লেখক নয় , লেখাই মূলধন

রুদ্রদীপ চন্দের গদ্য

ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায়

দিবানিদ্রার শেষে শ্মশান ডেকেছে তাকে। একঘুমে কত অনন্ত পার হয়ে গেছে। সকালের প্রাইমারি স্কুল, সবুজ পাতার দল তারপর… ফিরে আসা শস্যক্ষেত, খাল পাশে রেখে। একসময় নদী নেই বলে আপশোষ হতো তার। অবশ্য কত আপশোস সন্ধ্যের মতো ঝুলে আছে জীবনে। ওরা থাকে, যেভাবে স্বর্ণলতা। যেভাবে চাঁদ ঝুলে থাকে চন্দ্রাহতের জীবনে। যে দুপুরের কাজ নেই, বন্ধু নেই তার ঘুম থাকে। বিলাসিতা? হবে হয়তো। বিলাস বললেই বিকেলের সেই পাড়াতুতো দিদির বন্ধুর কথা মনে পড়ে। সেই দিদি, যার কাছে শিখেছিল সে লাভা উদগীরণ। নিথর অজগর প্রতিম সে ঘুমের কাছে পৌঁছনোর জন্য প্রাইমারি স্কুলকে পিছনে রেখে বাড়ি আসে। বাড়িতে মা থাকে, আর থাকে আর এক থালা দিয়ে ঢাকা ভাত রাশি; রাশি রাশি সজনে ফুল, ঝুরো ঝুরো স্বপ্নের মতো… মা ডাকের মধ্যে দিয়ে যেতে ইচ্ছে করে না তার। গল্পের চরিত্রের মতো মা তার নয়। বাড়ির ছায়াবৃন্দ খেয়াল রাখে মা ডাকের বিলাসিতা কিন্তু তার নেই। সে বাড়ি পৌঁছলে বকুল গাছের ছায়া আর একটু অন্ধকার হয়। পাশের আলো জিজ্ঞেস করে, ‘মনা এল?’, ফিসফিসিয়ে। বকুল গাছটার চারা মা কিনে এনেছিল রথের মেলা থেকে। অথচ গাছ পোঁতা মা নিজে গাছ হয়ে উঠতে পারেনি মনার জীবনে। ও নাম মনা অবশ্য আর শুনতে পায় না। মুখরা, বাবাকে নিয়ে আলাদা হয়ে যাওয়া মা এখন আর কথা বলে না। সে শুধু বছরের একদিন মায়ের মুখোমুখি হয়, চোখের দিকে তাকায় তার। তারপর নিষ্পলক স্ট্রোকে হাতের ন্যাকড়া দিয়ে মায়ের মুখের ওপরের যে কাচ আর তার ওপরে গঞ্জনার মতো ছড়িয়ে থাকা ধুলো মুছে দেয় অযত্ন এবং সযত্নর মাঝের কোনো এক ফাঁকা প্লার্টফর্মে দাঁড়িয়ে। সেইদিন মায়ের বিয়ের দিন।

প্রশ্ন কৌতুহলী দর্শক হয়ে বলে, ‘তাহলে কে ভাত ঢাকা দিয়ে রাখল?’ কে বিছানা ভাঁজ করে রাখে?… পাটপাট, টানটান। লাল মেঝে বলে, ‘হাওয়া হাওয়া’, আলো বলে, ‘হাওয়া’, ছায়াও অনুকরণময় জীবন নিয়ে তাই বলে। এ বাড়ি জুড়ে হাওয়ার ঘরকন্না। সামনের পিচের রাস্তা দিয়ে বড়ো গাড়ি চলে গেলেই শোনা যাবে সংসার, গন্ধ আসবে মেথি, জিরের। এইসব কে করে? হাওয়া। আলোগুচ্ছের মনা শুধু আসে, ভাত খায়, অযথা জল খায় মাঝেমধ্যে। তারপর ঘুম… তারপর বন্ধুদর্শন… সে ঘুম শেষে শ্মশান আসে তার কাছে। বিকেল আর সন্ধ্যের মাঝে এক লোক দাঁড়িয়ে আছে। অনিল দার মতো দেখতে তাকে। অনিল দা। অনিলদা এই পোড়াকপালে শ্মশানের ডোম। সে লোক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একখাতা কাগজ। অনিল দা, অশিক্ষিত ডোম লিটারেচর করে সে জানত না। অথচ অনিল দার মতো দেখতে লোকটা ওই একতাড়া কাগজের পাতা উলটে যাচ্ছে, চোখ বোলাচ্ছে, আবারও ওলটাচ্ছে। দু-পাশে এলোমেলো জগাই-মাধাই, ভাই দুই। ওরা পরে ডোম হবে। পরবর্তীতে যে সমস্ত মায়ার কবিতা অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেল তার গায়ে একসাথে আগুন জ্বালাবে ওরা। অবশ্য ওরা এখনও আগুন জ্বালায়। শ্মশান চত্বরে পড়ে থাকা, পাশের জীবন রেখাময় রাস্তায় পড়ে থাকা বিড়ির টুকরোর গায়ে আগুন ধিকিধিকি জ্বলে। জ্বলে যায় সম্পর্কের অনিত্য সূত্র। ‘ওঁ অগ্নয়ে স্বাহা’… মনার খাতার ওপর কে যেন লিখে রেখেছে। কে লিখেছে? শেষ বাস জিজ্ঞেস করে যায়। খাতা বলে, হাওয়া, লিখেছে আগুনের টানে। কবিতা বলে, হাওয়া না থাকলে আগুনের সার্থকতা কী? আগুন শরীর পোড়ায়, হাওয়া আগুনকে। এই খাতা আগুনের, এই খাতা কবিতারও… সেই খাতা অনিল দার হাতে।

ঘুমের মধ্যেই সে ঘুম থেকে উঠে বসে। ওর জীবনেও আছে দুই জগাই মাধাই। যাদের প্রেম নেই, পত্রিকা আছে। লিটল ম্যাগাজিন। তাদের কাছে সে ‘মাস্টার’। বসন্তের সূর্যাস্ত পাল্লা দেয় চিতার আগুনের সাথে। অনিল দার কাছে খাতা নেই আর। জ্বলতে জ্বলতে চিতাকাঠে কবিতা লিখছে ডোম অনিল। মাস্টার বসেছে মোরামের পথে। এই পথ শোকময়, এই পথে ফিরে যায় শ্মশান বন্ধুর দল। তার দু পাশে দুইজন। মাস্টার পড়ে একের পর এক হাওয়ার কবিতা। চিতা নিভতে নিভতে তলানিতে এসে ঠেকে শেষ শোকগ্রস্ততার রং, পশ্চিম আকাশে। আসন্ন প্রসবা ধানক্ষেত শুনে যাচ্ছে নিবিড় শব্দের টান। ছড়ের দক্ষতায় বাজছে কবিতাগুচ্ছ। শেষ পাতা পড়া হলে ছাই পড়ে থাকবে কিছু, উঠে আসবে তিনজলের দল। প্যান্টে লেগে থাকবে মোরামের গুঁড়ো। কাঠ কয়লার ‘স্মরণে অমুক’ লেখা দেওয়াল পিঠ রেখে বসে থাকবে অনিল দা। আর শ্রীময়ী সন্ধ্যায় কেউ হঠাৎ ডুকরে উঠবে, ‘মা, মাগো’ বলে। ঠিক তখনই দিবানিদ্রা শেষ তার হাওয়ার সংসারে।

Facebook Comments

পছন্দের বই