লেখক নয় , লেখাই মূলধন

প্রলয় মুখার্জীর গদ্য

ভ্রমণ আমার মেয়ের নাম

মেয়ের দেখা

আজ প্রথম ও কাঁঠাল দেখেছে। ধূসর বাদামি গুঁড়ির গায়ে প্রেত পূর্ণিমার মতো শিশু কাঁঠাল। গুঁড়ির গায়ে গায়ে কণ্টক আরতি। কচি কচি ধুমকেতু নিকষ সন্ধ্যার মতো গুঁড়ির গায়ে লেগে রয়েছে। অজস্র অজস্র। এই আমার তিনমাস পনেরো দিনের মেয়ে। কানে টগরের দুল। সে দেখে ফেলেছে শিশু কাঁঠালের গায়ে দু একটি টুনটুনি লন্ঠন। ও কী করে বোঝাবে প্রথম পাহাড় না। সমুদ্র না। পাইনের অরণ্য না। রাজস্থানের দূর্গ না। সে দেখেছে নির্জন উঠানের ধারে বৃদ্ধ ম্যামথের মতো কী এক জন্তু। গা থেকে রৌদ্রের বল্কল খসে পড়ছে। একই আমাদের সংকট মুহুর্ত। কাল বেঁচে যাব কিনা জানি না। তবু সারাদিন হাত নেড়ে পা নেড়ে কিছুতেই বোঝাতে পারছে না, কী রূপ কাঁঠাল সে দেখেছে। সে তো বুঝিয়ে ছাড়বে। ঘুম নাই। স্থির নাই। নিরন্তর হাত নাড়ে। দন্তহীন অসীম ও লাল মাড়ি। সম্ভবত তারই নীচে তুষারের জীবাশ্মের মতো কুটুম কুটুম দাঁত চাপা পড়ে। চাপা কত যে শব্দ! কত বাবা বাবা ডাক। সে সব কথা এখন থাক। এখন ও কী করে বোঝাবে কাঁঠাল, নাকি বাবার মতো দেখতে নয়। কী এক দানবের বুকে ফুটেছিল কন্টকময় জোছনার সেতু।

মেয়ের খাদ্য

টেবিলে সঙ্গীর গ্লোবটা নেই। নেই জানালার কাঠ। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্প সমগ্র নেই। আলমারির একখানা পাল্লা কে খেল? কন্যা। তিনমাসের কন্যা এখন যা পায়, খায়। মুখে সটান খাটের পায়া। ওর তালিকায় আমার বুকের চুল, সঙ্গীর ক্লিপ, আলো, থালা, বাটি, বই, খাতা। আমার নিমকাঠের একটি চেয়ার, চেয়ারের একপ্রান্ত ঘুণপোকা অপর প্রান্ত কন্যার মুখে। খেয়েই চলেছে। শব্দ হয় মচমচ মচরমচর। পেনের ঢাকনা, ধূপদানী, জামার বোতাম মেয়ের কিছুতেই অরুচি নাই। হাতের নাগালে শিল, নোড়া পেলেও মুখের ভিতর চালান দেয়। জগতের সকল পদার্থ ওর নিকট সুস্বাদু। মচমচে। গতকাল ডাক্তারবাবু ফোন করে বললেন, আপনি কি প্রলয়? বললাম হ্যাঁ। কন্যা কি সাড়ে তিনমাসের? কইলাম হ। বলল, পেপার ওয়েট খেয়ে ফেলেছে। সাবধানে থাকবেন, এখন ওদের বয়স সাড়ে তিনমাস। ধূমকেতু কামড়ানোর চেষ্টা করবে। কিছুতেই আটকাতে পারবেন না। বয়স তিনমাস তাই সাবধানে থাকি। মেয়ের কাছ থেকে দূরে থাকেন তারাপদ রায়। সন্দীপন সমগ্র দূরেই থাকেন। আমার পেয়ারা গাছ তার কুঁড়িগুলি বুকে লুকিয়ে রাখে। ডালিম চারা লাল ফুলগুলি মাটির নীচে, দোয়েল পাখিটি পাছে খপ করে ধরেই মুখে পুরে দেয়, পাছে দক্ষিনের হাওয়া ধরে ফেলে, ভয়ে কেউ আসে না আমার উঠানে। কী জানি সে দু তিনটি তারা ধরে মুখে চালান করতেও পারে। পারে না? মেয়ে আকাশের দিকে হাত বাড়ালেই মেঘের আড়ালে চন্দ্রমা। কাঁপে আর বলে, তিনমাসের কোনো শিশুকন্যাকে পূর্ণিমার রাতে জাগিয়ে রেখো না। বুকের নিকটে রেখো। অন্তরেই রেখো।

মেয়ের কাজ

ভ্রমণ ব্যস্ত। সে ছোটো প্রাণী। উপুড় দিলে সোজা হতে পারে না। ওর হৃৎপিন্ডের বয়স কত? ফুসফুসের? কিডনির? যকৃতের? সে নিজ নিজ অঙ্গ নিয়ে মহাব্যস্ত। কেহ কারো কথা শোনে না। হৃৎপিন্ড লিভারের কাছে চলে আসে গোধূলির প্রাক্কালে। গুজব করে। ফুসফুস পেটের কাছে। গল্প করে। ও সামলাতে পারে না। দাবড়ি দেয়। হায়! ডানহাত বামহাতের নির্দেশ মানে না। নিজের মুখ নিজেই আঁচড়ে নেয়। দিবারাত্র তার একটি যুদ্ধ। দুটি পায়ের সাথে দুটি হাত। লাল মাড়ির সাথে দাঁতের এমন যুদ্ধ কস্মিনকালে কোথাও কি সংঘটিত হয়েছে? মায়ের বুক ছাড়া এমন যুদ্ধ কোথায় হবে?

আমি সারাদিন দেখি। শুনি ওর মাথার ভিতর কাজ চলছে। বৃহৎ গাড়ি কারখানার মতো ওর মস্তিষ্ক। শুনি জলপাই ফুলের রেণুর সাথে ফুল ঝরা শব্দের ওয়েল্ডিং। ও! কী আলো! ওর চারমাসের নিউরনগুলো নিখাদ শিশু। কেউ কারোর সাথে নেই। সকলেই পরাগ। পুঞ্জীভূত নীল ধূম্রকণা মাথার ভিতর যেন প্রজাপতির বাষ্প।

তবু ‘সময়’ নামে এক বৃদ্ধ ইলেক্ট্রিশিয়ান, উচ্চতা এক ইঞ্চি। ততধিক ক্ষুদ্র স্ক্রু ড্রাইভার নিয়ে ঘুড়ে বেড়ায়। ওটুকু কক্ষ। ওটুকু লঘু মস্তিষ্ক। শব্দের সূক্ষ্ণ সূক্ষ্ণ তার গুলো দৃশ্যের সাথে জোড়া লাগাবে। অসংখ্য হাসির নিউরনগুলি বাইরের পদার্থ, তার স্পর্শ, সুখের সাথে জোড়া লাগাবে এই তার ইচ্ছে। কিন্তু বিকট শব্দে ও মাথা ঝাঁকানোর ফলে নিউরনগুচ্ছ, নার্ভের জটিল কণা হিম কুয়াশার মতো মাথার খুলির গায়ে ঘুরতে থাকে। পাক খায় ধূসর সাপের ফণা। ফলে ও পাকা বেল দেখলেও হাসিতে ফেটে পড়ে। ক্লান্ত ইলেক্ট্রিশিয়ান ওর কানের ফুটো বেয়ে ঝরে পড়ে শুকনো মাটিতে। তখনও মাথার ভিতর এক শিশু ডাক্তার প্রেসক্রিপশন লেখে। বাবুই পাখির ধ্বনি। পাতার সেলাই। হাওয়ার শরীরে জলের গান লেখে। কে শুনবে বৃদ্ধ ডাক্তারের কথা? পাকা বেল দেখলেই তো সে শব্দ করে কেবল। প্রবল মাথা ঝাঁকায়।

Facebook Comments

পছন্দের বই