লেখক নয় , লেখাই মূলধন

অরূপ চক্রবর্তীর ধারাবাহিক: জলসাঘর

ষষ্ঠ পর্ব
গওহরজান: এক সুরেলা অধ্যায়

বেনারসের ধনী সম্প্রদায়ের মানুষের পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন অনুষ্ঠান গাইতে শুরু করার পর মালকার নাম হল ‘মালকা জান’। নামের সাথে এই ‘জান’ শব্দটা জুড়ে যাওয়ার অর্থ ছিল বেনারসের বাঈজি গোষ্ঠীর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়া।  আগ্রার আগ্রাওয়ালি মালকা জান, মুল্ক পুখরাজের মালকা জান ও চুলবুলের চুলবুলওয়ালি মালকা জানের থেকে আলাদা করার জন্য মালকাকে ‘বড়ি মালকা জান’ বলা হত।

কিশোরী গওহর ক্রমে বড়ো হতে লাগলো এবং তার অত্যন্ত ফর্সা গায়ের রং, মুখের আদল ও বাদামি চোখ সবকিছু মিলিয়ে চেহারায় আ্যংলো ইন্ডিয়ান ধারার ছাপ ফুটে উঠছিল। সাথে মায়ের মতো কাব্যে অনুরাগ ও সংগীতপ্রতিভার বৈশিষ্ট্যও ধীরে ধীরে প্রকাশিত হচ্ছিল এবং এইসব গুণ মালকার নজর এড়ায়নি। মেয়েকে সংগীতে পারদর্শী করে তোলার দায়িত্ব নিলেন মালকা। প্রাথমিক শিক্ষাদানের পর বেনারসের শাস্ত্রীয় সংগীতের বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী পণ্ডিত বেচু মিশ্রকে মেয়ের তালিমের জন্য অনুরোধ করেন। খেয়াল ছাড়াও ঠুমরি, টপ্পা, তারানা ইত্যাদি বিষয়ে বেচু মিশ্র ছিলেন দিকপাল ব্যক্তিত্ব। তিনি খুব ভালো সারেঙ্গী বাজাতে পারতেন। গওহরের কণ্ঠস্বর শুনেই তিনি বুঝে যান যে, এই মেয়ে গান গাইবার জন্যই জন্মেছে এবং কঠোর অনুশাসন ও নিয়ম নিষ্ঠার মধ্যে শিক্ষাদান শুরু করেন।

এর কয়েক বছর পর মালকা গওহরকে নিয়ে মুজরায় যেতে শুরু করেন এবং এইসাথে গওহরও প্রকাশ্যে অনুষ্ঠান করার অভিজ্ঞতা লাভ করতে শুরু করেন।

দর্শকরাও ইউরোপিয়ান ধাঁচের একটা ফুটফুটে মেয়েকে মায়ের সাথে গাইতে দেখে আনন্দ পেতেন এবং ক্রমেই মা ও মেয়ের এই জুটির কথা সারা শহরের এক আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়াল।

এই সময়েই কলকাতাও সংগীত, নৃত্য ও বিভিন্ন ধারার শিল্পচর্চার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছিল। এর অন্যতম কারণ রাজত্ব হারানো আউধের নবাব ওয়াহিদ আলী শাহের পৃষ্ঠপোষকতা। ইংরেজদের হাতে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে তিনি কলকাতার মেটিয়াবুরুজ অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করেন। কাব্যরস, সংগীত, নৃত্য ইত্যাদিতে নিবেদিতপ্রাণ নবাব নিজেই উদ্যোগী হয়ে কলকাতা ও তার আশপাশের অঞ্চলকে নিয়ে আর একটা লখনউ গড়ে তুলতে চাইলেন। কলকাতার ব্যাপ্তি ধীরে ধীরে সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়তে লাগল এবং মালকার পরিবারের লোকেরা চাইছিলেন মালকা কলকাতা এসে তার ভাগ্য পরীক্ষা করুক। অবশেষে চার বছর পর বেনারসের পাঠ চুকিয়ে সপরিবারে মালকা জান কলকাতা রওনা দিলেন।

উত্তর কলকাতার চিৎপুর ছিল সাহেবদের কাছে ‘ব্ল্যাক টাউন’। সেখানেই নিজের আস্তানা গড়লেন মালকা। সামাজিক সবরকমের গোষ্ঠীর মানুষের মিলনস্থল ছিল চিৎপুর। ব্যস্ত ও কোলাহল মুখর চিৎপুরে শিয়া মুসলিমপ্রধান মানুষের ধর্মীয় স্থান ছিল নাখোদা মসজিদ। এছাড়া কাছাকাছি ছিল কিছু বিখ্যাত পরিবারের বাসস্থান। যেমন জোড়াসাঁকোয় ঠাকুর পরিবার, কালীপ্রসন্ন সিংহ, দিওয়ান বারাণসী ঘোষ, কৃষ্ণদাস পাল ইত্যাদির বাসস্থান। তেমনি ছিল আদি ব্রাহ্মসমাজ, জোড়াসাঁকো ভারতী নাট্যসমাজ, মিনার্ভা লাইব্রেরি ও ওরিয়েন্টাল সেমিনারীর মতো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। বউবাজার অঞ্চলের বাইজিদের কোঠাগুলিতেও ছিল অভিজাত ব্যক্তিদের নিয়মিত যাতায়াত— সেখানে ছিল সুর, সুরা ও যৌবনের পসরার হাতছানি।

খুরশিদ ও মালকা চিৎপুর অঞ্চলে একটা বাড়ি ভাড়া করেন এবং ধীরে ধীরে কলকাতার নানা জায়গা থেকে ‘বাবু’দের থেকে অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পেতে শুরু করেন। বেনারসের মতো কলকাতার শিল্পসংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এইসব ধনী ‘বাবু’-রা। এঁরা দুর্গাপূজা, দোল উৎসব, পারিবারিক নানা অনুষ্ঠান যেমন বিয়ে, উপনয়ন, অন্নপ্রাশন, নামকরণ ইত্যাদিতে যাত্রা পালা, কবির লড়াই, খেউর, খেমটা ও বাঈ গানের আসর বসাতেন।

কলকাতা শহরে আসার পরে মালকা-র গানের খ্যাতি এই শহরেও বিস্তার লাভ করছিল। অবশেষে এল সেই ব্রাহ্ম মুহূর্ত— আউধের ক্ষমতাচ্যূত নবাব ওয়াজেদ আলী শাহের মেটিয়াবুরুজের দরবারে গান গাইবার আমন্ত্রণ, যার অপেক্ষায় ছিলেন মালকা। নবাবের সামনে নিজের সাংগীতিক দক্ষতা প্রকাশের এমন সুযোগ হাতছাড়া করলেন না। মেয়ে গওহরকে সাথে নিয়ে সেদিনের আসরে ওয়াজেদ আলীর রচিত দু-টি গান— ‘বাবুল মোরা নৈহার ছুটো হি যায়’ ও ‘যব ছোড় চলে লখনউ নগরী’ মালকা পেশ করলেন। নিজেকে উজাড় করে দেওয়া নিবেদন। ফলস্বরূপ নবাব মালকাকে প্রচুর উপহারে ভূষিত করলেন এবং তাকে সভাগায়িকা নিযুক্ত করলেন। সেদিনের সভায় উপস্থিত ছিলেন বিখ্যাত ঠুমরি ও কত্থক নৃত্যশিল্পী বিনদাদিন মহারাজ। কিশোরী গওহরের প্রতিভায় মুগ্ধ বিনদাদিন মহারাজ গওহরকে শিক্ষাদানের আগ্রহ প্রকাশ করেন। ঘটা করে গান্ডা বন্ধন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কিশোরী গওহরের শিক্ষা শুরু হলো। দিনে প্রায় ১২ ঘণ্টা ধরে চলতো এই শিক্ষাদান ও রেওয়াজ পর্ব। সবধরনের গানের প্রশিক্ষণের জন্য মালকা মেয়েকে বামাচরণ ভট্টাচার্যের কাছে বাংলা গান, রমেশচন্দ্র দাসের কাছে কীর্তন, সৃজনবাঈ এর কাছে ধ্রুপদ শেখার জন্য পাঠাতেন। মিসেস ডি সিলভাকে নিযুক্ত করেন ইংরেজি শিক্ষার জন্য এবং নিজে মেয়েকে উর্দু ও ফারসি শেখাতে শুরু করেন। ক্রমে গওহর বাংলা, হিন্দি, উর্দু, ইংরেজি ও ফারসি পড়তে, লিখতে ও এইসব ভাষায় গান গাইতে শিখে যায়। এইভাবে মালকা মেয়ের সাহিত্য, সংগীত ও নৃত্যশিক্ষার এক মালা গাঁথার কাজ সম্পূর্ণ করেন যাতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তার বহুমুখী প্রতিভার কথা চর্চিত হয় এবং সে খ্যাতি লাভ করে।

এর মধ্যে দ্বারভাঙ্গার রাজদরবারে গান গাইবার আমন্ত্রণ পান মালকা। কিন্তু মালকা সেখানে নিজে না গিয়ে মেয়েকে পাঠানোর মতো এক সময়োপযোগী ও বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত নেন। এই প্রথম গওহর একক শিল্পী রূপে কোনো মজলিসে গাইবার সুযোগ পান এবং প্রথম চালেই কিস্তিমাত করেন তার চর্চিত সুরেলা ও আবেগঘন সংগীতের মাধ্যমে। সাথে উপরি হিসাবে ছিল অসামান্য রূপ ও সম্ভ্রম আদায় করা ব্যক্তিত্ব। অনুষ্ঠান শেষে মহারাজ লক্ষেশ্বর সিংহ তাঁকে নানা পুরস্কারে ভূষিত করেন এবং রাজদরবারের সভাগায়িকা নিযুক্ত করেন।

এই অনুষ্ঠানের সাফল্যের পর গওহরের নামের পাশে একটা বিশেষণ জুড়ে গিয়েছিল এবং এরপর থেকে তাকে ‘গওহরজান’ বলে ডাকা শুরু হয়েছিল। গওহর নিজেকে শুধুমাত্র নাচ বা বিভিন্নধারার গান গাওয়ার মধ্যে আবদ্ধ রাখেন নি, তার মায়ের মতো সেও শায়েরী ও সংগীত রচনা করা শুরু করেছিল। তার ছদ্মনাম ছিল ‘হমদম’ ও ‘গওহরপিয়া’। দ্বারভাঙ্গার অনুষ্ঠানের সফলতার পর থেকে নিয়মিত ভাবে কলকাতা ও বাইরের বিভিন্ন অভিজাত পরিবারে অনুষ্ঠানে গান গাইবার আমন্ত্রণ আসতে লাগলো। গওহরের গান ছাড়া কোনো ম‍্যহফিলই যেন পূর্ণতা লাভ করতো না। ধীরে ধীরে গওহরজান জলসা বা মুজরোর জগতে পেশাদার ও অদ্বিতীয় শিল্পীরূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করলেন।

১৯ শতকের মধ্যভাগ থেকে সংগীতের পাশাপাশি তথাকথিত শিক্ষিত ও আধুনিকমনা মানুষের বিনোদনের আর একটি আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠেছিল থিয়েটার। ভারত চন্দ্র রায় গুনাকরের ‘বিদ্যসুন্দর’ ও মাইকেল মধুসূদনের ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক মঞ্চস্থ হবার সাথে সাথেই থিয়েটারের জগতের দ্বার যেন উন্মোচিত হল। রামনারায়ণ তর্করত্ন, মনমোহন বসু, দীনবন্ধু মিত্র, অমৃতলাল বসু, গিরিশচন্দ্র ঘোষ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহায়তায় তা আরও বিকাশ লাভ করতে শুরু করেছিল।

কলকাতাবাসীদের এই সংগীত ও নাট্যপ্রীতির কথা ব্রিটিশ কোম্পানিগুলির কাছে পৌঁছেছিল। সেই সময় গ্রামোফোন মেশিন ও রেকর্ডের সম্ভাবনাময় ব্যবসার কথা মাথায় রেখে কলকাতায় তাদের এজেন্ট নিয়োগের কথা ভাবেন এবং ফলস্বরূপ ১৯০২ সালে জিটিএল কোম্পানি মি. গেসবার্গকে কলকাতা পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। গেসবার্গ কলকাতা এসে প্রথমেই বিভিন্ন থিয়েটার গুলি দেখতে শুরু করেন। উদ্দেশ্য ছিল স্থানীয় শিল্পীদের মধ্যে থেকে রেকর্ডে গাইবার মতো উপযুক্ত কাউকে খুঁজে বের করা। কিন্তু থিয়েটারে তথাকথিত ‘নচ গার্ল’দের (নাচ গান করা মেয়েদের ইংরেজিতে এই নামেই অভিহিত করা হত) পারফরম্যান্স দেখে হতাশ হন। এরপর বিভিন্ন ম‍্যহফিল ঘুরেও তার অভিজ্ঞতা সুখের হচ্ছিল না। গায়িকাদের ঝলমলে পোশাক ও অলংকারে ভূষিত দেহ, পান সুপারির রসে রঞ্জিত ওষ্ঠ ও অঙ্গসঞ্চালন করা দেখে তিনি ক্রমেই আগ্রহ হারাতে শুরু করেন।

এর পরবর্তীতে এক বাঙালিবাবুর ঘরোয়া আসরে গেসবার্গ যান এবং সেখানে গিয়ে ওঁর ভিন্ন অভিজ্ঞতা হয়। চেহারায় ইউরোপীয় ধাঁচের আদল, গৌরবর্ণা অনিন্দ্যসুন্দরী ও আভিজাত্যপূর্ণ এক মহিলাশিল্পী আসরে প্রবেশ করে সকলকে নিঁখুত ইংরেজি উচ্চারণে সম্বোধিত করে গান পরিবেশন করলেন। এঁর কন্ঠস্বর ও গায়কী আগের সব বিরূপ প্রতিক্রিয়াকে দূর করে দিলো। গান শুনে ওঁর মনে হল এই শিল্পী যেন রেকর্ডে গান গাইবার জন্যই জন্মেছে। শিল্পীর বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন ইনি একজন আর্মেনিয়ান ইহুদি এবং বর্তমানে ধর্মান্তরিত হয়েছেন। ২০টি ভাষায় গান করতে সক্ষম ২৯ বছর বয়সী এই শিল্পীর নাম গওহরজান।

অবশেষে এল সেই ঐতিহাসিক দিন— ১১ই নভেম্বর ১৯০২। কলকাতার অস্থায়ী স্টুডিয়োতে রেকর্ডিংয়ের বন্দোবস্ত করে হয়েছিল সেই শিল্পীর যার গান শুনে গেসবার্গ মুগ্ধ হয়েছিলেন। এই রেকর্ডিংয়ের জন্য গওহরজান ৩০০০/- টাকা চেয়েছিলেন এবং জিটিএল কোম্পানি সেটা দিতে রাজি হয়েছিল। স্টুডিয়োতে গওহরজান ছিলেন আত্মবিশ্বাসী। হঠাৎ গওহরজানের চোখ পড়ে দেওয়ালে আটকানো একটা চোঙার দিকে। তিনি জিজ্ঞেস করে জানতে পারেন যে ওই চোঙার মধ্যে মুখ রেখে যথাসম্ভব জোরে গান গাইতে হবে। গাইবার সময় মাথা নাড়ানো বা কোনো অঙ্গসঞ্চালন করা যাবে না। স্থির হয়ে বসে গান গাইতে হবে এবং তিন মিনিটেরও কম সময়ে গান শেষ করতে হবে। সারেঙ্গী, তবলা ও হারমোনিয়াম শিল্পীরা প্রস্তুত হলে গওহরজান গান শুরু করলেন তার সেই গান ‘ডগর না জানি যাবে ক্যায়সে’। তীক্ষ্ণ, চর্চিত সুরেলা কণ্ঠের নিপুণ নিবেদন এবং গানের শেষে সেই অমোঘ উচ্চারণ— ‘মাই নেম ইস গওহরজান’, এক নিমেষেই ইতিহাস সৃষ্টি হল। ধনী ব্যক্তিদের জলসা বা বাগানবাড়ি থেকে এই গান পৌঁছে গেল সাধারণ মানুষের মধ্যে এবং একটা তারা যেন পুনর্জন্ম লাভ করল।

(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)

প্রথম পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব

তৃতীয় পর্ব

চতুর্থ পর্ব

পঞ্চম পর্ব

Facebook Comments

পছন্দের বই