লেখক নয় , লেখাই মূলধন

করোনার দিনগুলিতে: অংশুমান কর

কবি ঠিক কতখানি নিষ্ঠুর?

আমার ব্লগে একটি লেখা লিখতে গিয়ে আমি লিখে ফেললাম যে একজন কবি, একজন শিল্পীও একজন নিষ্ঠুর মানুষ। শুনলে খানিকটা ধাঁধার মতো লাগতে পারে। মনে হতে পারে তা কী করে হয়? একজন কবি বা শিল্পী তো এমন একজন মানুষ যিনি সহমর্মী হন অন্যের কষ্টের। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘এমপ্যাথি’, সেই এমপ্যাথিই কবির অলংকার। তিনি নিষ্ঠুর হন কী উপায়ে? একজন আমাকে ইনবক্সে করেও বসলেন এই প্রশ্ন। এ-লেখা খানিকটা সেই প্রশ্নেরই উত্তর। যেটুকু বলে থেমেছি আমার ব্লগে, এই লেখাটি তার পরের অংশ। অনেকটা যেন ফুটনোট। আর অনেক সময়েই তো ফুটনোট হয়ে যায় যে বাক্যগুলির সঙ্গে সেটি সংযুক্ত তাদের চেয়ে অনেকখানি দোহারা চেহারার! এ-লেখাটিও, অনেকখানি, তেমনই।

কবি বা শিল্পীর নিষ্ঠুরতার কথা উচ্চারিত হলেই বাংলা ভাষার পাঠকদের অনেকের মনে পড়ে যেতে পারে রণজিৎ দাশের একটি বিখ্যাত কবিতা। কবিতাটির নাম “ক্ষত”। যেখানে রণজিৎ দাশ লিখেছিলেন, “মহান শিল্পীদের জীবনীতে প্রায়ই পড়ি তাঁদের অকল্পনীয় নিষ্ঠুরতার কথা। পড়ি, এবং ভীষণ বিভ্রান্ত বোধ করি। ভাবি যে, যে-মানুষ ব্যক্তিগত জীবনে এতটা হৃদয়হীন এবং নির্মম, তাঁর শিল্পের আদৌ কি মূল্য দেব আমি?” কবিতাটির ভেতরেই এই বিভ্রান্তি থেকে নিজেকে মুক্তও করে নেন রণজিৎ দাশ। স্পষ্ট করেন তাঁর অবস্থান। লেখেন, “শিল্পী হবার তাড়নায় উচ্চাকাঙ্ক্ষী স্বামী-স্ত্রীতে মিলে সংসার ভেঙে দিয়ে, এবং নিজেদের সদ্যোজাত শিশুকন্যাকে তার গ্রামের মামাবাড়িতে ফেলে রেখে, প্যারিসে এসে রদ্যাঁর শিষ্য বনে যাওয়ার জন্য রিলকে-র সমস্ত কবিতা আমার কাছে অস্পৃশ্য মনে হয়; অসুস্থ সঙ্গিনী ফ্রাঁসোয়া জিলো-র গালে জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকা দেওয়ার জন্য পিকাসো-র সমস্ত ছবি আমি পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে দিতে পারি। জীবনের অপরাধ ঢাকতে শিল্পের সাফাই হয় না”। এই মতের পক্ষে ও বিপক্ষে দু’রকমেরই মত আছে। সেকথা অবশ্য রণজিৎ দাশ-এর কবিতাটির মধ্যভাগে বিধৃতও আছে। আমি যেমন শিল্পকে শিল্পীর থেকে বিচ্ছিন্ন কর দেখতেই ভালোবাসি। তা না-হলে বাংলা ভাষার অনেক কবিরই কবিতা যে গ্রহণ করতে পারব না অন্তরে! তবে রণজিৎ দাশ-এর একটি শব্দ ব্যবহারের সঙ্গে আমি একমত। যদি কেউ ব্যক্তিজীবনের দুষ্কর্মের জন্য শিল্পের ‘সাফাই’ দেন, তাহলে সেই ‘সাফাই’ টেঁকে না।

কিন্তু এই কবিতায় রণজিৎ দাশ শিল্পীর যে-নিষ্ঠুরতার কথা বলেছেন , আমি ঠিক সেই নিষ্ঠুরতার কথা বলতে চাইছি না। একজন শিল্পী নিষ্ঠুর কারণ তিনি সৃষ্টির মুহূর্তে স্বার্থপর, তা সে তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষা না-থাকলেও। উচ্চাকাঙ্ক্ষা শব্দটিকে আমি অবশ্য এখানে একটু স্থূল অর্থেই ব্যবহার করছি। যেমন খানিকটা রণজিৎ দাশ করেছেন, রিলকের উদাহরণ দেওয়ার সময়ে। কবি-শিল্পীদের সকলেরই কি উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকে? এই যে ক’দিন আগেই চলে গেলেন মহাপৃথিবীর কবি শম্ভু রক্ষিত তাঁর কি উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল? মনে তো হয় না। তাহলে তিনিও কি নিষ্ঠুর ছিলেন? হ্যাঁ, ছিলেন। সৃষ্টির মুহূর্তে, একজন কবি, একজন শিল্পী, প্রশ্নহীনভাবে নিষ্ঠুর। তিনি হয়তো এমন একটি কবিতা লিখছেন যেখানে জায়গা পাচ্ছে আর্ত মানুষ, তাঁদের ক্রন্দন, এমনকি সেই কবিতাটি লেখার সময়েও কবি নিষ্ঠুর। নিষ্ঠুর কেননা, সেই কবিতাটি রচনার মুহূর্তে তাঁকে যতখানি তাড়িতে করছে আর্ত মানুষের ক্রন্দন, তার থেকে বেশি তাড়িত করছে কবিতাটিতে কোন শব্দটি তিনি বসাবেন, সেই প্রশ্ন, কেমন হবে কবিতাটির ফর্ম সেই প্রশ্ন। এবং এই কাজটি চলতে চলতেই তিনি সম্পূর্ণ প্রবেশ করছেন কবিতাটির অন্তঃপ্রকৃতিতে, তখন তিনি যেন অনেকখানি বিচ্ছিন্নও হয়ে গেছেন ওই আর্তের চিৎকার থেকে। এবং আশ্চর্য মনে হলেও সত্যি যে, এই রকম একটি কবিতা লেখার পরে, তিনি, কবিতা রচনার সমাপনান্তে খানিক আত্মপ্রসাদও অনুভব করেন। অন্যের কষ্টে সৃষ্ট তাঁর নিজের রচনার জন্য শ্লাঘা বোধ না করলেও একধরনের তৃপ্তি পান। একজন নিষ্ঠুর মানুষ ছাড়া এই তৃপ্তি লাভ করা কি কারও পক্ষেই সম্ভব?

তবে রণজিৎ দাশ বর্ণিত নিষ্ঠুরতার সঙ্গে আমি যে-নিষ্ঠুরতার কথা বলছি তার একটি মূলগত পার্থক্য আছে। রণজিৎ দাশ বর্ণিত নিষ্ঠুরতা কবি বা শিল্পীর জীবন-সংলগ্ন কিছু কিছু ব্যক্তিকে কষ্ট দিতে পারে, দিতে পারে যন্ত্রণা; তাদের জীবন করে তুলতে পারে অসহনীয়। কিন্তু যে-নিষ্ঠুরতার কথা আমি বলছি, যেই নিষ্ঠুরতা সমাজ বা ব্যক্তির কোনও ক্ষতি করে না। আশ্চর্যের মনে হলেও সত্যি যে, এই নিষ্ঠুরতা বরং আর্তের কাঁধে বন্ধুর মতো হাত রাখে, বাড়িয়ে দেয় নিজের কাঁধ আর তারপর তাঁকে বলে, “যদি কাঁদতেই হয় তবে এই কাঁধে মাথা রেখে কাঁদো, বন্ধু”।

Facebook Comments

পছন্দের বই