লেখক নয় , লেখাই মূলধন

প্রীতম বসাকের গদ্য

কবির খণ্ড জীবন


এইখানে ব’সো। দুঃখকে কিছুটা দূর থেকে দেখা ভালো। যেমন পাহাড়ের মাথায় জমে থাকা মেঘ দেখতে তুমি পাহাড়ে ওঠোনি কোনোদিন। ওই দেখো ব্রহ্মাণ্ড ঝুলে আছে। ধূলি ধূসরিত সংসার। আর তার মাঝে একটা পাতকুয়ো। নিটোল জল। দরদ দিয়ে টানলে পিপাসার গান শুনতে পাওয়া যায়। সারাদিনের শব্দবাজির পর ওই নিটোলেই হাত পা ধুয়ে পিঁড়ি পেতে বসেছে কবিবর। ওই দেখো একটা হাত। সরু শাখা। পাখির পালকের মতো মৃদু ঠোঁট কাঁপছে। ভাত শুকিয়ে যাচ্ছে। পিঁপড়েরা আসা শুরু করেছে। কবি লজ্জিত হয়ে ভাবছে কিছুই তো রোজগার হয়নি। তবুও এমন ব্যঞ্জন কোথা থেকে এল। এমন দুঃখ এল কার ঘর থেকে। অথচ তাকে দূর থেকে দেখার কথা ছিল! যেমন তরমুজ পড়ে থাকে নদীর থেকে কিছুটা দূরত্ব রচনা করে। এই দূরত্বের কথাই বলতে চেয়েছিলাম আমি। কেন-না আমরা অনেক কথা বলে নিয়েছি। অনেক পাখির ডাক কেড়ে নিয়ে নিপাট করেছি বিছানা। এত আলো মেখেছি যে বাচ্চাগুলোর চোখ জ্বলছে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে গরমে। একটু চুপ করে থাকতে আমি তাই হঠাৎ স্কুলের দোকানপাট চুকিয়ে পালিয়ে আসি দুপুরের কেন্দ্রস্থলে। বলি এ জন্মে অনেক দিয়েছ। চমৎকার সব মানুষের উজ্জ্বল সব হাসি। কিন্তু আমি আর নিতে পারছি না এত মনোরম কোলাহল। এবার:

“দু’হাতে মানুষের অত্যাশ্চর্য মাখার পর
কিছু নিভৃতি রাখব খাতায়

স্পেসের পাশে স্থাপন করব মহার্ঘ্য চুপ

শস্যের অঢেল রাখা আছে
সেদ্ধ হচ্ছে স্তনের প্রভাত

পোশাকে খানিক সন্ন্যাস থাকা ভালো
বৃক্ষের দ্রাবিড়
মাটির হৃদয়ে ঘুমিয়ে আছে জলের মূকফল
আশ্চর্য ভেঙো না
স্কুল ফেরতের গায়ে তুমি নীরবতা টেনে দিও”

এরপর দিগন্তের দিকে কাঁদতে কাঁদতে চলে যায় অন্ধ শালিখ। এরপর নদীগুলো পাংচার হয়ে যায়। গল্পের ভেতর আলো নিভে আসে। আলোর ভেতর জ্বলে থাকে অন্ধকার।


পৃথিবীর পবিত্রতম দৃশ্য হল একা মানুষের কান্না। করুণতমও। কেউ দেখছে না বলেই তার গায়ে লেগে থাকে শিশুর অবিকল। সমুদ্রের মতো তা নীল এবং গভীর। কিন্তু ক-জন এমন কান্নার সাক্ষাৎ পায় জীবনে! রবীন্দ্রনাথ যেমন রাজার বাড়ি আবিষ্কার করতে পারেননি কোনোদিনও তেমনই আমিও খুঁজে পাইনি ‘একলা কান্নার ঘর’! যখন চোখ পেতে দিয়েছি তখনই দরজায় টোকা পড়েছে। দেখি ভেতরে আসতে চেয়ে অপেক্ষা করে আছে বাবার পাগলামো মায়ের হারিয়ে যাওয়া ডালকাটা আর বোনের মাথায় ভেঙে পড়া বজ্রবিদ্যুৎ। অথচ আমি জানি কাঁদতে পারলে কবিতা থেকে অতিরিক্ত অলংকার খুলে রাখা যেত। শব্দরা রঙিন বেলুনের মতো উড়ে বেড়াতো! আর নদীগর্ভ ভরে যেত মেঘে! কিন্তু এও তো সত্যি কাঁদতে পারাটাও একটা শিল্প। সেই নন্দিত তত্ত্ব সবার আয়ত্তে আসে না। এখন বুঝি:

“তেমন চোখের জল আমার ছিল না কোনোদিন
জলের ভিতরে চোখ ভেসে গিয়েছিল
জলের ভিতরে চোখ বহে গিয়েছিল,

জলের ভিতরে চোখ বাষ্প হয়ে শূন্যে উঠে মেঘ হয়েছিল

জল সব দ্যাখে, এই জেনে। আমার আগুন আছে, অন্ধের আগুন
ধ’রে আছে জিভ-কণ্ঠা-হাত-ঊর্ধ্ববুক।
আগে, তা নিভুক”

নিভলে হয়তো কাঁদতে পারব আমি। কিংবা বাবার পাগলামির ভিতর চুপ করে বসে থাকব। কেউ খুঁজে পাবে না কোনোদিন।


কোনো এক সময় ফকির হতেই হয় মানুষকে। সব অপমান উপুড় করে দিতে হয় দিনান্তে। যা কিছু অতিরিক্ত বেছে বেছে নিক্ষেপ করতে হয় শূন্যে। তারপর নিঃস্ব হয়ে নেমে যেতে হয় জলে। তখন অস্তমিত সূর্যের দিকে তাকিয়ে একটা সরল হাসি বিনিময় করা ছাড়া কিছুই করার থাকে না। তারও পরে হেঁটে যেতে যেতে জলের ছাপ রেখে যাওয়া! কেউ যদি তখন ডাকে? যদি যথার্থ সন্ন্যাসী হতে পারো পাহাড়ের দিকে চলে যাওয়া যায় অবিচল। আর কবি হলে নিজের হাতে কিছু রান্নার আয়োজন করা চলে। সামান্য খড়কুটো জ্বেলে সত্য দিয়ে মিথ্যা দিয়ে কবির ব্যঞ্জন তৈরি হয়। এর বেশি কিছু নয়। কে না জানে যার জ্ঞান বাড়ে, তার কষ্ট বাড়ে। কবি তাই সামান্য হয়ে থাকতে চায়। মূর্খ হয়ে। সে ভয় পায় নিজের মুখোমুখি হতে। সামাজিক হতে। তাই তাকে শিল্পের ভান করে ঢুকে পড়তে হয় মুখোশে। এই তার মুক্তি। এই তার অভিশাপ। কবি বুদ্ধ হতে চায় না। কবি হতে চায় মিথ্যেবাদী। ঠগ। এবং খুনি। কিন্তু এইসবই ওই ফকিরের মতো উপার্জন করে নিতে হয়। যে-নারী ঝুঁকে পড়ে তাকে জল দিয়েছিল পাতকুয়া থেকে তার দিকে সে তাকায় কামরাঙা বেদনা নিয়ে। কেন-না তাকে মনে মনে ধর্ষণ করে সে। আর যোনি থেকে রক্ত বের হওয়ার পর পরম যত্নে সেলাই করে দেয় তার ব্যথা। ফুঁ দেয়। আর ওই ক্ষত থেকেই একদিন কবিতা জেগে ওঠে। তখন ধর্ষক মরে গিয়ে জন্ম হয় বাল্মিকীর। মা নিষাদের।


কবি কৃষকের বন্ধু না শত্রু এ নিয়ে কোনো গবেষণা চোখে পড়েনি আমাদের। তবে এটুকু জানি হাজার হাজার চাষি হেঁটেছিল তলস্তয়ের শবযাত্রায়। কোনো কবির মৃত্যুর পর একজন ভিক্ষু হেঁটেছে কিনা জানি না। যদিও এ থেকে প্রমাণিত হয় না কবি শ্রেণি সংগ্রামের উপযোগী কোনো অস্ত্র নন! অথচ কে না জানে মাঠকে মাঠ নিজের খাতায় জমা করেছি আমি। রংপেন্সিল দিয়ে কখনো হাল্কা সবুজ কখনো গাঢ় জীবন সংগ্রাম আবার কখনো গর্ভবতী রঙের ফসল ফলিয়েছি। বন্দুকের নল সকল ক্ষমতার উৎস কিংবা আমি আরব গেরিলাদের সমর্থন করি অথবা রূপমকে একটা চাকরি দিন— এই সব কথায় সরল বিশ্বাস করে বিড়ি ধরিয়েছি মাঝ দুপুরের রাখালের আগুনে। কৃষক-বধূর ওষ্ঠে সূর্য ওঠছে দেখে প্রণাম করেছি অবিশ্বাস্যকে। পৃথিবী পালটে যাবে ঘরে ঘরে ধানের দুধ ভেসে যাবে— এমন আশ্চর্য রূপকথা লিখেছি বারবার! তবু এ জন্ম আমাকে ধিক্কার ফিরিয়ে দিচ্ছে। যেদিন মাথায় শ্যাম্পু করলাম সেদিন থেকেই আমার কবচ কেড়ে নিয়ে গেল পাখিদের সর্দার। আমগাছের কাছে রেখেছিলাম আমার দুঃখগুলোকে তাও ফেরত দেওয়া হল না। আমার ধুলোমাটি ধুয়ে অভিশাপ দিল নবান্নের ভোর— আমি যেন আর ফিরে না আসি ছেলেবেলার নিকটে। সুতরাং আমি একধাক্কায় বড়ো হয়ে গেলাম। শূন্যতার মতো বড়ো। এখন:

“আছে পশুদের, পাখিদের হাড়; দু-একটি কীট ও পতঙ্গ
উঠে আসে দেওয়াল ও কুর্নিশের ধার ঘেঁষে, জীবাশ্মের
পাশাপাশি সজীব মানুষ, দর্শক; কয়েকটি বানর-কঙ্কাল
মেরুদণ্ড ঈষৎ হেলিয়ে সামনের দিকে যেন এগিয়ে চলেছে,
ওঁরা বরযাত্রী, সামাজিক; ঐ-দিকে বিশাল পক্ষীকুল, উড্ডীন
অস্থিগুলি গৃহবন্দী আরণ্যক পরিবেশে, হলঘরে, বাস্তব ও
ভ্রমাত্মক; আছে আংশিক রাতে তারা একে একে নেমে আসবে
কলকাতার মরুভূমি তাদের গন্তব্যস্থল, শহরের আকাশ-মাটিতে
ঐ ফসিল ও দেবতাদল নিঃশব্দ যাত্রায় আমাদের ডেকে থাকে;
আমরাও কেউ কেউ সাড়া দিয়ে থাকি”

হ্যাঁ আমরা কেউ কেউ ফসিল হয়ে যাওয়া কবি। আমরা কেউ কেউ গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার মিথ্যে দোকানদার। শহর আমাদের কোনো জাত রাখেনি। কৃষক রাখেনি!


এই গল্প রাত-বিরেতের। রাত কেন-না পৃথিবীর একটা পিঠ সূর্যের সামনে থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। এই গল্প সময় ও শূন্যকে দুমড়ে মুচড়ে দেওয়ার। কেন-না কবি এখন লিখতে বসেছেন। দূরে গীর্জায় ঘণ্টা পড়ল। আপনি শুনলেন। আমিও। পাখিরা ছটফট করে উঠল মাছেরা চলে গেল আরও অতলে। কেউ হয়তো বৃক্কের ভার কমাতে উঠেছিল। দেখল যন্ত্রে দুটো বেজে তিরিশ মিনিট। সে গিয়ে শুয়ে পড়ল এবং ডুবে গেল ঘুমে। বাঁশি বাজিয়ে চলে গেল নেপালি প্রহরী। আপনি লক্ষ করলেন কিনা বোঝা গেল না ওর হাত ঈষৎ কেঁপে উঠল একটা বাড়ির জানালার দিকে তাকিয়ে। আগের দিনও কেঁপেছিল। তারও আগের দিন। তারও আগের। আশ্চর্য সে হয়েছে কিছু। কিন্তু খুশি হয়েছে আরও। কেউ তার সাথেই জেগে আছে। ভেবে তার আহ্লাদ হল। নিজের একাকিত্ব সে মনে মনে ভাগ করে নিল জানালার সাথে। আর যিনি লিখতে বসেছেন তার দিকে ফুটলাইট ফেললে আর ক্যামেরা ক্লোজ করলে দেখতে পাবেন তিনি হাসছেন কাঁদছেন টেবিলে সজোরে মাই লর্ডের মতো মারছেন কখনো চুলের গহীনে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন আঙুলগুলোকে। ওই দেখুন জানলার বাইরে হাত বাড়িয়ে কয়েকটা তারাখসা ধরল সে। তারপর তাদের পকেটে ঢুকিয়ে দিল। পাশে ঘুমিয়ে থাকা শিশুটির হাসি তুলে নিয়ে এসে রাখল খাতায়। স্ত্রীর কপালে চাঁদের হাসি এঁকে দিল। একটু কাত হয়ে গেল যুবতী। না ওদিকে বেশিক্ষণ চোখ রাখা ঠিক হবে না। আমরা বরং কবির দিকে ফোকাস করি। দেখুন গাছগুলোকে ঘুম থেকে তোলার জন্য গান চালিয়ে দিল মোবাইলে। আর গান শুনতে শুনতে নিজেই ঘুমিয়ে পড়ল কখন! কিন্তু আপনি খেয়াল করলেন কিনা জানি না ঘুমের মধ্যে ওর গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল। আমি খুব সন্তর্পণে আঙুলে তুলে নিতেই স্বপ্নটা উড়ে গেল। সকালে স্কুলে যাওয়ার সময় দেখলাম একটা বাচ্চা টাটা দিচ্ছে আমাকে। আমার মতোই দেখতে অবিকল।

কবিতাঋণ: প্রীতম বসাক, পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল, উৎপলকুমার বসু

Facebook Comments

পছন্দের বই