লেখক নয় , লেখাই মূলধন

দীপ শেখর চক্রবর্তীর গদ্য

মাথার ভেতর এই গানটা বেজেই চলেছে

যেন একটা গান থামছে না। থামাচ্ছি না আমি। বেজেই চলেছে পরপর আবার আবার বেজে চলেছে আর প্রতিটি শব্দ বেজে বেজে একটা অসুস্থতা হয়ে গেছে। সামনের দিকে তাকাই ডান দিকে একটা মন্দির, ঠিক তার সামনে রুগ্ন মেয়েটি চোখের ইশারা করে। আশ্চর্য চোখ তার, মনে হয় আমার বুকের মধ্যে একটা হুঁক লাগিয়ে এমন টান মারলো মনে হল এখুনি গিয়ে খামচে ধরি ওর ঘাড়। অথচ সে অধিকার আমি হারিয়েছি কারণ ওর জন্য একটা গান লিখতে গিয়ে বারবার আমি হেরে গিয়েছি। তাই এখন কোথায় হাঁটছি, বোলপুর, মধ্যমগ্রাম, কলকাতা তার কিচ্ছু তফাত নেই। সেই ছোটোবেলায় মৃত্যু এসে মিশে গেছে রক্তে, একটা বিরাট শকুনের পালক দিয়ে বলেছে লেখো অতল, ডুবে যাওয়ার কথা লেখো, পোড়ানোর কথা লেখো, সমুদ্রের পাড়ের বেলুনওয়ালার শাদাকালো বেলুনগুলোর কথা লেখো। লেখো লেখো সাদা নয় শাদা শাদা শাদা।
গভীর রাত করে দেখা করতে এসেছিল সেই লোহাভাঙা টিনভাঙাওয়ালা। গুলিবৃষ্টি হয়েছে, দু-জনেই প্রাণে বেঁচে নক্ষত্র আকাশের মাঝে বাজিয়েছি হাড়ের বাঁশি। আর উন্মত্ত আমাকে ফেলে সে সব ভাঙা নিয়ে সটকেছে। এই এক অন্যন্য উপায় লুণ্ঠিত হওয়ার। সকাল থেকেই বারবার গালে ব্লেড ঘষেও আমি বুঝতে পারিনি এই গানটা কেন মাথার মধ্যে বেজে চলেছে। একটা ফাঁকা ঘর আর অসংখ্য চাদর শাদা কালো, একটাই আলো আসার মতো জানালা। সেখানে যে মেয়েটি নিজের স্তনের মধ্যে আমাকে টেনে নিতে চাইছে তার উন্মুক্ত গায়ের মধ্যে উল্কি। উল্কির মধ্যে লেখা আছে মানুষের স্বার্থপরতার ইতিহাস, আছে বিশ্বাসঘাতকতা। আমি গানটা আর শুনব না বলে মাথা চেপে রাখি ওর স্তনের ভেতরে আর ওমনি একটা ফাঁকা স্টেশনের মাঝে চলে যাই। কোনো ট্রেন আসে না শুধু মাঝে মাঝে লাইন দিয়ে দৌড়ে চলে যায় একেকজন পরিচিত আর দাঁড়ায় না। আমার হাতে একটা পিস্তল, তার অফুরন্ত গুলি, আমার তাক করতে ইচ্ছে হয়, আর একটা গুলি গিয়ে বুক ফুঁড়ে দিলেই সে হাহা শব্দ করে জেগে ওঠে আর সূর্য হয়ে পাখিদের ধরে ধরে খায়।
সেই পাখিপোড়া গন্ধে প্রতিদিন ঘুম ভাঙে আমার। দেখি আমার বিছানার এক কোণে অবিন্যস্ত পড়ে আছে আমার যৌবন। আমার রমণের ইচ্ছে একটা পোকার মতো মরে পড়ে আছে পাশে। সারাদিন শুধু মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির জন্য একটা গান লিখতে গিয়ে কাটিয়ে ফেলি। মনে হয় এ-গানটা লিখতে পারলেই আমরা রাতের রাজা হয়ে যাব। আমরা মন্ত্র পড়ে নামিয়ে আনব সমস্ত অরণ্যের আত্মাকে আর বন্য পশুরা খুঁজে খুঁজে খেয়ে ফেলবে সবকটা লোককে যারা ওই মেয়েটির বুকে চিমটি কাটে, অশ্লীল কথা বলে হাসে।
আমার ভেতরে এই গানটা বেজেই চলেছে, মাথার মধ্যে অবিরত, আর আমি বারবার পকেট হাতড়াই। জিন্সের তলা গুটিয়ে নিই বারবার, ভেতরে আমার শরীরের আগুন আমি বারবার অনুভব করি।
আগুন পুড়িয়ে মারে না। অসম্ভব বেঁচে থাকি। একটা মন্দিরের সামনে সেই পুরোনো মেয়েটির শুকিয়ে যাওয়া বুক শীতস্র রোদের মতো আমার গায়ে এসে পড়ে। টাকাগুলো পকেট থেকে বের করে এনে কেটে কেটে আমি জোনাকি বানাই। আমি জলের কাছে বসে নিজের ছায়াটাকে মাছ করে ফেলি। এ-সব ফুরিয়ে যায় তবু আমার এই হাঁটা ফুরোয় না। বারুদ ফুরোচ্ছে না। মেয়েদের ভালোবাসার ইচ্ছে ফুরোচ্ছে না। তবু আমি গোপন করে যাই কারণ মাথার গানটি আমি কীভাবে থামাবো সেটা বুঝতে পারি না। আমার চোখ বুজে শুধু দাউদাউ বাড়ির আগুন, আমার চোখ বুজে খালি ঝগড়া ভয়, আমার চোখ বুজে খালি ইশকুলের যৌনাঙ্গে হাতের ছাপ। আমার সারা শরীর জুড়ে শুধু দাবার ছক। গুটিগুলো সাজিয়ে কারা চলে গেছে উঠে।
কালিমন্দিরে বাজে মানুষের লোভের কাসর। খাও খাও খাও প্রভু। আমি রাস্তায় পড়ে যাই একটি গাড়ি ধাক্কা মেরেছে। লোকজন জড়ো হয়। আমি উঠে দেখি মেয়েটি তাকিয়ে আছে আশ্চর্য হাসির চোখে। চোখের ভেতর একটা পিঁপড়ে এসে এমন কামড় দিল গান থেমে গেল। আমি জনতাকে সরিয়ে উঠে বসি গাড়িতে।
ধোঁয়ায় ভরে গেছে গাড়ির ভেতর দু-জনের নাম ধাম গোত্র জানি না। শুধু গাড়ি আরও আরও জোরে ছুটে চলে। জন্মস্থান পেরিয়ে, ইশকুল পেরিয়ে, মাঠ পেরিয়ে, শহর পেরিয়ে একটা অন্ধকারে গিয়ে থামে। কেউ নেই আশে পাশে। আমরা পাশাপাশি চুপ করে থাকি। সিগারেট পড়ে গেছে ব্রেকের ঠিক পাশে আর একচোখা পশুর মতো জ্বলছে। আমি বারবার মাথা ঠুকি গাড়ির সামনেতে, সেই যে-গানটা বন্ধ হয়ে গেল, কিছুতেই আর চালাতে পারি না, চলছে না, চলছে না। খারাপ হয়ে গেছে নাকি। মেয়েটি মাথার মধ্যে একটা আঙুলের পিস্তল ধরে বলে যা জানো সব বলে দাও, কোথায় লুকিয়ে রেখেছ?
আমি ওর বুকে হাত রাখি, ও আটকায়। চোখে চোখে বলি নিশ্চিন্ত হও, আমার কাম ফুরিয়েছে, এই দেখো যা খুঁজছ তুমি, এই যে পরশপাথর। তা দেখে সে নিশ্চিন্ত হয় আর আমার মাথা থেকে আঙুলের পিস্তল সরায়। আমি গাড়ি থেকে আস্তে আস্তে বেড়িয়ে আসি। বেড়িয়ে আসি। এসেছি, এসেছি অনেকটা বনের মধ্যে। পোশাক নেই গায়ে নিজেকে অন্ধকারে কালো চিতাবাঘ মনে হয়। আমি চারপায়ে ছুটি ছুটি আরও আরও বনে।
দূর থেকে একটা বিস্ফোরণের শব্দ আমাকে আশ্বস্ত করে, অন্ধকারে চোখ জ্বলে ওঠে।

Facebook Comments

পছন্দের বই