করোনা দিয়ে সুন্দরভাবে চাপা দেওয়া গেল। সর্বোপরি জনসংখ্যা সেটাও দ্রুত হ্রাস করা যাচ্ছে।

ভারতে লকডাউন ঘোষণা করা হয় মার্চের ২৪ তারিখে। কিন্ত ভারত শাসকদের কাছে খবর ছিল— সারা বিশ্বের লোক পত্র-পত্রিকায় টিভিতে খবর পাচ্ছিল যে, জানুয়ারি থেকে চিনে করোনা আক্রমণে ধ্বস্ত হয়ে যাচ্ছে। সে-খবর জেনে— যারা মানুষকে উদ্বৃত্ত আগাছা মনে করে না— মানুষকে দেশের সম্পদ বলে মনে করে— তেমন দেশ— যার মধ্যে কিউবা ভিয়েতনাম এমনকী যার নিন্দা না করে অনেকে জল মুখে তোলে না সেই উত্তর কোরিয়া প্রতিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। সারা বিশ্ব যখন চৌপাট হচ্ছে ওই সব দেশে কিন্তু করোনা কোনো ক্ষতি করতে পারছে না।

আর আমাদের মহান ভারত নেতারা কী করলেন? যদি আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল বন্ধ করে দিতেন, অথবা এয়ারপোর্টেই তাদের চেকআপ করে কোরেন্টাইন সেন্টারে পাঠাতেন সারাদেশে মহামারী ছড়াতে পারত না। তারা সেটা তো করলেনই না, উলটে আমেরিকার বিরাট সংখ্যক করোনা সংক্রামিত লোককে আদর করে অতিথি বানিয়ে আমাদের দেশে নিয়ে এসে— নমস্তে ট্রাম্প করলেন। ফলাফল কী হল? আজ আমেদাবাদ করোনা আক্রমণে বিধ্বস্ত।

এরা চাইলে নিজামুদ্দিনে তবলীগ জামায়েত করতে পারমিশান না দিতে পারতেন, চাইলে উত্তরপ্রদেশে রামনবমীর মিছিল বন্ধ করে দিতে পারতেন। মানুষের জীবন যাদের কাছে মূল্যবান মানুষকে যারা ভালোবাসে— দেশের সম্পদ মনে করে তার হলে অবশ্যই তাই করত। কিন্তু এরা? এদের তো উদ্দেশ্য ছিল অন্য কিছু, তাই করোনাকে ছড়িয়ে দিতে যা যা করা দরকার সেটা নিপুণভাবে করে দিয়েছে।

ভাবা যায় যখন দেশের এই ভয়াবহ সময়ে যখন হাসপাতালে পর্যাপ্ত পরিমানে চিকিৎসা উপকরণ নেই, দেশের প্রধান সেজেগুজে এসে টিভিতে মানুষকে নানা রকম বাণী প্রবচন দিচ্ছে— মাঝে মাঝে দিচ্ছে, কিন্তু চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নয়নে উনি কী করবেন কিছু বলছেন না। বলতে পারছেন না। থালা বাজাও হাতে তালি দাও মোমবাতি জ্বালাও— এ-সব দিয়ে যে করোনাকে প্রতিরোধ করা যায় না তা উনি জানেন। তবু নির্বোধ মানুষকে মাতিয়ে দিচ্ছেন ওই ছ্যাবলোমো বাদরামো করতে। ভাবা যায়— দেশের নানা প্রান্তে লক্ষ লক্ষ মজদুর আটক হয়ে আছে, তাদের কীভাবে দ্রুত ঘরে ফেরানো হবে তার কোনো পরিকল্পনা নেই, যদি-বা একটা দুটো ট্রেন চালু করা হল যার ভাড়া পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি। দীর্ঘ দু-মাস পরভূমিতে যে-মানুষ আটক, যার কাছে খাবার মতো সামান্য পয়সা নেই তাকেও সেই বাড়তি ভাড়া দিয়ে টিকিট কাটতে বাধ্য করা হচ্ছে। অথচ আট সাড়ে আট কোটি টাকার ফুল ছড়িয়ে দেবার মতো নির্বুদ্ধিতা করতে ওনাকে ভাবতে হয় না।

আমাদের এই যে দেশ— তৃতীয় নয়ন তীব্র না হলে যে দেশ দেখা যাবে না। এই একটি দেশের মধ্যে জড়াজড়ি করে রয়েছে একসঙ্গে ভিন্ন নামের তিন-তিনটি দেশ। যাদের ভাষা সংস্কৃতি পরিচ্ছদ আর্থিক ও মানসিক অবস্থান আকাশ পাতাল ব্যবধান। ভারত, ইন্ডিয়া ও হিন্দুস্থান। এই তিন দেশে তিন রকমের বাসিন্দার বসবাস।

ইন্ডিয়ার যারা বাসিন্দা, চলতে গেলে দেশের তামাম সুবিধা যাদের কুক্ষিগত। দেশের সরকার যাদের কথা মাথায় রেখেই সব যোজনা বানায়। তারা ভালো খায়, ভালো পরে, ভাল স্কুলে পড়াশোনা করে, গলায় টাই বাঁধে আর জলের মতো ইংরাজিতে ‘টক’ করে। তারা পারতপক্ষে কোনো ভারতীয় ভাষায় কথা বলতেই চায় না। তারা বাসে ট্রেন ট্রামে নয়, আসা যাওয়া করে প্লেনে— নিজস্ব মোটরকারে। কারো কারো আবার নিজস্ব চাটার্ড প্লেন আছে। এই যে লকডাউন— দেশের নানা প্রান্তে আটকে পড়া শ্রমিকদের নিয়ে সরকারের কোনো মাথা ব্যথা নেই। কিন্তু এরা চাওয়া মাত্র এদের জন্য সরকার হাওয়াই জাহাজ পাঠিয়ে ফিরিয়ে আনতে তৎপর হয়ে ওঠে।

জনসংখ্যার নিরিখে এরা অতি ক্ষুদ্র একটা অংশ। মাত্র এক শতাংশ। অথচ এই ১ শতাংশ মানুষ, যাদের হাতে আজ দেশের ৭৩ শতাংশ সম্পদ কুক্ষিগত। সরকারি সহায়তায় যারা বাকি ২৭ শতাংশ সম্পদ হাতিয়ে নেবার জন্য নিত্য নতুন ফন্দি ফিকির আটছে—। যারা মনে করে এই ভূভাগের জল জঙ্গল জমিন আকাশ সব তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি। একে দোহন দলন শোষণ ধর্ষণ— যেমনভাবে যা খুশী ব্যবহার করার অধিকার একমাত্র তাদের। মানুষকে উৎখাত উচ্ছেদ এমনকী হত্যা করাও তাদের অধিকারের মধ্যে পড়ে। বলতে গেলে এদের হাতে এত ক্ষমতা যে, এরা যে-কোনো সময় যে-কোনো সরকার গড়তে বা ফেলে দিতে পারে। সরকার এরাই বানায়, সরকারকে এদের আদেশ নির্দেশ মেনে— সেবা করেই টিকে থাকতে হয়। তা না হলে আজ যে দোর্দণ্ড প্রতাপ মন্ত্রী কাল সে ফুটপাতে বাটি পেতে বসে থাকবে।

সেইসব আজ্ঞাবহ রাজনেতা যাদের একমাত্র কাজ এদের স্বার্থরক্ষা করা। ওরা যাদের চাকর বাকর— হিসাবে গণ্য করে। সেবায় সন্তুষ্ট হলে যে যেমন উপযুক্ত তাকে সেই রকম পদ ও পারিশ্রমিক প্রদান করে। সেই রাজনেতাদের সঙ্গে— পিছনে সাথে আছে কিছু আছে ভেড়াতুল্য নির্বোধ ‘জনগণ’। সেই ভেড়া যার একটাকে কান ধরে টেনে নিয়ে গেলে বাকিগুলো যায় পেছন পেছনে। যাচ্ছে যে হাড়িকাঠে গলা দিতে সেটা এরা ভাবতে বুঝতে পারে না। হাতে কচি কাঁঠালপাতা দেখে কষাইকেও এরা পরম মিত্র মনে করে।

দেখতে পাচ্ছেন আজ সারা দেশের অবস্থা? যারা কাল ভোট দিয়ে সরকার বানিয়েছিল আজ কী রকম রাস্তায় পিটুনি খাচ্ছে? চোর নয় ডাকাত নয় ধর্ষণ করেনি কাউকে— মাত্র অনাহার সহ্য করতে না পেরে হেঁটে হেঁটে নিজের ঘরে ফিরতে চেয়েছিল। সেই অপরাধে কীভাবে পিটিয়ে পিঠের ছাল তুলে দিয়েছে। মাত্র পথে হেঁটে যাবার জন্য ঘুষ দিতে হচ্ছে! কাউকে আবার কান ধরে উঠ বস করতে হচ্ছে। মহিলা বলেও রেহাই মিলছে না। মজার ব্যাপার আজ যদি আবার ভোট হয় ভোটে কিন্ত ওরাই জিতবে। এই এরাই গিয়ে ভোট দেবে যারা পিঠের ছাল তুলেছে তাদের।

এদের সঙ্গে আছে আর কিছুজন— যারা উচ্চপদের চাকুরিরত আমলা অফিসার। বলতে গেলে গোটা ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ আছে যাদের মুঠিতে। এদের এক-একজনের এত ক্ষমতা যে, চাকর হয়েও ক্ষমতা বলে প্রধানমন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ার পর্যন্ত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে দিতে পারে। সেই যেমন এক ইঁদুর মুনির বরে বাঘ হয়ে মুনিকে খেতে গিয়েছিল, যদি কোনো রাজনেতা ক্ষমতা মদে মত্ত হয়ে ওই পুঁজিপতি শ্রেণির ক্ষতি সাধন করার চেষ্টা করে, তাকে এই বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন সরকারি অধিকারী দ্বারা ক্ষমতচ্যুত এমনকী কারাবাসের ব্যবস্থাও করা হতে পারে। আর আছে কিছু এদের বেতন প্রাপ্ত— পত্র-পত্রিকা টিভির প্রভাবশালী সাংবাদিক। রাতদিন যারা মালিকের আদেশ নির্দেশ অনুসারে প্রচার প্রসার চালাতে থাকে। আপাতভাবে এরা একটা নিরপেক্ষতার মুখোশ পড়ে থাকলেও সব ওই ইন্ডিয়ান মালিকের ভৃত্য, চাকর-বাকর সেবাদাস।


যারা ভারত নামক দেশের বাসিন্দা তারা— কল কারখানায় উৎপাদন করে, ক্ষেত খামারে ফসল ফলায়, খনি খাদানে ঘাম ঝড়ায়, নদী নালায় মাছ ধরে মানুষের পুষ্টির যোগান দেয়। বলতে গেলে এদেরই শ্রমে ঘামে সচল থাকে সমাজ জীবন। অথচ এরা পেট ভরে খেতে পায় না, পায়ে চপ্পল গায়ে জামা দিতে পারে না। অস্বাস্থ্যকর ঝুপড়ি বস্তিতে গ্রামে গঞ্জে গাদাগাদি হয়ে থাকে। রোগ ব্যাধি হলে বিনা চিকিৎসায় মরে যায়। কোনো সরকারি সহায়তা এদের দুয়ারে যায় না। কোনো সরকারি বাবু এদের খোঁজ খবর নেয় না। অঞ্চলের নেতা খোঁজ করে মাত্র ভোট দেবার সময়ে। বাকি বাদ সময়ে এরা অবাঞ্ছিত— উদ্বৃত্ত। আরও একটা মজার ব্যাপার— এরা কিন্তু নিজের ভালোও বোঝে না। নিজের সর্বনাশ নিজে করায় এরা সিদ্ধ হস্ত। যে এদের উপকার করবে এরা তার গলাই টিপে দেবে। বলা চলে আজকে তাদের যে-পরিস্থিতি সে তাদের নিজেই আহ্বান করে আনা।


আর হিন্দুস্থানের যারা বাসিন্দা— তাদের এক-একটার ছোটো হাতির মতো নাদুস নদুস গতর। কোনো কাজকর্ম করে না। গলায় পৈতে ঝুলিয়ে মন্দির মঠে আশ্রমে বসবাস করে, ঘি দুধ ননী মাখন খায়। পুজাপাট কেত্তন ভজন নিয়ে থাকে আর সাধারণের অবোধ্য সংস্কৃত ভাষায় প্রবচন দেয়। বলা বাহুল্য এদেরও পদলেহনকারী উচ্ছিষ্ট প্রসাদভিক্ষু কিছু নির্বোধ মানুষও আছে। গুরুর পা ধোয়া জল তো খায়ই— যাদের গোরুর গু মুত খেতে দিলেও অমৃত ভেবে বিনা প্রশ্নে খেয়ে নেয়।

এই যে যারা ইন্ডিয়ান— এরা বলে— সারে জাঁহাসে আচ্ছা— আমরা এক গর্বিত দেশের নাগরিক। আমাদের দেশ সবার সেরা, সবার চেয়ে উঁচা। মহান এক দেশনেতার শাসনে ইন্ডিয়ার শির বহু উচ্চে আরোহন করতে সক্ষম সমর্থ হয়েছে। কারণ, উনি যে-মুর্তি স্থাপন করেছেন গোটা পৃথিবীতে এত বিশাল উচ্চমূর্তি আর কোথাও নেই। মূর্তির সঙ্গে সঙ্গে ইন্ডিয়ার নামও মহাকাশ ছুয়ে ফেলেছে।

ভারতের কিছু চিন্তাশীল বাসিন্দারা বলছে, মূর্তি তো আকাশ ছুঁয়েছে, কিন্তু এই মহান নেতার শাসনে সাত সাড়ে সাত বছরে দেশের মান— ক্ষুধার সূচকে, বাংলাদেশ পাকিস্থান ভুটানেরও নীচে নেমে গেছে। প্রায় চল্লিশ কোটি মানুষ এই দেশে আজ এমন হতদরিদ্র অবস্থার মধ্যে নিমজ্জিত হয়েছে যে দিনে মাত্র ছত্রিশ টাকার বেশি রোজগার করতে পারছে না। যা এক বোতল পানীয় জলের দামের চেয়েও অনেক কম। মূর্তি আকাশ ছুচ্ছে কিন্ত দেশের মানুষকে সরকার পরিশুদ্ধ পানীয় জলটুকু পর্যন্ত এত বছরে পৌঁছে দিতে পারেনি। সামান্য জল— তাও কিনে খেতে হচ্ছে। যাদের কেনবার সামর্থ নেই, কয়েক লক্ষ প্রতিবছর আন্ত্রিক আমাশয় এমন পেটের রোগে মরে যায়।

যারা হিন্দুস্থানের বাসিন্দা তারা বলছে মহান হিন্দু হৃদয়সম্রাট আমাদের বহুদিনের মনোবাসনা পূর্ণ করেছেন। অযোধ্যায় এবার রামমন্দির হতে আর কোনো বাঁধা নেই। হাজার লক্ষ কোটি টাকা ব্যয়ে এবার ওখানে একটা ভব্য রামলালার মন্দির স্থাপিত হবে। খুব ধুমধামে ভজন পুজন কীর্তন হবে। হিন্দুধর্মের নাম খুব উঁচা হবে।

ভারতভূমির কোনো কোনো বাসিন্দারা বলছে— লক্ষ কোটি টাকা ব্যয়ে রামমন্দির হলে তোমাদের মতো কিছু ধূর্ত অলস ধান্ধাবাজ গায়ে গেরুয়া চাপিয়ে পূজারী হয়ে দুধ ঘিয়ের নদীতে সাঁতার দেবে, তাতে আমাদের কী হবে? ফসলের ন্যায্য দাম না পেয়ে যে-হাজার হাজার কৃষক দেনার দায়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছে, তাদের কী হবে? হাজার হাজার মানুষ বেকার, কত শত কল কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, মানুষ রোজগার হারাচ্ছে, তাদের কী হবে? দেশের বেকার সমস্যা কি মিটবে? দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে, তার কী হবে? ভারতভূমির মানুষের এই প্রশ্নের জবাব না তো ইন্ডিয়া আর না তো হিন্দুস্থানের কারো কাছে আছে। আর না তো তাদের চৌকিদার পাহারাদার সেবক ভাষণবাজের কাছে আছে।

কথায় বলে— নিজেকে দেখেই সবাই অন্যকে বিচার করে। চৌকিদার মহাশয় হয়তো নিজেকে দেখেই আজ দেশের মানুষের অবস্থা বিচার বিবেচনা করে থাকে। “আমি ছেঁড়া খাঁকি হাফপ্যান্ট পরে রেলস্টেশনে চা-য় পিও, গরমা গরম চা-য়-করে বেড়াতাম। আজ আমি চেহারায় চেকনাই আনার জন্য দেড় লক্ষ টাকা প্লেট দামের মাশরুম খেতে পারছি। দশ লক্ষ টাকা দামের স্যুট পরতে পারছি, পকেটে দেড় লক্ষ টাকা দামের পেন গুজে রাখছি, দশ লক্ষ টাকা দামের চশমায় সূর্য দেখছি। সাড়ে আট হাজার কোটি টাকার প্লেন কিনতে পেরেছি। সাত বছর শাসনকালে আমার যখন এত উন্নতি হয়েছে— মানুষেরও হয়েছে নিশ্চয়। আমার চেয়ে না হয় দু-চার টাকা কম হোক— কিন্তু একেবারে কিছু হয়নি এটা ঈর্ষাতুর লোকের একটা মিথ্যা প্রচার। এর পিছনে পাকিস্থানের হাত থাকতে পারে”।

উনি গুজরাতের মানুষ। সফল মানুষের ভূমি গুজরাত। সাইত্রিশ জন গুজরাত বাসিন্দা— যারা এখন বিদেশে বসবাস করছেন— বিজয় মাল্য মেহুল চোসকি, নীরব মোদী— আজ তারা লক্ষকোটি টাকার মালিক। ওনার আশীর্বাদে এত মানুষ যখন এত কিছু করতে পেরেছে, অন্য সবাই কিছু না কিছু নিশ্চয় করেছে। দেশে রামরাজ স্থাপিত হয়েছে। এই সময় রামজির আশীর্বাদে কারো দুঃখী থাকার কোনো কথাই নয়। যে আছে সে ইচ্ছা করেই হয়তো আছে। অনেকের সুখের চাইতে দুঃখ বেশি পছন্দ। সেই যে এক সময় সারা পৃথিবীতে ধনীর ঘরের ছেলেমেয়ে দলে দলে সব ফেলে হিপি হতে শুরু করেছিল।— কেন? কারণ সুখভোগ তাদের ভালো লাগত না। তাই স্বেচ্ছায় দুঃখ ভোগ করতে নিরাপদ জীবন ফেলে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াত। হয়তো এরাও তাই! না হলে দুঃখী হবার আর তো কোনো কারণ নেই। আর যারা আত্মহত্যা করছে! সে আর কবে না করে! এতে এত বিচলিত হবার কিছু নেই। একটা সময় এমন আসে যখন মানুষের মনে হয় অনেককাল বেঁচেছি আর বেঁচে কী হবে? সুন্দরলাল বহুগুনা, কীসে তার কম ছিল? সে বলেনি— ‘আর আমার বেঁচে কী হবে? আর আমি ওষুধ ফষুধ খাবো না’! এভাবে সে মারা যায়নি? কাজেই যে মরছে ধরে নিতে হবে সে মরতেই চেয়েছে। যে মরতে চায় সে আর বাঁচবে কীভাবে!

কে জানে এমন মহৎ ভাবনায় ভাবিত হবার কারণেই হয়তো দেশের কোনো সমস্যা চৌকিদারজির চোখে সমস্যাই নয়। সাত বছরে তাই এমন কোনো কাজ করেনি যাতে মানুষের চুল পরিমান উপকার হয়। তার চোখে— এই করোনা ভাইরাস আসার আগে— বলতে গেলে দেশে কোনো সমস্যাই ছিল না। মাত্র একটা সমস্যা ছিল— দেশের নাম যথেষ্ট উচ্চ নয়। তাকে দেশের নাম উচ্চে তোলার জন্যই প্রয়াস করতে থাকতে হবে। যে-কারণে উনি স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় করার কোনো মানে খুঁজে পাননি। ঈশ্বর যাকে বাঁচাবে সে বাঁচবে। যাকে মারতে চাইবে সে মরে যাবে। বাঁচা মরায় হাঁসপাতাল— ডাক্তারের কোনো ভূমিকা নেই। ওই বিষয়ে খরচ মানে জলে জল ঢালা।

শিক্ষা—! ওটা একটা ফালতু জিনিস মনে করে শিক্ষা খাতে ব্যয় সংকোচন করেছেন। শিক্ষিত হলে মানুষ বশ্যতা মানে না— আনুগত্যের ধার ধারে না— প্রধানের ভুল ধরতে সাহস পায়। ওই যে অমর্ত সেন, অভিজিৎ বিনায়ক— শিক্ষিত হয়েই তো এঁদের মাথাটা একেবারে গেছে। চৌকিদারজির পায়ের কাছে বসে থাকলে ভারতরত্ন পেয়ে যেতে পারত। শিক্ষা তাঁদের নিজের পায়ে নিজে কুড়ুল মারতে শিখিয়েছে, এই শিক্ষা ফালতু শিক্ষা! উনি এখানেও নিজেকে দিয়েই শিক্ষার বিষয়টাকে দেখেছেন। নিজেই বলেছেন যে, স্কুলের গণ্ডি পার হতে পারেননি অথচ আজ দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাকে এমএ-র সার্টিফিকেট হাতে তুলে দিয়ে নিজেই ধন্য হচ্ছে। শিক্ষার মানে তো একটা ডিগ্রী? সে নেতা মন্ত্রী হয়ে গেলে আপনি এসে পায়ে লুটিয়ে পড়ে। তার জন্য কষ্ট করে ইস্কুলে যাবার কী দরকার! উনি এখন একটা কথাই সবসময় ভাবেন— দেশকে মহাকাশ ছাড়িয়ে আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে হবে। এই ভাবনা থেকে লক্ষ কোটি টাকা ব্যয়ে ইন্ডিয়ার নাম লিখে একটা মহাকাশ যান অন্তরীক্ষে পাঠিয়ে ছিলেন। কিন্তু কিছু অজ্ঞ মূর্খ বামুন যাত্রাকালে মন্ত্রপাঠে কিছু অশুদ্ধ উচ্চারণ করায় সে-মহাকাশ যান কিছু দূরে গিয়ে আর যেতে পারেনি। যন্ত্র বিকল হয়ে যায়।

এবার তাই আর মহাকাশ নয়— ওনার মাথায় এবার যেটা এসেছে— ইন্ডিয়ার যে-প্রেসিডেন্ট তাঁর বাসভবনটা যথেষ্ট সুন্দর নয়। ওটাকে সুন্দর বানাতে হবে। বিদেশ থেকে অতিথিরা এসে দেখে যেন ভিমরি খেয়ে যায়। উনি সেই কারণে কুড়ি হাজার কোটি টাকা ব্যায় বরাদ্দ ঘোষণা করেছেন ওই ভবনকে সুসজ্জিত করার জন্য। আর আজকে সারা দেশ বিপর্যস্ত হচ্ছে যে-করোনা সংক্রামণে— সেটা প্রতিরোধ করার জন্য কত দিলেন? ওটা তো গোরুর পেচ্ছাব খেলেই সারিয়ে নেওয়া যায় একেবারে বিনা পয়সা। তবু— যৎ সামান্য কিছু একটু না দিলে খারাপ দেখায় বলে গোটা দেশের জন্য পনেরো হাজার কোটি টাকা দিয়েছেন। এতেই যে বাঁচার সে বাঁচবে।

উনি ভাষণ দিতে খুব ভালো পারেন— ভালোওবাসেন। তাই মাঝে মাঝে টিভিতে ভাষণ দিতে আসেন। এই তো সেদিন করোনা নিয়েও বিস্তর জ্ঞানবাণী বিতরন করলেন। বুড়ো-ধুড়োগুলোর দিকে একটু খেয়াল রাখবেন। লকডাউন পালন করুন। নাক মুখ ঢেকে রাখুন। আয়ুষ মন্ত্রক যা যা বলেছে, পালন করবেন। গরিবদের দেখাশোনা করবেন। ডাক্তার নার্সদের পুলিসদের সম্মান জানাবেন— ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু উনি যেটা বললেন না যে, যে-সব গরিব মানুষ— দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ ঘরে বন্ধ হয়ে আছেন, তারা কী খাবেন? সরকার তাঁদের জন্য কী কী ব্যবস্থা করেছে। বললেন না, যে-সব মানুষ কাজে গিয়ে দূর প্রদেশে আটক হয়ে আছে তাদের ঘরে ফেরাবার জন্য কী উদ্যোগ নিচ্ছেন। আটক থাকা অবস্থায় কী খেয়ে বাঁচবে! বললেন না স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে আরও বেগবান বানাবার জন্য আর্থিক সাহায্য বৃদ্ধি করছেন কিনা। যে-সব চাষির মাঠে ফসল, সেগুলো কাটা-কেনা বেচার জন্য সরকার কী করছে। যে-সব কর্মী ছাঁটাই হবার আতঙ্কে আছে, ছাঁটাই হয়ে গেলে মালিকপক্ষকে কীভাবে বাধ্য করবেন পুনঃ কাজে বহাল করতে! এই সময় তাদের জন্য কিছু আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে কিনা।

কিছু আশার কথা ছিল না তার সেই সুললিত প্রথাগত ভাষণে। বিউটি পার্লার ঘুরে জেল্লা ফুটিয়ে তোলা মুখের কোথাও বিপদাপন্ন— মৃতপ্রায় মানুষের জন্য সামান্যতম করুণা কৃপা সমবেদনার চিহ্ন মাত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি। বরং তাঁর হাসি হাসি মুখ দেখে যেটা মনে হল তিনি মোটেই করোনা নিয়ে চিন্তিত বিচলিত নন। একশো তিরিশ কোটি মানুষ এই দেশ। যার মধ্যে চার ভাগের তিন ভাগই গরিব। চল্লিশ কোটি তো হতদরিদ্র। এর মধ্যে যদি পঁচিশ তিরিশ কোটি মরেও যায়— তেমন কিছু বিরাট ক্ষতি হবে না। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্য যখন করোনাকে ব্যবহার করা হচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি একে প্রতিহত করা যাবে না। মাঝে মাঝে ভাষণ চলবে, লকডাউন বাড়বে, মানুষ মরবে। তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। তাই আমাদের সামনে আরও অনেক বড়ো ক্ষয়ক্ষতি অপেক্ষা করে আছে। সবাই প্রস্তুত থাকুন সেই বিপদের মুখোমুখি হবার জন্য। কে বাঁচব কে মরব জানি না।

এই রকম মানসিক অবস্থায় কিছু না যায় লেখা আর না যায় কিছু পড়া। মাথার মধ্যে সবসময় ঝাঁ ঝাঁ করছে তাই সুস্থভাবে কিছু চিন্তাভাবনাও করা যাচ্ছে না। করোনা পরিবর্তিত পৃথিবীর পরিস্থিতি আর আগের মতো থাকবে না। শিল্প সাহিত্য চর্চা আর হবে কি হবে না কোনো ঠিক নেই। মানুষ তখন থাকবে ‘মাথার ঘায়ে কুকুর পাগলা’ অবস্থায়। অভাব অনাহার দারিদ্র্য দুশ্চিন্তা অনিশ্চয়তা এমনভাবে মানুষকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াবে যে-পঠন পাঠন অধ্যয়ন অধ্যাপনা এ-সব নিয়ে মানুষের ভাবার মতো অবকাশ আর থাকবে কি না কে জানে। কাজেই আমরা যারা একটু লিখি টিখি ভেবে পাচ্ছি না লিখে আর কি কিছু হবে? কে পড়বে আমাদের লেখা? তাহলে পণ্ডশ্রম করার আর কী দরকার? যদি বেঁচে থাকি যদি অবস্থা অনুকূল হয় তাহলে আবার লিখব। না হলে এটাই হয়তো শেষ লেখা! সাবধানে থাকবেন আর ভালো থাকবেন সবাই।

Facebook Comments

পছন্দের বই