লেখক নয় , লেখাই মূলধন

করোনার দিনগুলিতে: হিরণ মিত্র

ছোপ ছোপ দিনগুলি

আপাতভাবে মনে হতে পারে, মানুষ গৃহবন্দি। সে একটা জেলখানায় ছোট্ট খুপরিতে আটকে আছে। কিছু মানুষের জন্য তা তো বটেই। যারা ছোট্ট একটা ঘরে নিজের বিছানা আর সামান্য কিছু আসবাবে নিজেকে স্বেচ্ছাবন্দি করেছে। সামান্য আকাশও দেখা যায় না, সেই ঘর থেকে। একতলার ঘর, তাই জানালা খোলাও সমীচীন নয়। বে-আব্রু হয়ে পড়ার আশঙ্কা, একটা মানসিক ব্যাধি জন্মানোর আদর্শ চৌখুপি। আমি এটা ভাবতেই পারি না। আমিও গৃহবন্দি প্রায় দু-মাস। কিন্তু আমার বিচরণভূমি— খোলা ছাদ— নানা কাজের টেবিল। রং-তুলি, কাগজ, ক্যানভাস। তারা আমাকে ক্রমাগত আশ্রয় দিয়েই চলেছে। আমিও বিচরণে আছি।

বই থাকা মানে সংস্কৃতি থাকা। যার যেমন পড়ার অভ্যাস। ছবির বই, দর্শনের বই, ইতিহাস আরও কতরকম। অনেক বিখ্যাত শিল্পীর কাহিনি পরপর আমাকে পাহারায় রেখেছে। কথা বলি তাদের সাথে। অহরহ। আঁকছি অজস্র। শুরু করলাম পাবলো পিকাসোকে নিয়ে একটা ভঙ্গি-মিছিল। কত হাজারও রকম ভঙ্গি ছিল ওনার। যেন একজন অভিনেতা, শিল্পী নন, মঞ্চটা ওনার স্টুডিও। কোনো দর্শক নেই, কিন্তু উনি সমস্ত সভ্যতাকেই দর্শক বানিয়ে নিয়েছেন। সে এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। আমি এঁকে চললাম সেই দেখা। প্রায় দেড়শোটা ছবি হল। মাঝপথে থেমে গেল। ছন্দ পতন হল। এক রাত্রে, অনেক রাত্রে কাজ করে ঘুমোতে গেলাম। সারা মেঝে সাদা কালো রেখা-ছবিতে বেছানো। ভোরের দিকে একটা বিস্ফোরণ। ঠিক বইয়ের তাকের মাঝে, মেঝেতে পড়ে থাকা ছবির মাঝখানে আগুন জ্বলছে। ল্যাপটপের অ্যাডাপ্টর জ্বলছে। ঘটনাচক্রে ল্যাপটপ বন্ধ করেই শুয়ে পড়েছিলাম। তাই তার কোনো ক্ষতি হয়নি। কিন্তু কাজ বন্ধ হয়ে গেল। যেভাবে পিকাসোর সময়ে চলে যাচ্ছিলাম, সময় তরণীতে তা আর সম্ভব হল না। পড়ায় ফিরে গেলাম। তিনবার ফিরে পড়া শুরু করলাম, লাইফ উইথ পিকাসো, পিকাসোর প্রাক্তন স্ত্রী ফ্রাঁসোয়া জিলোর মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা। সে এক ভয়াবহ বর্ণনা। এতটাই নির্মম। পিকাসো নানাভাবে চেষ্টা করেছিলেন এই বইটাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার। যতরকম যোগাযোগ ছিল চেষ্টায় সব কিছুই। আর এই বই লেখার কথা জানতে পেরে, ফ্রাঁসোয়ার ঘরে ডাকাত পাঠান, তারা সব কিছুই ধ্বংস করে দেয় বই, চিঠি, ছবি, যাবতীয়। শুধুমাত্র তিন থেকে চারটি কার্ডবোর্ডের বাক্সের হদিশ তারা পায়নি। তাতেই ছিল পিকাসোর চিঠি, যাবতীয় নোটস বহু কিছু। তাই এই বই লেখা সম্ভব হল। দশ বছর লাগে কাজটা করতে। একজন সহযোগী লেখককেও উনি পেয়ে যান। আমার এখনও চলছে এই অভিযান।

এ ছাড়াও আমি একটা অভিনব পদ্ধতিতে প্রতিদিন ছবি আঁকছি। ফেসবুক একমাত্র মাধ্যম যার মধ্য দিয়ে আমার কথোপকথন চলছে বইয়ের জগতের সঙ্গে। কেউ গান গায়। কেউ লেখে। কেউ কবিতা পড়ে। আমি সেইসব কাজের উপর, আমার তৎক্ষনাৎ প্রতিক্রিয়া এঁকে যেতে থাকি। বিরাম নেই। এখনও পর্যন্ত ১২৬টি কাজ হয়েছে, একটু বড়ো মাপের। কালো সাদা ও রঙিন। জলরং, কালি পেন ও স্প্রে। এইভাবে করা। আর প্রতিদিনই ছবি তুলে, ফেসবুকে, বিভিন্ন নামে উৎসর্গ করতে থাকি। গতকাল করলাম, আমাকে যারা আগলে রেখে, নানা শাকসবজি মাছ মাংস সরবরাহ করে তাদের উদ্দেশে। বেশ মজাদার ব্যাপার এ-সব। অপর দ্বারা নির্মিত। দৃশ্যের দাস বনে যাওয়া। আবিষ্কার করা নিজের মধ্যে নিজের আমিকে। ঘনিষ্ঠ এক লেখক, সম্পাদক বন্ধু, অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে, সকালে খবর এল। তার সুস্থতা কামনা করে আঁকলাম একটা ছবি। তার উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে রাখলাম। নিশ্চয়ই ও ভালো হয়ে উঠবে। আমার চিত্রভাষা ও প্রার্থনার আগ্রহে। তার নাম ভাস্কর লেট।

Facebook Comments

পছন্দের বই