লেখক নয় , লেখাই মূলধন

পার্থজিৎ চন্দের ধারাবাহিক গদ্য: সোনালি, হরিণ-শস্য

দশম পর্ব 

শরতে, উপেন্দ্রকিশোর ও সুকুমার

পৃথিবীতে সব থেকে বেশি যে-কয়েকটি চিত্রকল্প আর উপমা ব্যবহৃত হয়েছে তার মধ্যে একটি অতি-অবশ্যই নির্জনে বনের মধ্যে সবার অগোচরে ফুলের ঝরে যাওয়া। একটি ফুলের ফুটে ওঠা আর ঝরে যাওয়া— বিষয়টির মধ্যেই এক বিয়োগাত্মক বিষয় ঝিম মেরে বসে থাকে। এই বিয়োগাত্মক নাটিকাটিকে আরও বেশি বিয়োগাত্মক করে তোলে সবার অলক্ষ্যে ঘটনাটির ঘটে যাওয়া। যে-সৌন্দর্যের সৃষ্টিই হয়েছে সবার অগোচরে, সে-সৌন্দর্য আনন্দসঞ্জাত হয়েও বেদনার কোলে ঢলে পড়ে। সৌন্দর্যের প্রকাশ দ্রষ্টা-নিরপেক্ষ; কিন্তু তার পরিণতি দ্রষ্টা-সাপেক্ষ। যেখানে দ্রষ্টা নেই সেখানে সৌন্দর্য যেন মাথা খুঁড়ে মরে একজন দ্রষ্টার জন্য।

শোনা কথা, উটের চোখে তিনটি অক্ষিপুট থাকে; বালিঝড় থেকে দৃষ্টিকে রক্ষার করবার জন্য। নির্জনে, সবার অগোচরে ফুলের ঝরে যাওয়া যেন দু-টি অক্ষিপুট দিয়ে আচ্ছাদিত এক পৃথিবী। শুধু ফোটা আর ঝরে যাওয়া— ভূমিকাবিহীন এই খেলায় ফুলের হাহাকার এক মহা-এরিনায় দাঁড়িয়ে প্রতিটি ব্যক্তি-মানুষের হাহাকার। বিশ্বপিতার ধারণাটি এখান থেকেই গড়ে ওঠে, বিশ্বপিতার কোলে আশ্রয় পাবার ইচ্ছা আসলে ব্যক্তির নিজের ভূমিকাটিকে নির্দিষ্ট করবার প্রক্রিয়া।

এক শরৎ-দুপুরে এই ধারণাটিকে বয়ে নিয়ে চলা একটি পঙতির সামনে নতজানু হয়ে বসেছিলাম, ‘ফুটায়ে যদি ফুলের মত তুলিছ এত যতনে নাথ।’ এই পঙতির চলন রবীন্দ্রনাথের গানের কথা মনে পড়িয়ে দেবেই, কিন্তু এ লেখা রবীন্দ্রনাথের নয়। এ-লেখা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর, কবিতার নাম ‘প্রার্থনা’। এই একটি কবিতার জন্য, অন্তত এই একটি কবিতার জন্যই উপেন্দ্রকিশোর আমার কাছে টুনটুনির বই, গল্পমালা, বিবিধ প্রসঙ্গ, পুরাণের গল্প ইত্যাদি পেরিয়ে এক অসামান্য কবিও হয়ে উঠলেন।

কবিতাটির দিকে চোখ ফেরালে দেখতে পাওয়া যায়, বনের নির্জনে ফুলের ফুটে ওঠা আর ঝরে পড়া… এই ‘বিফলতা’ সত্ত্বেও ‘পিতার’ করুণাধারা তার জন্য নির্ধারিত হয়ে আছে। বিশ্বপিতার মহা-লীলার প্রকাশ সে-ফুলের মধ্যেও। কিন্তু বারো-লাইনের এই কবিতাটির একাদশতম লাইনটি একজন পাঠককে হাজারবার তাড়িয়ে ফিরবেই, ‘ফুটায়ে যদি ফুলের মত তুলিছ এত যতনে নাথ।’

এই লাইনটিতে ‘ফুটায়ে’ এবং ‘ফুলের’ শব্দ-দু-টির মধ্যে লুকিয়ে থাকা ‘ফ’ ধ্বনিটি প্রথমে খুব গোপনে পাঠকের মনে এক নির্জনতার সৌন্দর্য আনয়ন করছে। এর পরের পাঁচটি শব্দের মধ্যে প্রত্যেকটিতেই ‘ত’ এবং ‘থ’ ধ্বনিটি রয়ে গেছে। যেন খুব সংগোপনে কেউ ফুল ফুটিয়ে, তারপর তাকে খুব যত্ন করে তুলে রাখছেন। পেলবতার এই আবহে আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারে এক অত্যুচ্চ দার্শনিক উল্লম্ফন।

‘তাঁর’ প্রেমে শাখায় শাখায় ফুল ধরেছে, ‘তাঁর’ প্রেমই রসের সঞ্চার… এই ধরনের চিত্রকল্প ও উপমা সুপ্রচুর। কিন্তু আমাদের ম্যাক্রোকোজম দুলে ওঠে, এক মহা-টেম্পেস্টের মধ্যে ছারখার হয়ে যেতে থাকে কালপুরুষ যখন উপেন্দ্রকিশোর লেখেন, ‘ফুটায়ে যদি ফুলের মত তুলিছ এত যতনে নাথ।’

ফুলের মতো ফুটিয়ে তোলার মধ্যে সে-উল্লম্ফন নেই, যা আছে যত্ন করে তুলে রাখবার মধ্যে। ম্যাক্রোকোজমের নাভির কাছে স্থিত শক্তি এখানে মায়াবি, স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে এখানে স্থাপিত হয়েছে এক ‘মায়া’-র সম্পর্ক।

অদৃশ্য বুনিপের মতো সে-মহাকাল সবকিছুকে তছনছ করতে করতে মহাপ্রলয়ের মধ্যে দিয়ে সংহার মুর্তি ধরে অগ্রসর হচ্ছে না। তার ফোটানো ফুলগুলিকে সে পরম মমতায় একে একে তুলেও রাখছে। কবিতাটি যেন আবর্তিত হয়ে চলেছে একটি মাত্র শব্দের উপর ভর দিয়ে— ‘যতনে’।

কবিতাটির শেষ লাইনটিও মারাত্মক, শরৎ-দুপুরে কত কতভাবে যে দেখতে ইচ্ছা করে এটিকে! উপেন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘ফুলেরি মত চরণতলে রাখিয়ো মোরে দিবস রাত’।

বিশ্বপিতার পায়ের কাছে ফুলের মতো রয়ে যাবার ইচ্ছার মধ্যে হয়তো ‘নতুনত্ব’ কিছু নেই। কিন্তু বারবার যে ঘুরেফিরে আসে এর আগের পঙতিটি, ‘ফুটায়ে যদি ফুলের মত তুলিছ এত যতনে নাথ’!

স্রষ্টা না কি নিজের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে কিছুটা বিরক্ত হয়েই এই মায়ার খেলা সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু এখানে তো তিনি নিজের সৃষ্টি করা খেলার প্রতি নিজেই মুগ্ধ হয়ে রয়েছেন, একে একে যত্ন করে ফুলগুলি তুলছেন। ‘চরণতলে’ স্থান পাওয়া তাঁর ইচ্ছাধীন, এটি মেনে নেবার পরেও আরেকটি বিষয় মাথা তুলে দাঁড়াতে চায়।

তিনি অনিবার্যভাবেই কিছু ফুলকে তাঁর চরণতলে স্থান দেন… সেই মুহূর্তে তিনি হয়ে ওঠেন নার্সিসিস্ট।

নার্সিসিস্ট বিশ্বপিতার এই রূপ এক শরত-দুপুরে উপেন্দ্রকিশোরের কবিতার মধ্য দিয়ে ফুটে উঠে আমাকে লুণ্ঠন করে চলে যায়।

একবার লুণ্ঠিত হয়ে গেলে উপেন্দ্রকিশোর আর সুকুমারের ‘সহজ’ জগৎ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া অসম্ভব। আর, সে-জগৎ থেকে কে-ই-বা পরিত্রাণ চায়! ‘শিশুর জাগরণ’ কবিতায় উপেন্দ্রকিশোর লিখছেন—

— কবিতা থেকে উপাদানের ভার শুষে নিয়ে তাকে নিরাভরণ করে তুলতে সমর্থ হলে কবিতা হয়তো এমনই হয়, বারবার পড়েও শরত-দুপুরে কিছুতেই আবিষ্কার করা যায় না, এই কবিতার টান ঠিক কোথায় লুকিয়ে রয়েছে।

উপেন্দ্রকিশোরের রচিত কিছু গানও আছে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ।’ ব্রহ্মসংগীতে প্রায় সব ক্ষেত্রেই বিশ্বপিতাকে সম্বোধণ করা হয়েছে, উপেন্দ্রকিশোরের অন্তত একটি ব্রহ্মসংগীত এর উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। মিশ্র কাওয়ালি রাগে উপেন্দ্রকিশোর রচনা করেছিলেন—

“এস গো কাঙ্গাল জন আজি তব নিমন্ত্রণ, জগতের জননীর কাছে।
কার অতি দীন হীন বিরস বদন?
(ওগো) ধুলায় ধূসর মলিন বসন?
দুখী কে বা আছ, শুন গো বারতা,
ডেকেছেন তোমারে জগতের মাতা।”

— উপেন্দ্রকিশোর জগৎপিতার পরিবর্তে জগৎমাতার নিমন্ত্রণ শুনতে পেলেন।

সুকুমার রায়ের ‘অন্ধ মেয়ে’ কবিতাটি তুলনায় বেশি পঠিত, মনে আছে খুব ছোটোবেলায় এক আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় এক আত্মীয় আমাকে জোর করে প্রতিযোগী করে তুলেছিলেন। জীবনে সেই প্রথম আর সেই শেষ বার— মাঝপথে কবিতার লাইন ভুলে গিয়ে শাপে বরই হয়েছিল— কবিতা নিয়ে আর কোনো প্রতিযোগিতায় সামিল হইনি। সুকুমারের ‘অন্ধ মেয়ে’ কবিতাটি ছিল প্রতিযোগিতায়। আজ এই শরৎ-দুপুরে দু-ফোঁটা চোখের জল ঝরে পড়ল সুকুমার রচনাবলীর পাতায়। বহুদিন আগেই জেনেছিলাম, কবিতার সঙ্গে সহবার করেন বলে যাঁরা দাবি করেন তাঁদের বেশিরভাগই আসলে কবিতার অন্দরমহলে প্রবেশ করবার চেষ্টাটুকু করেন না। আজ আরও একবার নিশ্চিত হলাম, কারণ, ‘অন্ধ মেয়ে’ কবিতাটির ভিতর বিন্দুমাত্র প্রবেশ করলে কোনও দিক্ষিত মানুষ এক চার-পাঁচ বছরের শিশুকে এই কবিতাটি ‘আবৃত্তি’ করতে দিতেন না।

গভীর কালো মেঘে রামধনু ফুটে উঠেছে, সবুজ ঘাসে আলোর ঝিলমিল। রঙিন প্রজাপতির ওড়াউড়ি চলেছে চারদিকে। এই দৃশ্যটির বুকে চূড়ান্ত অসংগতির মতো জেগে রয়েছে এক অন্ধ মেয়ে। সে কিছুই দেখছে না—

“অন্ধ মেয়ে দেখছে না তা— নাইবা যদি দেখে—
শীতল মিঠা বাদল হাওয়া যায় যে তারে ডেকে।
শুনছে সে যে পাখির ডাকে হরষে কোলাকুলি
মিষ্টি ঘাসের গন্ধে তারও প্রাণ গিয়েছে ভুলি।

দুঃখ সুখের ছন্দে ভরা জগৎ তারও আছে,
তারও আঁধার জগৎখানি মধুর তারি কাছে।।”

— জগৎজোড়া যে-রূপের খেলা, যে-বিস্ময়… সেই একই বিস্ময় রয়ে গেছে অন্ধ-মেয়ের মনেও। একটি জগতের নির্মাণ সে নিজেই করে নেয়, মনে মনে। সেখানে সে স্বাধীন। শরতের ভেজা-দুপুরে শুধুই মনে হচ্ছে, মেয়েটি তো অন্ধ বটেই… সে কি কালোও? কবিতাটির কোথাও উল্লেখ নেই যে, অন্ধ-মেয়েটি কালো। কিন্তু যতবার কবিতাটির প্রথম লাইনের কাছে তাকিয়ে দেখছি, ‘গভীর কালো মেঘের পরে রঙিন ধনু বাঁকা’, ততবার মেঘের কালো এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে মেয়েটির উপর। কালো থেকে আরও বেশি কালো হয়ে উঠছে সে প্রতিবার। ক্রমশ তাকে প্রত্যাখ্যানের দৃষ্টি ছুড়ে দিচ্ছে পৃথিবী।

সুকুমারের অতি-প্রচলিত অসামান্য সব ‘নন-সেন্স রাইম’ (!) থেকে দূরে কয়েকটি লেখার দিকে চলে গেছিলাম সেদিন। দেখতে পাচ্ছিলাম তুরীয় আনন্দের আলোকিত জগতে জেগে উঠছে এক কবির প্রাণ, তিনি লিখছেন—

“যে আনন্দ তারায় তারায়,
যে আনন্দ সকল সুখে,
যে আনন্দ রক্তধারায়,
সে আনন্দ মধুর হয়ে
তোমার প্রাণে পড়ুক ঝরি,
সে আনন্দ আলোর মত
থাকুক তব জীবন ভরি”

— সুকুমারের গানের জগৎ রবীন্দ্রনাথের খুব কাছের, নিভৃত প্রাণের দেবতার। সুকুমার একটি গানে লিখছেন—

“সে প্রেমের তরঙ্গেতে যায় ভেসে যায় ব্যাকুল বেগে।
না জানি কোন প্রেমিকের প্রেম জাগেরে এমন লীলায়!
নিখিলের আনন্দ-গান এই প্রেমেরই যুগল বন্দনায়।”

— যাত্রাপথের আনন্দ-গান নিখিলের আনন্দ-গানে ভরে আছে রবীন্দ্রবিশ্ব। উপেন্দ্রকিশোর আর সুকুমার তাঁদের সম্ভার নিয়ে যেন এই জগতের কাছাকাছিই ঘুরে বেড়ান।

শুধু এটা দেখেই অবাক লাগে, দু-টি রত্নদ্বীপকে পাশে ফেলে চরম উদাসীনতায় বিশ্বায়িত হয়ে চলেছে বাঙালির জগৎ। কেন যে উচ্চশিক্ষায় সুকুমার পঠিত হন না!

সব দেখে শুনে মনে হয়, সুকুমারের আশ্চর্য জগৎকে ধারণ করবার মতো মেধা ও মনন বাঙালির হয়তো এখনও তৈরিই হয়নি। একটি ভাষাকে বলের মতো লোফালুফি করতে করতে যে মানুষ হেঁটে যান তাঁকে ধারণ করা চিরকালই বেশ শ্রমসাধ্য।

সুকুমার চুপ করে বসে রয়েছেন দিগন্তের কাছে, হয়তো ভবিষ্যতের কোনো উন্নত ভাষা-কাঠামো আবিষ্কার করবে সুকুমারকে যথাযথভাবে। শুধু একটি বিষয়ের উল্লেখ করি?

এক ‘পুরন্দর ভাট’-এর ‘কবিতা’-র জন্য বাংলাকে অপেক্ষা করতে হল এতদিন। আর সেই কবেই ‘ছড়া’-র আদলে সুকুমার লিখে রেখেছিলেন—

“ঢপ ঢপ ঢাক ঢোল ভপ ভপ বাঁশি
ঝনঝন করতাল ঠন ঠন কাঁসি।
ধুমধাম বাপ বাপ ভয়ে ভ্যাবাচ্যাকা
বাবুদের ছেলেটার দাঁত গেছে দেখা।।”

— সহৃদয় পাঠক, দয়া করে মনে রাখা ভালো, সুকুমার ইহ-জীবনের মায়া ত্যাগ করেছিলেন সেই ১৯২৩-এর সেপ্টেম্বরে।

প্রথম পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব

তৃতীয় পর্ব

চতুর্থ পর্ব

ষষ্ঠ পর্ব

Facebook Comments

পছন্দের বই