লেখক নয় , লেখাই মূলধন

রাহুল হালদারের গদ্য

খেলা খেলা লেখা

আষাঢ়ে মেঘে এবার বৃষ্টির আনাগোনা বেশ প্রবল। দিন দুয়েক হল দুপুরবেলা কোথা থেকে কালো মেঘ চারিদিক অন্ধকারে ঢেকে দিচ্ছে। এরপর হঠাৎ করে গুরু গুরু গর্জনে মুষলধারে বর্ষণ। জানালা দিয়ে বৃষ্টির ধারা দেখতে ভালো লাগে।গাছপালা, মাঠের ঘাসের জেল্লা বাড়ে বৃষ্টিস্নাত হয়ে। জলের ধারা বেয়ে চলে উঁচু থেকে নীচু জায়গায়। বৃষ্টি থামে। এতক্ষণে মানুষের, প্রকৃতির মধ্যে বারিধারা চলাকালে যে চঞ্চলতা দেখা দিচ্ছিল মুহূর্তে সব ধীর স্থির হয়ে যায়।বিরাজ করে এক আশ্চর্য নীরবতা।

দুপুরের নিস্তব্ধতা এরকম পরিবেশে মনকে উদাস করে। করোনাকালে ঘরবন্দী অবস্থান মনে পড়ে ঘটে যাওয়া জীবনের সুমধুর স্মৃতিগুলি। আজ কতদিন হল সন্ধ্যেবেলায় বাড়ির বাইরে স্বাধীনভাবে বেরোতে পারি না।ঘরবন্দি থেকে থেকে মনটা ছটফট করে ‘ডাকঘর’-এর অমলের মতন।

দেখতে দেখতে বসন্ত, গ্রীষ্ম কেটে গিয়ে যথা সময়ে বর্ষা হাজির হয়েছে। এই তো গত বছরের বর্ষাকালের মতন সন্ধ্যা আড্ডায় এত বছর ধরে আমাদের হাজার রকমের আলোচনার, তর্ক, হাসিঠাট্টার মধ্যে একটি বড় অংশ জুড়ে থাকত ময়দানের কলকাতা লিগের ফুটবল নিয়ে। তিন প্রধান-সহ কলকাতা প্রিমিয়ার লিগের নামকরা ক্লাবের মরসুমের দলবদলের খবর, কোচ বদল, কোন দলের কোথায় আবাসিক শিবির হল কিংবা প্রস্তুতি ম্যাচে কে ক-টা গোল করল এই সব নিয়ে তুমুল হৈ হট্ট গোল।এখন স্মার্টফোন সকলের থাকলেও রাতের খেলার খবর এক্রট্রা টাইম শোনা ছিল মাস্ট কেন-না সেটা না শুনলে পরের দিনের ফুটবলের তর্ক উঠলে যে পিছিয়ে যেতে হবে। বেশ কিছু বছর ধরে বড়ো ক্লাবের খেলাগুলি কল্যাণী স্টেডিয়ামে হওয়ায় খেলা দেখতে যাওয়ার পরিকল্পনা হত কেন-না মাঠে বসে নিজের প্রিয় ক্লাবের খেলা দেখা যে কতটা আনন্দ দেয় সেই অনুভব মাঠে গেলেই বোঝা যায়। এই একটি ক্ষেত্রেই দু-দলে বন্ধুরা ভাগ হতাম।

ফুটবলের প্রতি অনুরাগ বাঙালি মাত্রেই প্রায় সকলেরই আছে। তাই বলে কি ক্রিকেট দেখি না আলোচনার, তর্কের তুফান ওঠে না ক্রিকেট খেলা নিয়ে? উঠত ভীষণভাবে উঠত। যখন শচীন পুজোর পর সৌরভ কিছুটা শেহবাগ, যুবরাজ, জাহির, হরভজন পুজোর কাল শেষ হলো তারপর থেকে সেই দুর্বার আর্কষণ ক্রিকেটে পাই না। হাল আমলে কোহলি আর গব্বরের (শিখর ধাওয়ান) টানে কিছুটা।
ভারতীয় ক্লাব ফুটবলে আমরা কিছুজন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সমার্থক আর অন্যের স্বাভাবিকভাবেই মোহনবাগানের, তাহলে কীভাবে জমবে মজা। দু-একজন যারা অন্যবার এই সময়ে কলকাতা লিগের ফুটবল মেনিয়াতে বেশি আগ্রহী নয় অথচ তারাও চির প্রতিপক্ষ দু-দলের আলোচনার সময় বসে ধোঁয়াদেয়, তাদের আমরা মহমেডান বা অন্য কোনো ক্লাবের সমার্থক করে দিতাম। খেলায় যেমন হার-জিৎ আছে তেমন পর পর যখন মোহনবাগান আর ইস্টবেঙ্গল হেরে গেলে মহমেডান যদি জিতে যেত তাহলে বড়ো ক্লাবের বাতিলের খাতায় রাখা সমর্থকদের চাটুনি হজম করতে হয়।

গতবছরও যখন লিগের খেলা নিজের টিমের থাকে না তখন চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর খেলা দেখতে বসতাম সেই টিমের হার দেখতে সেটা কেন হয় জানি না। প্রতিদ্বন্দ্বী হারলে তো কথাই নেই আর যদি শেষ মুহূর্তে জিতে যায় তাহলে সেই দুঃখ নিজের ক্লাবের ছোটো টিমের সঙ্গে হারের থেকে বেশি হয়। এ মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপারটি কিন্তু বড়ো দুই ক্লাবের সমর্থকেরই আছে সেটা অনেকেই প্রকাশ্যে মেনে নেয়।

এ বছর শুধুই শূন্যতা ময়দানের হৈ হুল্লার থেকে বঞ্চিত। মেসি রোনান্ড নেইমার গভীর রাতের হিরো হলেও আমাদের হৃদয়ের অন্তঃস্থলে রয়েছে আবেগের দুই ক্লাবের খেলোয়ারেরা।কবে কীভাবে যে খেলোয়ারেরা আমাদের হৃদয়ের হৃদমাঝারে নিজেদের খেলার দ্বারা প্রিয় ক্লাবকে জিতিয়ে আমাদের অনাবিল আনন্দ দেয় সেটা বোঝা যায় তখনই, যখনই নিজের নিজের প্রিয় ক্লাবের জয় পরাজয়ের সঙ্গে আমাদের পরাজয়ের বেদনা কিম্বা জয়ের সুখানুভূতির সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতিতে মনকে আন্দোলিত করে। আমাদের নিজের অজান্তে হাসি কাঁদি গোললল বলে উচ্ছ্বাসে মেতে উঠি।
লিগের বড়ো ম্যাচের আগের দিন হয় চরম উত্তেজনা। ক্লাবের পতাকা টাঙানো, দুপুরে খেলা হলে সকালে কে বাজার থেকে ইলিশ কিনবে আর কে চিংড়ি সেটা আলোচনা সঙ্গে মনে থাকত চাপা ভয় যদি ম্যাচ হেরে যায় তাহলে তো সেদিন সন্ধ্যেবেলায় আসা বন্ধ হবে। তারপর মুখে যতই জোরগলায় বলা হত ১-০,২-০-তে বা ২-১-এ আজ আমরা জিতব তবুও যেন আওয়াজের দৃঢ়তা ততটা থাকত না। এ-দোকান সে-দোকান থেকে আনন্দবাজার, বর্তমান, প্রতিদিন, আজকাল কাগজের খেলার পৃষ্ঠায় হামলে পড়ে বারবার চোখ বোলানো বিশেষজ্ঞরা কী লিখেছে, ধারে ভারে কে এগিয়ে কে পিছিয়ে। বিশেষজ্ঞদের মতন আমাদেরও প্রেডিকশন যে ভুল হয় সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। খেলার আগের দিনে দু-দলের সমর্থক বন্ধুরা একাধিক কাগজ একসঙ্গে পড়লেও বড়ো ম্যাচের পরের দিনে হেরে যাওয়া টিমের সদস্যের কাছে খবরের কাগজ হয় দুনিয়ার সবথেকে নিকৃষ্টতম বস্তু তাতে হাত দেওয়া তো দূর তাকাতেও কষ্ট লাগে।
তবে হার জিত যা-ই হত না কেন মনে মনে স্থির করে নিতাম ‘মুখ আছে যার হার নেই তার’। কেন-না রাতে ঠেকে না গেলে যে বারবার ফোনে ডাক আসবে। আর যেদিনেই যাই টিটকারি হজম করতে হবে।

এ বছর বর্ষার বৃষ্টিতে কাদামাখা ময়দানের ফুটবলের খবর তো বিশেষ নেই। সেই সঙ্গে এত বছরের জাতীয় লিগ থেকে পরে নাম বদলিয়ে আই লিগের লড়াইয়ের উত্তেজনার পারদ নেমে যাচ্ছে আমাদের। মোহনবাগানের তো আগেই ঠিক হয়ে গেছে তারা আই এস এল খেলছে।এদিকে শতবর্ষের ইস্টবেঙ্গল আই এস এল খেলবে এ কথাও শোনা যাচ্ছে। নতুন কিছু আপন করতে যে-দ্বিধা দ্বন্দ্ব, ছুঁতমার্গ থাকে সেটা আছে কিছুটা কিন্তু দেশের ফুটবলের ভালো যদি আই এস এলে হয় তাহলে দেশের থেকে তো বড়ো ক্লাব নয় তাই সমর্থক হিসাবে সেগুলিকে মেনে নিয়ে আবারও যে কবে ময়দানের ফুটবল আড্ডায় ফিরব, টিভির সামনে বসে যুবভারতীর আলোজ্জ্বল ক্রীড়াঙ্গনের দু-দলের ফুটবলের যুদ্ধ দেখব আর সেই যুদ্ধের বর্ণনা শুনব মানস, পল্লবের কমেণ্ট্রিতে।

দিন দিন চিংড়ি, ইলিশের দাম বাড়ছে। ইলিশ তো আসবে আসবে করে বেশি আসছে না। তবুও বলব এ বছরে চিংড়ি, ইলিশ দুই-ই মহার্ঘ হচ্ছে।

Facebook Comments

পছন্দের বই