লেখক নয় , লেখাই মূলধন

অমিতাভ মৈত্র-এর গদ্য

ইম্প্রেশনস্‌

Souls are weighed in silence as gold and silver are weighed in pure water and the words which we pronounce have no meaning except through the silence they are bathed.

— Maeterlinck

কবির ব্যর্থতা ও পতনেই একটি সফল কবিতার জনপ্রিয়তা ও উত্থান। তিনি সফল হলে কবিতাটি লিখিত হওয়ার প্রয়োজন হত না। ব্যর্থতা— কেন-না তাঁর আত্মার শুদ্ধতাকে অশুদ্ধ শব্দের সাহায্যেই শেষ পর্যন্ত তাঁকে পৌঁছে দিতে হচ্ছে পাঠকের কাছে, আর তিনি আশা করছেন তাঁর শব্দের হাত ধরেই পাঠকের আত্মাও এসে দাঁড়াবে কবির স্তব্ধ আত্মার মুখোমুখি। তাই, যখন কবিতাটি লেখা হচ্ছে তখন প্রেত-তাড়িতের মতো তিনি চেষ্টা করছেন যথাযথ হতে, কেটে দিচ্ছেন লিখে ফেলা লাইনের পর লাইন, জুড়ে দিচ্ছেন একটি দু-টি শব্দ বা একটি সেমিকোলন, বিস্ময় চিহ্ন। যদি অন্য কোনো মাধ্যমে ন্যূনতম প্রকাশ করতে পারতেন তিনি নিজেকে, কর্কশ জোরালো কলমের আঁচড়ে সে-মুহূর্তেই তিনি কেটে দিতেন শব্দকে, বরাদ্দ করতেন চির নির্বাসন। শব্দ ছাড়া কোনো উপায় যে তাঁর নেই আর, এই বোধ তাঁকে করে তোলে কোণঠাসা জন্তুর মতো হিংস্র, আক্রমণাত্মক, অসহায়। এমন কোনো কবি কি থাকতে পারেন শব্দের প্রতি অপরিসীম ঘৃণা যিনি বোধ করেননি কখনো, বা Art Poetique-এ ভের্লেন যেমন বলেছেন তেমনি মনে মনেও বলে ওঠেননি— বাক্‌চাতুর্যকে গলা টিপে শেষ করে দাও (“Take eloquence and wring it’s neck”)

কবিতার মুহূর্তে হত্যাকারীর মতো, শব্দের নিযুক্ত আততায়ীর মতো দেখায় কবিকে। সাধারণভাবে অচেতন বা অর্থসচেতন থাকতে পারেন তিনি তাঁর এই ঘাতকরূপ বিষয়ে। বাধ্যমুহূর্তে, যেমন জল, তেমনি স্তব্ধতায় তিনি স্নান করিয়ে নেন শব্দকে তাঁর আত্মার স্তব্ধতাকে ধারণক্ষম করে তোলার জন্য। তাঁর ভেতরের রাজ্যকে মুক্ত অবাধ ও স্তব্ধ দেখার প্রেরণা থেকে শব্দকে, “the fibrous and nervous language of realisms” (য়্যুইসমাঁস)-কে হত্যায় উৎসাহী হয়ে ওঠেন তিনি, যেহেতু তিনি জেনে গেছেন ব্যাখ্যা ও বিবৃতির এই ভাষাকে তার চরম-সীমায় পৌঁছে দিলেও তাঁর সান্দ্র স্তব্ধতাকে ধারণ করার পক্ষে সেই ভাষা ভঙ্গুর, দুর্বল, অপর্যাপ্ত। তাঁর প্রয়োজন হয় এমন উদ্দীপনার যা ভাষায় নেই। তাঁর প্রয়োজন হয় সংকেত ও সিম্বলের কাছে অবনত ভঙ্গিতে প্রার্থী হয়ে দাঁড়ানোর, কেন-না তিনি নিরুপায়।

কিন্তু এই সংকেত বা সিম্বল তো কবিতা নয়, একটি অখণ্ড মানস অস্তিত্ব সে যার সাথে কবিতার তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। প্রত্যক্ষভাবে কবি কখনোই চাননি তাঁকে, তিনি শুধু চেয়েছিলেন ভাষাকে আত্মার অতলতা পর্যন্ত প্রসারিত করতে যেখানে জাগ্রত জীবনের জ্বলন্ত প্রাচীর-পর্যায় ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে আসে। কিন্তু যে-মুহূর্তের প্রতীকের মুখোমুখি তিনি, প্রতীক মেডুসার মুখের মতো স্তব্ধ অনড় পুতুল করে দেয় তাকে, আর কবিতায় সে-কবির পরাজিত বিপন্ন এই মুখশ্রীকেই শুধু ধরে রাখে, যেভাবে চিহ্নের অস্তিত্ব গ্রাস করে আইকন। শব্দের প্রতি ঘৃণার যে-অভিব্যক্তি এই গদ্যলেখাটির শুরুতে আমরা দেখেছি কবির মধ্যে, শব্দকে প্রতীক করে তোলার চেষ্টা এবং পরবর্তী মোহহীনতা দেখেছি, ঘৃণার সেই একই মুখ আমরা দেখি ১৮৯৯ সালে লেখা গোর্কির ‘Twenty Six Men and girl’ গল্পে। একজন শিল্পী বা কবির সাথে তাঁর ফর্ম-এর সম্পর্ক ও সম্পর্কমুক্তির প্রসঙ্গটিকে একরকমভাবে গল্পটির সাথে মিলিয়ে নেওয়া যায়। রুটি কারখানার ছাব্বিশজন শ্রমিক বা ছাব্বিশটি মানবযন্ত্র, ময়দার তাল পিছল হয়ে উঠত যাদের ঘামে আর শ্বাসরোধী সেই কারখানা ঘরের ইটের দেয়ালে আগুনের গনগনে আভার নাচ নিস্পৃহ চোখে দেখত যারা আর অনুভূতিহীন এক যান্ত্রিক নিয়মেই যেন মাঝে মাঝেই দুয়েক কলি গান গুনগুন করত, তাদের যাবতীয় বেঁচে থাকার আনন্দ কেন্দ্রীভূত ছিল তানিয়া নামের ষোলো বছরের চমৎকার দেখতে মেয়েটিকে ঘিরে। মেয়েটিকে প্রায় উপাস্য দেবি করে তুলেছিল তারা। শালীন, সম্ভ্রমযুক্ত দুরত্ব— মেয়েটির সাথে তাদের সম্পর্ক ছিল এই। কারখানার নতুন শ্রমিক, সাটিনের ওয়েস্টকোট পরা এক ড্যান্ডি ছোকরা তাদের বিদ্রূপ করত এই অদ্ভুত মানসিকতার জন্য। কিন্তু সেই ছাব্বিশজন শ্রমিক ছিল নিস্পৃহ, অবিচলিত। তাদের পুরুষত্বহীনতার জন্য বিদ্রূপ করে, তাদেরকে সাক্ষী রেখেই নতুন শ্রমিকটি একদিন তানিয়াকে নিয়ে নিভৃত পরিত্যক্ত একটি ঘরে চলে যায়। যখন তীব্র আনন্দিত মুখ এবং সামান্য ক্লান্ত শরীরে মেয়েটি ফিরে আসছে, তখন মেয়েটিকে ঘিরে তারা, কদর্য অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে তাদেরই আরোপিত দেবীমুখ থেকে মেয়েটিকে বিচ্ছিন্ন করে তাদের প্রতিশোধের কাজটি শেষ করে। শিল্পীও কখনো কখনো তার ফর্মকে তার মাধ্যমকে অসচেতনভাবেই আইকন করে তোলে এবং একইভাবে পরাজিত হয় তার আরাধ্য ফর্মের কাছে, বা, পরোক্ষে, তার নিজের কাছে। তার পরাস্ত মুখচ্ছবি ধরে রাখে তার সৃষ্টি।

— শিল্প কি তাহলে তার ফর্মের কাছে তার নিজের কাছে নিজের পরাজয়ের গল্পই শুধু? অথবা সে-পুনরুত্থানও প্রতিশোধ? এরকম একরৈখিকতায় বিষয়টিকে ধরা যাবে না। ঘটনা এই যে প্রতীকের রূপকে তার শক্তিকে ধ্বংসের জন্যই তাকে পূর্ণ ও পরিণত হতে দেন কবি। যে-কোনো শিল্পই তার ফর্মকে চূড়ান্ত নিখুঁত করে তোলে ফর্মকে নিশ্চিহ্ন করে সেই শিল্প স্রেফ নিজের জোরে দাঁড়ানোর একটা জায়গা পায়। সিমন্‌স্‌ দেখিয়েছেন এরেদিয়া-র (Jose Maria de Herdia) চতুর্দশপদী কবিতার “The whole of the movement comes to a splendid funeral in which the literature of form says its last word and dies.” এই হচ্ছে কবির প্রতিশোধ— তাঁর ফর্মের প্রতি, তাঁর শব্দের প্রতি। আত্মায় স্তব্ধতাকে গ্রহণ করার জন্য তাঁর ফর্ম তাঁর শব্দকে তিনি সাফল্যের সঙ্গে হত্যা করতে পেরেছেন।

হত্যা শব্দটির ব্যবহার করা হল যদিও, তবু প্রকৃতপক্ষে কোনো হত্যাকাণ্ড নেই এর মধ্যে, কোনো স্পষ্ট যুদ্ধ নেই, জয় নেই, পরাজয় নেই। শুধু এক স্বতশ্চলতা আছে, গন্তব্যবোধহীন দীর্ঘ যাওয়া আছে। তাঁর যুদ্ধ যুদ্ধভূমির অনেক নীচে, এই যুদ্ধ বর্ণনার জন্য কোনো সঞ্জয়ের প্রয়োজন হয় না। কোনো আনন্দযুক্ত প্রেরণা থেকে তাঁর মাধ্যমের কাছে যান না কবি। কবিতা তাঁর কাছে একটি কাজ, যা ক্লান্তিকর, বিরক্তিকরও কখনো। গোর্কির গল্পের চরিত্রগুলির মতো একইরকম ধূসর শ্রমিকের পোশাক কবির শরীরেও, একইরকম ঘামে ভেজা তাঁর মাথা, মুখ ও শরীর। পার্থক্য যেটুকু, তা দৃষ্টিভঙ্গির। ১৯৫৭ সালে লেখা আলব্যের কাম্যুর ‘The Silent Men’ গল্পটি ফর্মের প্রতি একজন কবির দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে সাহায্য করতে পারে। ইভার্স, চল্লিশ পেরিয়ে যাওয়া একজন করাতকলের শ্রমিক, তাদের ডাকা ধর্মঘট ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার কুড়ি দিন পর স্রেফ ফাঁকা মাথা নিয়ে তার কারখানায় যাচ্ছে কাজে যোগ দিতে। সাইকেল চালাতে কষ্ট হচ্ছে, বয়সের শীতল সংক্রাম টের পাচ্ছে শরীরে। মালিক লাসালে, বছর ত্রিশের যুবক, যে উৎসবের আগে তাদের উপহার দেয়, মেয়ের জন্মদিনে কিছু খাবারের ব্যবস্থা রাখে তাদের জন্য এবং তাদের ন্যূনতম কোনো দাবি হঠাৎই কঠোরভাবে নাকচ করে দেয়— তার সম্পর্কে ইভার্সদের কোনো পূর্ব ধারণাই যেন নেই। প্রতিবার নতুন করে যেন পরিচিত হচ্ছে তারা, এইরকমই আড়ষ্টতায় একটি দু-টি শব্দ বিনিময় হয় মাঝে মাঝে। অন্য সময় তারা ভাষা-পরিত্যক্ত মানুষ। অপ্রয়োজনে নিজেদের মধ্যেও ভাষা ব্যবহার করে না। কুড়ি দিন পর শূন্য মুখে আবার কাজ শুরু করে তারা, করাতের যান্ত্রিক শব্দ নির্বাক্‌ভাবে শোনে। মালিক এসে একজনের সাথে অপ্রস্তুতভাবে কুশল সংলাপের চেষ্টা করে এবং তারা নিরুত্তরে কাজ করে যায়। বিরতির সময় তারা ভ্যান গঘের আঁকা আলু খাওয়ার দৃশ্যের মতো শূন্য মুখে খাবার চিবোয়। একজন খাবার আনেনি, সে শুয়ে জানালা দিয়ে আকাশ দেখে। ইভার্স শুকনো টোস্টের ভাগ তাকে ক্যাজুয়ালি দেয়, ধন্যবাদহীন। এর মধ্যে আম্বুলেন্স এসে দাঁড়ায় এবং তারা জানতে পারে মালিকের ছোট্ট মেয়েটি মৃত্যুমুখে। তারা শোনে এবং নির্বাক্‌ থাকে। “Yvars now felt only his fatigue and his still heavy heart. He would have liked to talk. But he had nothing to say, nor had others.” স্লথভাবে তারা কাজ করে যায় শুধু এবং অনির্দিষ্ট কোনো কিছুর প্রতীক্ষা করে যেন। অনেক পরে মালিক আসে। বিধ্বস্ত, এলোমেলো। তাদের দিকে তাকায়, অগোছালোভাবে শুভ রাত্রি জানায়, একটু অপেক্ষা করে নিরর্থক, তারপর চলে যায়। বন্ধ দরজার ওপারে চলে যাওয়া লাসলে-র উদ্দেশে সম্ভবত প্রথম কিছুটা আন্তরিকতা ছোঁয়ানো গলায় ইভার্স ও অন্যান্যরা জানায় ‘শুভ রাত্রি’। পরমূহূর্তেই আবার তারা স্তব্ধ মূক হয়ে যায়।

মোটামুটিভাবে গল্পটি এই, যেখানে স্পষ্ট কোনো সংঘাত নেই, স্বসৃষ্ট মূর্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ নেই, জয় নেই, পরাজয় নেই। কিন্তু সত্যিই কি নেই এগুলি? আছে। ধাক্কাগুলি আছে, তবে এত গভীরে তারা যে উপরিতলে সামান্যও আলোড়ন নেই। গল্পটিতে আপনি কারো পক্ষে দাঁড়াতে পারছেন না, বিরোধীপক্ষও নন কারো। গোর্কির গল্পে মেয়েটির একটি প্রতীকী অস্তিত্ব ছিল, শ্রমিকরাও ছিল প্রতীক। কাম্যুর গল্পে কোনো প্রতীক নেই, বক্তব্যের কোনো নির্দিষ্টতা নেই, আত্মসম্পূর্ণতা নেই। রাত্রি ছিন্ন করে চলে যাওয়া ট্রেনের মৃদু আলোর মতো গল্পটিকে চলে যেতে, শূন্য হয়ে যেতে দেখি। ঝড়ের তীব্রতায় নয়, প্রবল ভাঙার মধ্যে নয়, শরীরের সাথে শ্বাসের সহজ স্বাভাবিক সম্পর্কের মতোই কবিতা সম্পর্কযুক্ত থাকে তার ফর্মের সাথে, তার ভাষার সাথে। এই তার অপ্রকাশিত যুদ্ধ। মেটারলিঙ্কের মতোই একজন কবি জেনে গেছে “Our soul does not judge; as we judge; It is a capricious and hidden thing. It can be reached by a breath and unconscious of a tempest. Let us find out what reaches it; everything is there, for it is there we live.”

Facebook Comments

পছন্দের বই