লেখক নয় , লেখাই মূলধন

অরূপ চক্রবর্তীর ধারাবাহিক: জলসাঘর

তৃতীয় পর্ব

মোহর-কণিকা

প্রাক্কথন

“শিশুকাল থেকেই আমাকে শান্তিনিকেতনের পরিবেশ এবং রবীন্দ্রসংগীতের আবেশ আছন্ন করে রেখেছে। আমি নিজেই জানি না আমি কেন গান গাইছি, কী দিচ্ছি, কী পাচ্ছি। শুধু জানি মনে ভরে উঠছে নিবেদনের ভঙ্গিতে। গানগুলি নৈবেদ্য আর গাওয়াটা নিবেদন”

এই কথাগুলি যাঁর অন্তরের, তিনি আর কেউ নন, অণিমা মুখোপাধ্যায় ওরফে কণিকার। ১৯২৪ সালের ১২ অক্টোবর অণিমার জন্ম বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের অন্তর্গত সোনামুখী গ্রামে। সেখানে তাঁর মা অনিলা দেবীর পিত্রালয়। পাঁচ বোন ও তিন ভাইয়ের মধ্যে অণিমা ছিলেন জ্যেষ্ঠা। অণিমার বাবা সত্যচরণ মুখোপাধ্যায় ছিলেন বিষ্ণুপুর ঘরানার শিক্ষায় শিক্ষিত একজন দক্ষ এস্রাজবাদক এবং মা ছিলেন অসামান্য কণ্ঠের অধিকারিণী। তাই জন্মসূত্রেই তাঁর রক্তে মিশেছিল সুরের ধারা এবং বিষ্ণুপুর ঘরানার ঐতিহ্য।

শান্তিনিকেতনের সঙ্গে তাঁদের যোগসূত্র ঘটে রাজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাধ্যমে। রাজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল দু-জনেই ছিলেন হেতমপুর রাজ কলেজের ছাত্র এবং অন্তরঙ্গ বন্ধু। তাঁরা দু-জনেই ছিলেন শ্যামাচরণ লাহিড়ী মহাশয়ের শিষ্য। ১৯০১ সালে বোলপুর ব্রহ্মচর্যাশ্রম বা ব্রহ্মবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা রবীন্দ্রনাথ— এই তথ্য জানার পরে ভূপেন্দ্রনাথ এখানে অধ্যাপক রূপে যোগদান করেন এবং পরবর্তীতে ১৯০২ সালে ভূপেন্দ্রনাথের পরামর্শে ও রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে রাজেন্দ্রনাথ অধ্যাপক রূপে আশ্রম বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। সঙ্গে অতিরিক্ত দায়িত্বভার পান আশ্রম বিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষের। এরপর রাজেন্দ্রনাথ তাঁর নিজের ছেলে সত্যেন্দ্রনাথ ও জামাই (ভাইঝির স্বামী) সত্যচরণকে নিয়ে আসেন শান্তিনিকেতনে। সত্যচরণ যোগদান করেন কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে গ্রন্থাগারিক প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়ের সহকারী রূপে। এই সূত্রেই সত্যচরণের পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা একে একে শান্তিনিকেতনের বাসিন্দা হয়ে যান। ১৯২১ সালে বিয়ের পর থেকে সত্যচরণ সংসার পেতে থাকতে শুরু করেন। ১৯২৪ সালে জন্ম হয় কন‍্যা অণিমার যাঁর ডাকনাম ছিল মোহর। এই সময় থেকে রবীন্দ্রনাথ বিশেষভাবে উদ্যোগী হয়েছিলেন তাঁর স্বপ্নের বিশ্বভারতী সৃষ্টিতে।

শান্তিনিকেতনের পূর্বতন আশ্রমের দক্ষিণ প্রান্তে নয়টি মাটির বাড়ি নিয়ে তৈরি হয়েছিল গুরুপল্লী বা দক্ষিণপল্লী এবং এই বাড়িতে থাকতেন বিদ্যালয়ের প্রধান সহকর্মীরা, যাঁদের অন্য পরিচয় ছিল আশ্রমের ‘নবরত্ন’ নামে। এঁরা ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সকল কাজ ও চিন্তনের কাণ্ডারী। এই নবরত্নের একজন হলেন সত্যচরণ মুখোপাধ্যায় (অণিমার পিতা)। এঁরা প্রত্যেকেই অত্যন্ত গুণী ব্যক্তিত্ব এবং পাণ্ডিত্যের অধিকারী। আশ্রমের উত্তর প্রান্তে ছিল রবীন্দ্রনাথের আবাসস্থল ‘উত্তরায়ণ’। এছাড়া আশ্রমের পুব পশ্চিমে থাকতেন অন্যান্য আশ্রমিকগণ যা পূর্বপল্লী ও পশ্চিমপল্লী নামে পরিচিত।

আশ্রমকন‍্যা অণিমার গুরুদেবের সান্নিধ্য ও শিক্ষালাভ

তখনকার শান্তিনিকেতনের রূপের সঙ্গে বর্তমানের শান্তিনিকেতনের বিস্তর ফারাক। তখন ছিল দিগন্ত প্রসারিত কাঁকরযুক্ত লাল মাটির খোলা প্রান্তর, শাল ও তালবীথি, কোপাই নদী আর খোয়াই। এছাড়া ছিল গ্রাম বাংলার নানা ধরনের ফল ও ফুলের গাছ। প্রকৃতি ছিল নির্মল দূষণহীন। এক-একটা ঋতু তাদের রূপবৈচিত্র‍্য নিয়ে ধরা দিত।

এমনই এক গ্রীষ্মের শেষ বিকালবেলায় সেদিন ঝড় উঠেছিল। সেই ঝড়ের মধ্যে কিশোরী মোহর তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে ছুটেছিলেন আমি কুড়োতে আশ্রমের উত্তরে যেখানে গুরুদেবের আবাসস্থল। সেই ঝড় ক্রমে প্রলয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে সঙ্গে শুরু হয় প্রবল বৃষ্টি। আম জাম সুপারি তাল তমালের গাছেরা যেন বিক্ষুব্ধ! প্রবল আক্রোশে তারা ফুঁসছে, ডালপালা ঝাঁকিয়ে তারা বিদ্রোহ ঘোষণা করছে।

সকলেই ঝড়বৃষ্টি থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য নানান দিকে ছুটেছিল। মোহরও ছুটে আশ্রয় নিয়েছিলেন একটি মাটির বাড়ির দাওয়ায়। হঠাৎ তাঁর চোখ পড়ে যায় বাড়িটির জানলায়। দেখেন সাদা চুল, গালভরা সাদা দাড়ির সেই দিব্য পুরুষকে, যাঁর পরিচিতি শান্তিনিকেতনের প্রতিটি মানুষের অস্থিমজ্জায়, হৃদয়ে। তিনি তাঁর সুগভীর দৃষ্টি মেলে প্রকৃতির এই লীলা অবলোকন করছেন। যখন তাঁর চোখ পড়ে কিশোরী মোহরের দিকে, তখন তিনি মোহরকে ডাকেন এবং জিজ্ঞেস করেন সে গান জানে কিনা। কিশোরী মোহর সম্মতি জানাতে তিনি গান শোনাতে বলেন এবং মোহরও তাঁকে গান শুনিয়ে দেন। গুরুদেব খুশি হয়ে তাঁকে বলেন মাঝে মাঝে এসে গান শুনিয়ে যাবার কথা। এইভাবে শুরু হয় গুরুদেব ও অণিমার (মোহর) প্রথম সাক্ষাৎ। এর কিছুদিন পর তিনি অণিমা থেকে গুরুদেবপ্রদত্ত ‘কণিকা’ নামেই পরিচিতি লাভ করেন।

কণিকার কথায়, “শিশুকাল থেকেই আমরা পড়াশোনার সঙ্গেই নাচ-গান-খেলা-ছবি আঁকা শিখেছি। আর একটা বিষয় ছিল প্রকৃতি পাঠ। পাখির ডাক শুনেই বুঝতাম কোন পাখি ডাকছে। কোন প্রজাপতি কোন গুটিপোকা থেকে হয়েছে— তাও জানতাম। প্রকৃতি পাঠে এইগুলোই আমাদের শেখানো হতো। গাছপালার সাথে তাই ছিল অচ্ছেদ্য সম্পর্ক। আর নানা ঋতুতে নানা ফুল আমাদের মনকে রাঙিয়ে রাখতো।

গুরুদেবের সান্নিধ্য পেয়েছি সেই থেকেই। যখনই ওঁর কাছে যেতাম তখনই উপহারস্বরূপ হাতে এসে যেতো লজেন্স বা বাদাম। আমার নানা দেশের স্ট্যাম্প জমানোর নেশা ছিল। রোজই প্রায় তাঁর কাছে যেতাম স্ট্যাম্প নিতে। পাশে অনেক সময়েই বসে থাকতে দেখেছি এন্দ্রুজ সাহেবকে। তিনিও আমাকে স্ট্যাম্প দিতেন।

আমার গানের দিকে নজর পড়েছিল স্বয়ং গুরুদেবের। আমি গান শিখতে যেতাম দিনুদার (দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর) কাছে। তাঁর সেই বিরাট চেহারা। আমরা তাঁর ঘাড়ে চেপেই গান শিখেছি। সেই সময় রমা কর (নুটুদি), অমিতা সেন— এঁদের কাছেও শিখেছি। শান্তিদা চীনা ভবনের কাছে এক ‘টিনের ঘরে’ আমাদের গানের ক্লাস নিতেন। আর ছিলেন শৈলজাদা। গুরুদেব সব সময়েই শৈলজাদাকে বলতেন আমার গানের দিকে নজর দিতে।

ক্লাসিক্যাল গানও শিখতাম। শ্রীযুক্ত হেমেন্দ্রলাল রায় আমাদের ঐ ক্লাসটা নিতেন। পরবর্তী সময়ে ওয়াঝেলওয়াড়ের কাছেও শিখেছি”।

লেখাপড়া খেলাধুলার সঙ্গে গানটাও কিশোরী মোহরের মনে গভীর রেখাপাত করতে শুরু করেছিল
গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ, অন্যান্য গুণীজনের সাহচর্য ও শান্তিনিকেতনের পরিমণ্ডলকে ঘিরে। সেই সময় শান্তিনিকেতনের সাংগীতিক পরিবেশে বিষ্ণুপুর ঘরানার প্রভাব ছিল উল্লেখনীয়। বিষ্ণুপুরের বিখ্যাত অনেক গাইয়ে বাজিয়ে, যথা রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, অশেষ বন্দ্যোপাধ্যায়, অনাদিনাথ দত্ত প্রভৃতি গুণী সাংগীতিক ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যলাভ করে শান্তিনিকেতনের সংগীতভবন তখন ঋদ্ধ। এই ঘরানার ও রবীন্দ্রগানের ধারা বহন করে যাঁরা নিজেদের পুষ্ট করেছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু নাম অমিয়া ঠাকুর, অমিতা সেন, রমা কর প্রভৃতি। এই ধারারই এক স্বয়ংসম্পূর্ণ উত্তরসূরী হলেন কণিকা। এই সংগীতধারার আরও কয়েকজন উজ্জ্বল তারকা হলেন নীলিমা সেন, সুচিত্রা মিত্র, সেবা মিত্র, আরতি বসু, প্রমুখ।

শুধু গান নয়, ছোটোবেলা থেকেই অভিনয়েরও ডাক পেয়েছেন ছোটোদের দলে। রবীন্দ্রনাথ নিজেই সবাইকে অভিনয় শিখিয়ে দিতেন। একবার রবীন্দ্রনাথ ‘শারদোৎসব’ নাটক করিয়েছিলেন। তাতে অন্যান্য ছোটোদের সঙ্গে কণিকা অভিনয় করেছিলেন এবং এই নাটকে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নিজেও অভিনয় করেছিলেন। আর একবার উত্তরায়ণের পিছনের হল ঘরে ‘তাসের দেশ’-এর রিহার্সাল চলছে। গানের দলে অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে ছিলেন কণিকা। হঠাৎ গুরুদেব কণিকাকে ডাকলেন দহলানীর ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য। নিজে অভিনয় দেখিয়ে দিলেন এবং যথারীতি কণিকা অভিনয়েও উৎরে গেলেন। ‘তাসের দেশ’-এর দহলানীর ভূমিকার গান “কেন নয়ন আপনি ভেসে যায় জলে” গানটি গুরুদেব তাঁর শ্যামলী বাসভবনে বসে কিশোরী কণিকাকে শিখিয়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ একবার বোম্বে গিয়েছিলেন। অন্যান্য গুণীজনের সঙ্গে কিশোরী কণিকাও গিয়েছিলেন সেখান। রবীন্দ্রনাথ উঠেছিলেন সরোজিনী নাইডুর বাড়িতে। রোজ গুরুদেবের সাথে দেখা করার জন্য সবাই মিলে সরোজিনী নাইডুর বাড়িতে আসতেন। গুরুদেব নিজে কণিকাকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন কীভাবে কাঁটা চামচ দিয়ে খেতে হয়।

রবীন্দ্রনাথ জীবিত থাকাকালীন ১৯৩৭ সালে কলকাতা প্রথম আসেন কণিকা বর্ষামঙ্গল অনুষ্ঠান করতে। তখন তাঁর বয়স ১৩ বছর। কলকাতা ও শান্তিনিকেতনের ছেলেমেয়েদের নিয়ে এই অনুষ্ঠান উত্তর কলকাতার ছায়া প্রেক্ষাগৃহে হয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানে কণিকার কণ্ঠে ছিল “ছায়া ঘনাইছে বনে বনে” গানটি। স্টেজের একধারে ডেকচেয়ারে বসেছিলেন কবি। কণিকা সেই চেয়ারের একপ্রান্ত ধরে দাঁড়িয়ে গাইছিলেন এই গানটি। হঠাৎ তিনি দেখলেন যে তাঁর গানের সাথে কবিও গলা মেলাচ্ছেন।

আরও একটি ঘটনার উল্লেখ করছি। তখন ‘ডাকঘর’ নাটকের মহড়া চলছে। সুধার ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য মনোনীত হয়েছেন কণিকা। প্রতিদিন নাটকের মহড়া চলে এবং এই ব্যাপারটা ছিল কিশোরী কণিকার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণের। কারণ, গুরুদেব নিজেই সবাইকে অভিনয় শিখিয়ে দিতেন। ডাকঘর নাটকের গানগুলি ছিল কণিকার খুব প্রিয়। তার মধ্যে বিশেষ করে ভালো লাগত “শুনি ওই রুনুঝুনু পায়ে পায়ে নুপুর ধ্বনি” গানটি। এইসময় পর পর কয়েকদিন গুরুদেব “সমুখে শান্তি পারাবার” গানটি গাইতেন। তাঁর অপূর্ব দরদ মাখানো ভঙ্গিতে গাওয়া এই গানটি শুনে সবাই মুগ্ধ হয়ে যেত। এই গানটি গাওয়ার পর গুরুদেব বলতেন, “আমার মৃত্যুর পর এ গানটি যেন গাওয়া হয়”। এই কথা শুনে কণিকার মন খারাপ হয়ে যেত এবং মনে হত কেন তিনি বারবার এ-কথা বলেন।

(পরবর্তী অংশ আগামী পর্বে)

প্রথম পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব

Facebook Comments

পছন্দের বই