লেখক নয় , লেখাই মূলধন

অরূপ চক্রবর্তীর ধারাবাহিক: জলসাঘর

দ্বিতীয় পর্ব

এক সুর-ভিন্ন ধারা

গীত নৃত্য ও বাদ্য— এই তিন কলার একত্র সমন্বয়কে সংগীত বলা হয়। সুর, তাল ও ছন্দ অথবা অন্যভাবে ব্যাখ্যা করলে মেলোডি, বিট ও রিদম হল যে-কোনো ধরনের সংগীতের প্রাণ ভোমরা বা প্রধান চাবিকাঠি। কণ্ঠসংগীত বা গান হল সংগীতের একটা ধারা যা উপরিউক্ত চাবিকাঠির সাথে কিছু কথা বা লিরিক্স (কবিতার আদলে গড়া) মিলে সৃষ্টি হয়। আমরা শ্রোতারা বিদেশি বা দেশি (প্রাদেশিক) বিভিন্ন ভাষার অনেক গান শুনে থাকি যার অর্থ হয়তো অনেক সময় বুঝে উঠতে পারি না। কিন্তু সেক্ষেত্রে ভাষা আমাদের কাছে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় না। মূলত আমরা সুর তাল ছন্দের আকর্ষণে তার প্রতি আকর্ষিত হই। অর্থাৎ সুর তাল ছন্দ কোথাও গিয়ে তার প্রাদেশিকতার বেড়া ভেঙে আন্তর্জাতিক হয়ে যায়। আবার আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠে হৃদয় ও মনের একান্তই আপন।

এই নিবন্ধে আমি সেইরকম কিছু গান নিয়ে আলোচনা করব যা বাংলা ভাষায় প্রথম গাওয়া হলেও পরবর্তীতে সর্বভারতীয় (হিন্দি ভাষা) স্তরে রূপান্তরিত হয়েছে তার সুর তাল ছন্দের বৈচিত্রের আকর্ষণে।

সেই সময়ের প্রখ্যাত অনেক সুরকার প্রথমেই যাঁর কাছে দু-হাত পেতে তাঁর সুরের অনুসরণে বেশ কিছু জনপ্রিয় গান সৃষ্টি করেছিলেন তিনি আর কেউ নন— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আমার ব্যক্তিগত অভিমত, রবীন্দ্রনাথের গানের ধারা আমাদের বাংলা গানকে প্রথম অভিজাত করেছিল। তাঁর সৃজন করা গানের আবেদন এমনই গভীর ছিল যে, সেই গানের অনুসরণে সৃষ্ট সব ক-টি হিন্দি ছায়াছবির গান জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।

এখানে তেমনই কয়েকটি মূল ও অনুসৃত গানের উল্লেখ করলাম:

১. মনে রবে কিনা রবে আমারে (মূল গান)
ও বচপন কে দিন ভুলা না দে না— ছায়াছবি ‘দীদার’ (১৯৫১)।
মূল গানের প্রথম লাইনের সাথে এই গানটির মিল পাওয়া যায়। গানটি গেয়েছিলেন সামসাদ বেগম ও লতা মঙ্গেশকর এবং সুরকার ছিলেন নৌশাদ।
২. ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল (মূল গান)। মূল গানটির স্থায়ী অংশের মিল পাওয়া যায় এই গানটিতে: রাহী মতবালে তু ছেড় ইকবার— ছায়াছবি ‘ওয়ারিশ’ (১৯৫৪)। গানটি গেয়েছিলেন তালাত মাহমুদ ও সুরাইয়া এবং গানটির সুরকার ছিলেন অনিল বিশ্বাস।
৩. হে ক্ষণিকের অতিথি (মূল গান)। এই গানের প্রথম লাইনের সাথে মিল পাওয়া যায় হিন্দি ভার্সনের গানটিতে:
যায়ে তো যায়ে কাঁহা— ছায়াছবি ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’ (১৯৫৪)। শচীন দেব বর্মনের সুরারোপিত এই গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন তালাত মাহমুদ।
৪. হৃদয়ের একূল ওকূল দুকূল ভেসে যায় (মূল গান)। মেরা মন ভুলা ভুলা ক‍্যহে— ছায়াছবি বিরাজ বহু (১৯৫৪)। মূল গানের স্থায়ী অংশের সাথে সলিল চৌধুরীর সুরারোপিত হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া এই গানে অনেকটা মিল পাওয়া যায়।
৫. মন মোর মেঘের সঙ্গী (মূল গান)। মন মেরা উড়তা যায়ে— ছায়াছবি ‘মা বেটা’ (১৯৬২)। লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সুরারোপিত এই গানটা মূল গানকে অনুসরণ করে সৃষ্টি হয়েছে।
৬. আমার প্রাণের মাঝে সুধা আছে চাও কী (মূল গান)। মেঘা ছায়ে আঁধি রাত ব‍্যায়রন বন গয়ি নিঁদিয়া— ছায়াছবি ‘শর্মিলী’ (১৯৭১)। মূল গানের অন্তরার প্রথম কলি ডাক উঠেছে বারে বারে তুমি সাড়া পাও কি এই অংশের সাথে উল্লিখিত গানটির দু-টি অন্তরার প্রথম কলির সাযুজ্য লক্ষ করা যায়। গানটির সুরকার ছিলেন শচীন দেব বর্মন। গানটি গেয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর।
৭. যদি তারে নাই চিনি গো সে কি (মূল গান)। তেরে মেরে মিলন কি ইয়ে র‍্যায়না— ছায়াছবি ‘অভিমান’ (১৯৭৩)। কিশোর কুমার ও লতা মঙ্গেশকরের দ্বৈতগায়নে এই গানটি নির্মাণ করেছিলেন শচীন দেব বর্মন। মূল গানের স্থায়ীর সাথে এর স্থায়ীর অংশের সুর হুবহু এক।
৮. ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে বহে (মূল গান)। রাজা মেরে তেরে লিয়ে— ছায়াছবি ‘আপ কী খাতির’ (১৯৭৭)। এই গানটির হিন্দি ভার্সন বাপী লাহিড়ীর সংগীত পরিচালনায় লতা মঙ্গেশকর গেয়েছিলেন।
৯. ভেঙে মোর ঘরের চাবি (মূল গান)। নান্হা সা পঞ্ছী রে— ছায়াছবি ‘টুটে খিলোনে’ (১৯৭৮)। এই গানটির হিন্দি ভার্সন বাপী লাহিড়ীর সংগীত পরিচালনায় কিশোর কুমার গেয়েছিলেন।
১০. তোমার হল শুরু আমার হলো সারা (মূল গান)। ছু কর মেরে মন কো ক্যা তু নে— ছায়াছবি ‘ইয়ারানা’ (১৯৮১)। কিশোর কুমারের গাওয়া রাজেশ রোশন-এর সুরে এই গানের হিন্দি ভার্সন খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। এই গানটির স্থায়ী মূল গানের সুরের অনুসারী।

রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক যাঁরা বাংলা গানের ধারাকে বহন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য নাম— কাজী নজরুল ইসলাম। বস্তুত তাঁর সৃষ্টি করা গানের মধ্যে এত বৈচিত্র্য ছিল যা অন্য কোনো স্রষ্টার গানে পাওয়া যায় না। কিন্তু এটাই আশ্চর্যের ব্যাপার যে এত সম্পদশালী হওয়া সত্ত্বেও দুই বাংলার বাইরে ওঁর গান ততটা প্রসার লাভ করেনি। তারই মধ্যে ওঁর কয়েকটি গানের অনুসরণে হিন্দি ছায়াছবির গান নির্মিত হয়েছিল।

১. শুকনো পাতার নূপুর পায়ে নাচিছে ঘূর্ণী বায় (মূল গান)। ঝুম ঝুম কর চলি অকেলী— ছায়াছবি ‘তাজ’ (১৯৫৬)। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এই গানটি গেয়েছিলেন এবং এই ছায়াছবির সংগীত পরিচালকও ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। মূল গানটির একটা লাইনের সুর হিন্দি গানটিতে অনুসৃত হয়েছিল।
২. অরুণকান্তি কে গো যোগী ভিখারী (মূল গান)। পুছো না ক্যায়সে ম্যায়নে র‍্যান বিতাঈ— ছায়াছবি ‘মেরি সুরত তেরি আঁখে’ (১৯৬৩)। মূল গানটির স্থায়ী ও অন্তরার সুর অনুসরণ করেছিলেন সংগীত পরিচালক শচীন দেব বর্মন এই গানটি নির্মাণের সময়। গানটি গেয়েছিলেন মান্না দে।
৩. মেঘলা নিশি ভোরে মন যে কেমন করে (মূল গান)। রোজ অকেলী আয়ে— ছায়াছবি ‘মেরে আপনে’ (১৯৭১)। সংগীত পরিচালক সলিল চৌধুরী মূল গানের স্থায়ী ও অন্তরার সুর থেকে এই গানটি কম্পোজ করেছিলেন। গানটি গেয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর।

এর পরবর্তীতে একে একে যে-চারজন সংগীত পরিচালকের কথা বলব, তাঁরা তাঁদের দেওয়া মূল বাংলা গানের সুরকে পরবর্তীতে হিন্দি ছায়াছবির গানে ব্যবহার করেছেন।

প্রথমেই আসি কুমার শচীন দেব বর্মন-এর কথায়। তিনি মুখ্যত নিজের গাওয়া কিছু জনপ্রিয় বাংলা গানের সুর পরবর্তীকালে বলিউডের গানে সঠিক প্রয়োগ করেছিলেন এবং সেই রূপান্তরিত গানগুলিও সমান জনপ্রিয় হয়েছিল।

১. গন্ধে বর্ণে ছন্দে গীতিতে হৃদয়ে দিয়েছ দোলা (মূল গান)। ফুলোঁ কী রং সে দিল কী কলম সে— ছায়াছবি ‘প্রেম পূজারী’ (১৯৬৯)। গানটি গেয়েছিলেন কিশোর কুমার।
২. কে যাস রে ভাটি গাঙ বাইয়া (মূল গান)। সুনরি পাওন পাওন পুরবাইয়া
৩. বাঁশি শুনে আর কাজ নাই সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি (মূল গান)। নিঁদ চুরায়ে চ্যান চুরায়ে ডাকা ডালে। ২ ও ৩ নম্বর গান ‘অনুরাগ’ (১৯৭৩) ছায়াছবির, দু-টি গানই লতা মঙ্গেশকর গেয়েছিলেন।
৪. মন নিল না বঁধূ মন নিল যে শুধু (মূল গান)। জানে ক্যা ম্যায়নে কহি— ছায়াছবি ‘প্যায়াসা’ (১৯৫৭)। গানটি গেয়েছিলেন গীতা দত্ত।
৫. শোনো গো দখিন হাওয়া প্রেম করেছি (মূল গান)। খায়ি হ‍্যায় রে হমনে কসম সঙ্গ র‍্যহনে কী— ছায়াছবি ‘তালাশ’ (১৯৬৯)। গানটি গেয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর।
৬. দূর কোন পরবাসে তুমি চলে গ্যালা রে (মূল গান) থেকে ‘গাইড’ (১৯৬৫) ছায়াছবিতে আমরা পেলাম ওয়াহাঁ কৌন হ‍্যায় তেরা মুসাফির গানটা। দু-টি গানই স্বয়ং শচীন দেব বর্মন গেয়েছিলেন।

এর পরে যাঁর কথায় আসব তিনি হলেন এমন এক ব্যক্তিত্ব যিনি একাধারে গীতিকার ও সুরকার— শ্রদ্ধেয় সলিল চৌধুরী। অনেকের মতে যিনি রবীন্দ্রোত্তর যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক বিরল প্রতিভার অধিকারী কম্পোজার। তাঁর সৃষ্টি করা বহু বাংলা গানের সুর পরবর্তীতে হিন্দী ছায়াছবির গানে তিনি সার্থকভাবে ব্যবহার করেছিলেন।

১. জাগো মোহন প্রীতম জাগো (মূল গান)— ছায়াছবি ‘একদিন রাত্রে’ (১৯৫৬)। জাগো মোহন প্যারে জাগো— ছায়াছবি ‘জাগতে রহো’ (১৯৫৬)। দু-টি গানই ছিল লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া।
২. না যেও না রজনী এখনও বাকি (মূল গান) ও সাজনা বরখা বাহার আয়ি— ‘পরখ’ (১৯৬০) ছায়াছবিতে দু-টি গানই লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া।
৩. ও সাজনা সাজনা পুজোর বাজে বাজনা (মূল গান)। ১৯৭৫ সনে গানটি গেয়েছিলেন সবিতা চৌধুরী। ১৯৭৮ সনে মুক্তিপ্রাপ্ত ছায়াছবি ‘মিনু’-তে এই গানটি দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেন অন্তরা চৌধুরী। গানটি হল ও কালি রে কালি রে
৪. ও মোর ময়না গো (মূল গান)। ১৯৭৫ গানটি গেয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর। ইয়ে ঘুঙুরু ম্যায়নে বাঁধি তো— ‘জীবন জ্যোতি’ (১৯৭৬) ছায়াছবিতে, এই গানটি গেয়েছিলেন আশা ভোঁসলে।
৪. ও আমার প্রাণ সজনী চম্পাবতী কন্যা (মূল গান)। ১৯৭০ সনে প্রকাশিত এই গানটি গেয়েছিলেন মানস মুখোপাধ্যায়। ‘অন্নদাতা’ (১৯৭২) ছায়াছবিতে দ্বৈতকণ্ঠে এই গানটি গেয়েছিলেন কিশোর কুমার ও সবিতা চৌধুরী।
৫. নিশিদিন নিশিদিন বাজে স্মরণের বীন (মূল গান) ১৯৬৭। ‘অন্নদাতা’ (১৯৭২) ছায়াছবিতে নিসদিন নিসদিন এই গানটি মূল সুরের অনুসরণে সৃষ্ট। দু-টি গানই গেয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর।
৬. গহন রাতি ঘনায় (১৯৭১)। মূল গানটি গেয়েছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। এই গানের সুরে ‘অন্নদাতা’ (১৯৭২) ছায়াছবিতে রাতোঁ কে সায়ে ঘনে গানটি লতা মঙ্গেশকর গেয়েছিলেন।
৭. আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা (মূল গান) ১৯৬৯। ‘আনন্দ’ (১৯৭১) ছায়াছবিতে রূপান্তরিত গানটি হল: কঁহি দূর যব দিন ঢল যায়ে এবং গানটি গেয়েছিলেন মুকেশ।
৮. ১৯৬৯ সনে সবিতা চৌধুরীর গাওয়া শুধু তোমারই জন্যে সুর তাল আর গান বেঁধেছি গানটিও ‘আনন্দ’ ছায়াছবিতে মুকেশের কণ্ঠে ম্যায়নে তেরে লিয়ে হি পাই।
৯. আবার একই বছরে (১৯৬৯) লতাজির গাওয়া গান না মন লাগে না ‘আনন্দ’ ছায়াছবিতে শুনতে পাই না জিয়া লাগে না রূপে ওঁরই কণ্ঠে।
১০. প্রজাপতি প্রজাপতি আমার ইচ্ছে হয়ে (মূল গান) সবিতা চৌধুরী গেয়েছিলেন। ‘ছোটি সি বাত’ (১৯৭৬) ছায়াছবিতে জানেমন জানেমন তেরে দো ন‍্যয়ন এই গানটি গেয়েছিলেন আশা ভোঁসলে ও যেসুদাস।
১১. জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া পাগল হাওয়া কী আমার মতো তুমিও হারিয়ে গেলে (১৯৬২) গানটির সুরে ‘ছোটি সি বাত’ (১৯৭৬) ছায়াছবিতে লতা মঙ্গেশকর গেয়েছিলেন ন জানে কিঁউ হোতা হ্যায় ইয়ে জিন্দগীকে সাথ
এই প্রসঙ্গে একটা তথ্য জানাই যেটা হয়তো অনেকেরই অজানা। সলিল চৌধুরী তাঁর সুরারোপিত একটি গানের সুরকে চারবার ব্যবহার করেছিলেন। তিনবার বেসিক বাংলা গানে এবং একবার হিন্দি ছায়াছবির গানে।

ক. গুড়ু গুড়ু গুড়ু মেঘ গরজে বিজলি আকাশে— সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।
খ. তুমি কি এখনও এই গান শোনো— সবিতা চৌধুরী।
গ. সবার আড়ালে সাঁঝ সকালে— লতা মঙ্গেশকর।
ঘ. হিন্দি ছায়াছবি ‘অন্নদাতা’-তে (১৯৭২) মুকেশজির গাওয়া গান ন্যায়ন হামারে সাঁঝ সতারে

সলিল পরবর্তী যুগে যিনি সলিল চৌধুরীর ধারায় নিজেকে আরও বিকশিত করেছিলেন তিনি হলেন রাহুল দেববর্মন, সবার অতি প্রিয় পঞ্চমদা। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য এই দুইয়ের সঙ্গম ঘটেছিল তাঁর সুরের বাঁধনে। ভারতীয় সংগীতের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিদেশী যন্ত্রানুষঙ্গের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ তাঁর সুরারোপিত গানে ধরা পড়েছিল। বলা যেতে পারে আধুনিকতার অপর নাম রাহুল দেববর্মন। তিনিও তাঁর দেওয়া প্রচুর বাংলা গানের সুর হিন্দী ছায়াছবির গানে ব্যবহার করেছিলেন যা বাণিজ্যিক সফলতা লাভ করেছিল। তেমনি কিছু গানের উদাহরণ:

১. একদিন পাখি উড়ে যাবে যে আকাশে (মূল গান) তুম বিন জাউঁ কাঁহা কে দুনিয়া মেঁ আ কে— ছায়াছবি ‘প‍্যায়ার কা মৌসম’ (১৯৬৯), বাংলা গানে কণ্ঠদান করেছিলেন কিশোর কুমার এবং হিন্দিতে মহঃ রফি।
২. আকাশ কেন ডাকে এ মন ছুটি চায় (মূল গান)। ইয়ে শাম মস্তানি মাধহোশ কিয়ে যায়ে— ছায়াছবি ‘কাটি পতঙ্গ’ (১৯৭১), দু-টি গানই কিশোর কুমারের গাওয়া।
৩. কথা দিয়ে এলে না (মূল গান)— আশা ভোঁসলে। কোঈ নহী হ‍্যায় কহিঁ— ছায়াছবি ‘কিনারা’ (১৯৭৭)। গানটি গেয়েছিলেন ভুপিন্দর সিং।
৪. জানি না কোথায় তুমি হারিয়ে গেছ (মূল গান)। গানটি গেয়েছিলেন রাহুল দেব বর্মন ও আশা ভোঁসলে। জানে জাঁ ঢুন্ডতা ফির রহা— ছায়াছবি ‘জওয়ানী দিওয়ানী’ (১৯৭২), দ্বৈতকণ্ঠে গানটি গেয়েছিলেন কিশোর কুমার ও আশা ভোঁসলে।
৫. শোনো মন বলি তোমায় সব করো প্রেম করো না (মূল গান) গেয়েছিলেন স্বয়ং রাহুল দেব বর্মন। হিন্দিতে জীবন কে হর মোড় পে মিল জায়েঙ্গে গানটি গেয়েছিলেন কিশোর কুমার ও আশা ভোঁসলে।
৬. ময়না বলো তুমি কৃষ্ণ রাধে গানটি হিন্দিতে রূপান্তরিত হয় ঝুঠা কাঁহি কা মুঝে এ্যয়সা মিলা। এই দু-টি গানই গেয়েছিলেন আশা ভোঁসলে।
৫ ও ৬ নম্বর গান দু-টি ‘ঝুঠা কাঁহি কা’ (১৯৭৯) ছায়াছবির।
৭. আশা ভোঁসলের গাওয়া কিনে দে রেশমি চুড়ি (মূল গান) থেকে নেওয়া সুরে ‘কসমে ওয়াদে’ (১৯৭৭) ছায়াছবির গান: মিলে যো কড়ি কড়ি এক জঞ্জির বনে। গানের শিল্পীরা ছিলেন মহঃ রফি, আশা ভোঁসলে ও কিশোর কুমার।
৮. রাহুল দেব বর্মনের গাওয়া প্রথম বাংলা গান মনে পড়ে রুবি রায় থেকে আমরা পেলাম মেরি ভিগি ভিগি সি। ‘অনামিকা’ ছায়াছবিতে (১৯৭৩) গানটি গেয়েছিলেন কিশোর কুমার।
৯. ডেকে ডেকে কত কথা ছিল যত (মূল গান) গেয়েছিলেন রাহুল দেব বর্মন। ছায়াছবি ‘নমকহারাম’-তে (১৯৭৩) গানটি গেয়েছিলেন কিশোর কুমার।
১০. রাহুল দেব বর্মনের গাওয়া আর একটি জনপ্রিয় গান হল যেতে যেতে পথে হল দেরি। ছায়াছবি ‘আঁধি’-তে (১৯৭৫) লতা মঙ্গেশকর ও কিশোর কুমারের যুগ্মকণ্ঠে এই গান রূপ পেল তেরে বিনা জিন্দগী সে কোঈ শিকয়া তো নহী

রাহুল দেব বর্মন আবার তাঁর পিতা শচীন দেব বর্মনের সুরারোপিত ও গাওয়া দু-টি গান নিজের সংগীতায়োজনে চলচ্চিত্রে ব্যবহার করেছিলেন।

১. হায় কী যে করি এ মন নিয়া (মূল গান)। তুনে ও রঙ্গিলে ক‍্যায়সা জাদু কিয়া— ছায়াছবি ‘কুদরত’ (১৯৮১)।
২. মধু বৃন্দাবনে দোলে রাধা (মূল গান)। মিঠে বোল বোলে বোলে পায়লিয়া— ছায়াছবি ‘কিনারা’ (১৯৭৭)। দ্বৈতকণ্ঠে গানটি গেয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর ও ভুপিন্দর সিং।

এই পর্যায়ে সবশেষে যাঁর কথা বলব তিনি হলেন রবীন্দ্র জৈন যিনি অবাঙালি হয়েও সুরকার হিসেবে নিজেকে প্রথম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাংলা গানের মাধ্যমে। ওঁর ও প্রশান্ত চৌধুরীর জুটি (রবীন্দ্র প্রশান্ত) এক সময় অনেক জনপ্রিয় গান আমাদের উপহার দিয়েছেন। রবীন্দ্র জৈনের সুর করা এমনই দু-টি বাংলা গানের কথা উল্লেখ করব যা পরবর্তীতে হিন্দি ছায়াছবির গান হিসেবে মূল বাংলা গানের চেয়েও জনপ্রিয় হয়েছিল। দু-টি গানেরই গীতিকার ছিলেন ভবেশ গুপ্ত এবং শিল্পী ছিলেন শিপ্রা বসু।

১. ভালোবেসে রাধা শুধু নিলে বদনাম (১৯৬৪)। শ্যাম তেরি বনসি পুকারে রাধা নাম— ছায়াছবি ‘গীত গাতা চল’ (১৯৭৫)। গানটি দ্বৈতকণ্ঠে গেয়েছিলেন আরতি মুখোপাধ্যায় ও যশপাল সিং।
২. আমার বাদলদিন আমারে যে একা রেখে যায় (১৯৬৯)। বরখা কা মৌসম জি কো জ্বালাকে চলা যায়— ছায়াছবি ‘সলাখেঁ’ (১৯৭৫)। গানটি গেয়েছিলেন আশা ভোঁসলে।

আবার জনপ্রিয় হিন্দি ছায়াছবির গানের সুরের আকর্ষণে বাংলা ভাষার কিছু গান হয়েছে। এমন কিছু গানের উদাহরণ এখানে দিলাম:

১. ঘড়ি ঘড়ি মেরা দিল ধড়কে (মূল গান)— ছায়াছবি ‘মধুমতী’ (১৯৫৮), সংগীত পরিচালক সলিল চৌধুরী। সেই একই বছর এই গান আকাশবাণীর নিজস্ব অনুষ্ঠান ‘রম্যগীতি’-র জন্য রেকর্ড করা হয় এবং ১৯৭২ সনে সেই গান রেকর্ড আকারে পাব্লিশড হয়। গানটি হল হলুদ গাঁদার ফুল দে এনে দে, গানটি সবিতা চৌধুরীর কণ্ঠে গাওয়া।
২. আহা রিমঝিম কী ইয়ে প্যারে প্যারে (মূল গান)— ছায়াছবি ‘উসনে কহা থা’ (১৯৬০), গানটি গেয়েছিলেন তালাত মেহমুদ ও লতা মঙ্গেশকর। বাংলায় আহা ওই আঁকাবাঁকা পথ যায় সুদূরে (১৯৬২) এই গানটি গেয়েছিলেন শ্যামল মিত্র।
৩. মিলা হ্যায় কিসিকা ঝুমকা (মূল গান)— ছায়াছবি ‘পরখ’ (১৯৬০)। বাংলায় এনে দে এনে দে ঝুমকা (১৯৬২) গানটি গেয়েছিলেন সবিতা চৌধুরী।
৪. ন‍্যায়না বরসে রিমঝিম রিমঝিম (মূল গান)। নয়নে বরষা রিমঝিম রিমঝিম (১৯৬৬), বাংলায় গানটা গেয়েছিলেন ইলা বসু।
৫. লগ যা গলে কে ফির সে (মূল গান)। বাংলাতে সঙ্গী যে কে এ মন কে আমার আজ দোলালো (১৯৬৮) গানটি গেয়েছিলেন শিপ্রা বসু। দু-টি গানই ‘ওহ কৌন থি’ (১৯৬৫) ছায়াছবির এবং সংগীত পরিচালনা করেছিলেন মদন মোহন, মূল গান দু-টিই লতা মঙ্গেশকর গেয়েছিলেন।
৬. দোস্ত দোস্ত না রহা— ছায়াছবি ‘সঙ্গম’ (১৯৬৪)। গানটি শঙ্কর জয়কিষন-এর সুরে মুকেশ গেয়েছিলেন। বাংলায় গানটি গেয়েছিলেন মৃণাল চক্রবর্তী। ঢেউ ঢেউ উথাল পাথাল (১৯৬৪)।
৭. কোঈ হোতা কিসকো অপনা (মূল গান)— ছায়াছবি ‘মেরে আপনে’ (১৯৭১)। এর বাংলা ভার্সন আমরা পেয়েছিলাম ১১ বছর পর ১৯৮২ সনে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে যেতে যেতে পথ ভুলেছি

এই লেখায় আমার উদ্দেশ্য ছিল বহতা নদীর মতো একই সুরের ধারায় প্রবাহিত গানের সাথে ভিন ভাষায় তৈরি গানের মেলবন্ধন নিয়ে আলোচনা করা। উল্লিখিত তালিকায় দেওয়া গানের বাইরে আরও অনেক গান রয়েছে কিন্তু এই ধরনের সমস্ত গানের একটি তালিকা বানানো আমার লক্ষ্য ছিল না।

আসলে যা বলতে চেয়েছি, ভাষা সংগীতের ক্ষেত্রে কোনো অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় না। আমরা সমগ্র বিশ্বের মানবজাতি সংগীতের মূল কেন্দ্রে অর্থাৎ সুর তাল ছন্দের আকর্ষণে বুঁদ হয়ে থাকি, তাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হই ঋদ্ধ হই। এই যে একটি গানকে কেন্দ্র করে অন্য গান সৃষ্টি করা, এতে স্রষ্টার কোনো মর্যাদাহানি হয় না বা কাজটিও অগৌরবের নয়। বরং এই কাজের মাধ্যমে বৃহত্তর শ্রোতার কাছে তাঁদের সৃষ্টিকে পৌঁছে দেওয়া যায় এবং তারিফ বা ভালোবাসা পাওয়া যায় যেটা একজন স্রষ্টার কাছে পরম কাঙ্ক্ষিত এক উপহার।

Facebook Comments

পছন্দের বই