লেখক নয় , লেখাই মূলধন

পার্থজিৎ চন্দের ধারাবাহিক গদ্য: সোনালি, হরিণ-শস্য

দ্বাদশ পর্ব 

আকাশপ্রদীপ ও ডিকটেটরের হাতে স্বপ্ন

হেমন্ত আসছে, বহুদূর থেকে মাঠঘাট পেরিয়ে সে আসছে। বিকেলের রোদ্দুর আর হাওয়ার ভেতর ফুঁপিয়ে উঠছে কার যেন উদাসীন কান্না, দীর্ঘ নিঃশ্বাস। হেমন্তসন্ধ্যা বিচ্ছেদের, সে কাপ থেকে প্লেটকে আলাদা করে দেবে… নৌকা থেকে নদীকে।

এই বিচ্ছেদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে হেমন্তের সব থেকে বড়ো আকর্ষণ, আমার কাছে, তার আকাশপ্রদীপ।

শহরের ঝলমলে আলোয় তাকে তেমন খুঁজে পাওয়া যায় না, কিন্তু মফস্‌সল পেরিয়ে একটু গ্রামের দিকে প্রবেশ করলে প্রথমে হালকা কুয়াশার চাদর। একটা-দুটো জনপদ, ছোটো ছোটো ঘরবাড়ি আর তাদের মাথার উপর জ্বলে থাকা নীলাভ অথবা পীতবর্ণ আলো। হেমন্তের রাত্রে আকাশের দিকে মুখ তুলে চেয়ে আছে মানুষের জ্বেলে রাখা প্রদীপ। রণ-রক্ত-সফলতার অমর পৃথিবীর উলটো দিকে অতি-শান্ত জেগে আছে মানুষের আকাশপ্রদীপ।

যারা ছেড়ে চলে গেছে তাদের সঙ্গে আর দেখাও হবে না, যারা সঙ্গে আছে তারাও ছেড়ে চলে যাবে একদিন। কোটি কোটি বস্তুপিণ্ড গ্যালাক্সি ধূমকেতু গ্রহ আর উপগ্রহের মাঝখানে দেখা হয়েছিল কয়েকজন মানুষের সঙ্গে। কেউ পূর্বপুরুষ, কেউ-বা দূর সম্পর্কের আত্মীয়, কেউ-বা সেই কোন রবি-ছবিমামার বন্ধু… জীবনে একবারমাত্র দেখা হয়েছিল। তারপর শোনা যায় তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে যান, কেউ আর কোনোদিন খোঁজ পায়নি তাঁর।

দেখা হবে না, আর দেখা হবে না… এই হাহাকার পাগলের মতো ঘুরে ঘুরে মুখে রক্ত তুলে ছটফট করে হেমন্তের মাঠে। তারপর শান্ত হয়ে যায়, ছোটো ছোটো বাড়ির মাথার উপর আকাশপ্রদীপ হয়ে জ্বলতে শুরু করে।

আমাদের এই ছোট্ট পৃথিবীর এক ছোটো গ্রাম থেকে, হে ছেড়ে চলে যাওয়া মানুষজন, তোমাদের উদ্দেশে জ্বেলে রাখলাম এই নীলাভ প্রদীপ। যতদূরেই থাকো, যে-ছায়াপথ পেরিয়েই চলা যাও না কেন, একদিন নিশ্চয় চিনতে পারবে এই আলো। আমিও তোমার ছোটোভাইয়ের ছেলে, আমিও তোমার ধাই-মার বিয়ে ভেঙে যাওয়া বড়ো-মেয়ে… হেমন্তের দিনে আকাশের দিকে মুখ তুলে তোমাকেই খোঁজার চেষ্টা করছি আমরা।

মানুষ তার স্বপ্ন-সমান, মানুষ আসলে তাই যতদূর তার স্বপ্ন। মানুষের সভ্যতার ইতিহাসে এই স্বপ্নের ভূমিকা অসীম। এবং ব্যক্তিমানুষের ক্ষেত্রেও এই স্বপ্ন খুব গুরুত্বপূর্ণ।

ভাবতে আশ্চর্য লাগে, ঘুমন্ত মানুষের কোনো ইতিহাস নেই। মানে যে-মুহূর্তে একজন মানুষ ঘুমের অতলে প্রবেশ করল, সেই মুহূর্তে সে ডরম্যান্ট ফোর্স। একমাত্র জেগে থাকা মানুষই ডমিন্যান্ট ফোর্স হিসাবে ইতিহাস লিখবার অধিকারী। একজন মানুষ জীবনের তিন থেকে চারভাগের একভাগ সময় ঘুমের জগতে থাকে। ফলে মানবসভ্যতার ইতিহাস আসলে দুই-তৃতীয়াংশ অথবা তিন-চতুর্থাংশ সময়ের ইতিহাস। বাকি অংশ মানুষের স্বপ্নের অথবা দুঃস্বপ্নের, তার ইতিহাস তেমন ধরা নেই মানুষের হাতে।

কিন্তু স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্নের ভেতর যে লুকিয়ে থাকে ইতিহাসের অমোঘ উপাদান তার প্রমাণ পেয়েছিলাম একটি বইয়ের সন্ধান পেয়ে। বইটির নাম ‘Dreams during the Third Reich’ (Das Dritte Reich des Traumes) সম্পাদনা করেছিলেন শার্লট বেরার্ড। ট্রমা, এক তাড়া করে ফেরা দুঃস্বপ্ন যে কীভাবে ইতিহাসকে ধারণ করে রাখে তার নিদর্শন শার্লটের সম্পাদিত এই গ্রন্থ। এই বইটির প্রসঙ্গে একটু পরে আসা যাবে।

আমার এক আত্মীয়ের কথা জানি, যাকে বারবার চিকিৎসা করিয়েও একটি ট্রমা থেকে কিছুতেই বের করে আনা যায়নি। তিনি মাঝেমাঝে রাত্রে ঘুমের ঘোরে উঠে বসতেন, ধাতস্থ হতে বেশ কিছুটা সময় নিতেন। তার স্বপ্নটি ছিল অদ্ভুত, তিনি স্বপ্নে দেখতেন একটা ট্রেন শুধু মৃতদেহ নামিয়ে দিয়ে চলেছে স্টেশন থেকে স্টেশনে। শুধু স্বপ্নেই নয়, এই আত্মীয় বাস্তবেও ভিড়-ভরতি রেলস্টেশনে কিছুতেই থাকতে পারতেন না। এমনও হয়েছে, প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে নিয়ে বেরিয়ে আসতে হয়েছে স্টেশন থেকে। নিছক ক্লসট্রোফিবিয়ার থেকে তা ছিল অনেক গভীর এক সমস্যা।

আমরা সবাই জানতামই, দেশভাগের সময়, খুব ছোটো বয়সে এই মানুষটিকে ট্রেনে চেপে দাঙ্গার পর দাঙ্গা পেরিয়ে মাটির মায়া ছেড়ে শিয়ালদহ স্টেশনে নামতে হয়। জীবন থেমে থাকে না, সে ঠিক নিজের নিয়মে চলতে থাকে। এই মানুষটিও সব খুইয়ে বেঁচেই ছিলেন, ধীরে ধীরে থিতু হন একটু। কিন্তু সেই যে ট্রেনে চেপে এক জীবন থেকে আরকটি জীবনের দিকে ভেসে যাওয়া— সেই স্মৃতি তাকে তাড়া করত স্বপ্নে।

শার্লট বেরার্ড-এর সম্পাদিত গ্রন্থটি এমনই বেশ কিছু স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্নের এক সংকলন, বেশিরভাগ স্বপ্নই ‘দেখা হত’ হিটলারের সেই সময়গুলিতে। স্বপ্নগুলির মধ্যে বেশ কিছু ‘মজার স্বপ্ন’ও আছে। এ বই আসলে এই মহাদেশের সন্ধান, যেখানে লুকিয়ে থাকে মানুষের দুঃস্বপ্নগুলি, এই দুঃস্বপ্নগুলিকে ডি-কোড করতে করতে পাওয়া যায় এক ডিকটেটরের পাঞ্জা ও সেই পাঞ্জার নীচে ক্রমাগত দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া মানুষের স্বপ্ন।

ঠিক যেমন ১৯৩৪ সালে একটি স্বপ্ন দেখতেন একজন চিকিৎসক, ‘রাত্রি নটা প্রায়, আমার রোগী দেখা শেষ, সোফার উপর একটি বই ওলটাচ্ছিলাম… হঠাৎ আমার ঘরের দেয়ালগুলি… আর তারপর আমার গোটা ঘরটাই এক-সময়ে উধাও হয়ে গেল। তীব্র এক ভয়ে আমি চারদিকে তাকালাম, যতদূর দৃষ্টি যায় কোনো ঘরেরই দেয়াল বলে কোনো জিনিস অবশিষ্ট নেই। ঠিক সেই সময়ে আমি মাইকে একটি ঘোষণা শুনলাম, ‘এতদ্বারা এ-মাসের ১৭ তারিখে এক আদেশবলে সমস্ত দেয়ালের ধ্বংস নিশ্চিত করা হল…’

বাড়ির মধ্যে ঘর, মানুষের ব্যক্তিগত পরিসরের সমনাম। ডিকটেটর এভাবেই ব্যক্তিমানুষের পরিসরটিকে গুঁড়িয়ে দেয়। তারপর সে সমষ্টির পরিসরকে আক্রমণ করে… সবাইকে এনে দাঁড় করায় এক সারিতে। ব্যক্তিস্বাধীনতা হারিয়ে এক খাঁ খাঁ করা মরুভূমিতে মানুষ দেখে ক্রমশ এগিয়ে আসছে স্টিমরোলার।

ডিকটেটর ঠিক কতটা আক্রমণ করে, সে ঠিক কতটা ভয় চারিয়ে দিতে পারে আমাদের স্নায়ুতে স্নায়ুতে তার চমৎকার নিদর্শন পাওয়া যায় এক মহিলার স্বপ্নের মধ্যে।

মহিলা বলছেন, ‘ঘুমের মধ্যে আমি প্রায়ই একটা স্বপ্ন দেখি… দেখি আমি কথা বলছিলাম রাশিয়ান ভাষায়। মজার কথা হল, আমি একবিন্দুও রাশিয়ান জানি না। আসলে আমি চাইছিলাম, আমার কথা যেন কেউ না বুঝতে পারে। এমনকী আমার কথা যেন আমিও না বুঝতে পারি। কারণ, সরকারবিরোধী কোনো কথা বলে ফেললে নির্ঘাত মৃত্যু…।’

রাইনহার্ট কোসেলেক তাঁর ‘Futures Past’ গ্রন্থে এই স্বপ্নটির সঙ্গে ফুয়েরারের কর্মপদ্ধতির এক আশ্চর্য সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন, ‘A striking counterpart to this comes to us from the “Führer.” Hitler at one time distinguished three levels of secrecy: that which he entrusted only to his immediate circle, that which he kept to himself, and that which he himself did not dare to completely think through.’

— পৃথিবীর সব ডিকটেটর সব ফুয়েরারই এক ধারা মেনে চলেন, নিজের ছায়াকেও বিশ্বাস করে না তারা। এমন কিছু ‘চিন্তা’ যা সে নিজেও চিন্তা করতে ভয় পায়, অথবা চায় না। যে-ফুয়েরার এক মহিলার স্বপ্নে ঢুকে গিয়ে তাকে অচেনা ভাষায় কথা বলতে প্ররোচনা দেয় সেই ফুয়েরার ঠিক একইভাবে নিজের ভেতর চলাফেরা করা সরিসৃপটির দিকে তাকাতে চান না।

এবার যে-স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্নটির কাছে এসে দাঁড়াব সেটিও হাড়হিম করা, একটি কারখানা ও তার এক শ্রমিকের স্বপ্ন, ‘আমাদের কারখানায় গোয়েবলস এসেছিল। কারখানার সব সৈন্যকে দু-টি সারিতে মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়েছিল। মাঝখানে আমি, আমি নাৎসি-কায়দায় আমার হাতটা তুলে স্যালুট করবার চেষ্টা করছিলাম। একটু একটু করে পুরো হাতটা তুলতে প্রায় আধ ঘণ্টা সময় লেগেছিল। গোয়েবলসের চোখেমুখে আনন্দ বা বিরক্তি— কিছুই নেই। সে শুধু তাকিয়ে ছিল আমার হাত তোলার প্রক্রিয়াটির দিকে… এটি যেন তার কাছে একটা খেলা। আমি হাতটা পুরো তুলতে গোয়েবলস শুধু পাঁচটা শব্দ উচ্চারণ করেছিল, ‘আমি তোমার স্যালুট চাই না…।’ কথাগুলো বলে মুখ ঘুরিয়ে দরজার দিকে চলে গিয়েছিল গোয়েবলস। আমি একটা পাথরের মতো আমার সহকর্মীদের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলাম। দেখতে পাচ্ছিলাম পা টেনে টেনে বেরিয়ে যাচ্ছে গোয়েবলস… ঘুম না-ভাঙা পর্যন্ত সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি…।’

হিটলার ও গোয়েবলসরা মানুষের ঘুমের মধ্যে ঢুকে পড়ে তাকে অভিবাদন করতে বাধ্য করায়।

বেরার্ড যে-স্বপ্নগুলি সংকলিত করতে পেরেছিলেন সেখানে আরেকটি অদ্ভুত বিষয় লক্ষ করা যায়— মানুষকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে তাদের নিত্য-ব্যবহার্য বেশ কিছু জিনিস। কাপ-ডিস থেকে শুরু করে ফুলের টব… ছেড়ে চলে যাচ্ছে মানুষকে। স্বপ্ন ও মনস্তত্ত্ব নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন তাঁরা বলতে পারবেন আরও ভালোভাবে, আমার মনে হয় স্বৈরাচারী শাসক এমনই… সে মানুষকে তার ছায়া থেকে আলাদা করে আরও আরও একলা ও নিঃসঙ্গ করে দেয়।

আমিও তো একজন স্বপ্ন-আক্রান্ত মানুষ, কত কত স্বপ্ন যে ভেসে চলে গেছে! এক সময়ে বেশ চমৎকার একটা স্বপ্ন দেখতাম, পাহাড়ি অঞ্চল। পাহাড়ের গা বেয়ে চলে গেছে রাস্তা, সারাদিনে শুধু মিলিটারি ট্রাক চলে যায়। বারবার স্বপ্নটা দেখেছি, মিলিটারি ট্রাক ছাড়া আর কোনো যান দেখিনি। ঝক্‌ঝক্‌ করছে রোদ্দুর, নীচে… অনেকটা নীচে কয়েকঘর মানুষের বাস। পোড়া-মাটির রঙে রং করা গীর্জার মাথা, সামনে গাউন পরে একজন দাঁড়িয়ে। ওই মানুষটিই আমি… কোনো শব্দ নেই, কোনো মানুষের ছায়া নেই… শুধু এক শান্ত গীর্জার সামনে অতি-শান্ত এক সকালে দাঁড়িয়ে রয়েছি আমি।

আশ্চর্যের কথা, একবার সিকিমের এক পাহাড়িপথে গাড়ি থেমে গেছে… বেশ কিছুটা সময় লাগবে টায়ার পালটাতে… পাহাড়ি রাস্তার একটা বাঁক পার হবার পরই ভেসে উঠেছিল সেই গীর্জা-সমেত গ্রাম… আগে কোনোদিন দেখিনি। কিন্তু এ-গ্রাম আমার খুব চেনা, স্বপ্নে চেনা।

গত কয়েক বছর প্রায় ঘুরেফিরে একটা স্বপ্ন দেখা দিয়ে যায়। কালো পাথর বিছানো রাস্তা, দু-দিকে ছোটো ছোটো জানালার ঘর। ধুলো উড়ছে, সরাইখানার সামনে দাঁড়ালে চিড়িয়াখানার বাঘের খাঁচার গন্ধ নাকে এসে ঝাপটা মারে। একদল লোক চলেছে… ফুর্তি আর উল্লাসে ভরে আছে রাস্তাঘাট।

এরপর একটা জাম্পকাট ধরনের ব্যাপার ঘটে… ক্রুশবিদ্ধ এক মানুষের মাথা শেষবারের জন্য ঢলে পড়ে ডান দিকে। ব্যস, এখানেই সে-স্বপ্নের শেষ।

স্বপ্নে কি রং চেনা যায়? অথবা, গন্ধ?

তাহলে যে বাঘের খাঁচার গন্ধ নাকে এসে লাগে তা কি আসলে মানুষের মর্ষকামের উৎসব?

মানুষ তার স্বপ্নের সমান, মানুষ তার দুঃস্বপ্নেরও সমান।

অথবা এ-সব কিছুই নয়; মানুষ আসলে সব স্বপ্ন আর দুঃস্বপ্ন পেরিয়ে হেমন্তসন্ধ্যায় জ্বলে থাকা থাকা এক আকাশপ্রদীপ ছাড়া আর কিছুই নয়।

প্রথম পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব

তৃতীয় পর্ব

চতুর্থ পর্ব

ষষ্ঠ পর্ব

দশম পর্ব
একাদশ পর্ব

Facebook Comments

পছন্দের বই