লেখক নয় , লেখাই মূলধন

শুভ্রা মুখার্জীর গদ্য

যৌথথা বা গোপন আঁতাত

একটি সহিংস প্রেমের দৃশ্যে ঢুকে প’ড়ে বোঝা যায় প্রেম ও ঘৃণার মধ্যে বস্তুত পার্থক্য নেই। দু-জনের গায়ের রঙের ওপর লালার সর আড় ভেঙে বসে অপেক্ষা করছে, তীব্রতা ফুরিয়ে গেলে আদিম নিয়মের মতো চেঁছেপুঁছে ফেলে দেবে। ক্রমশ হাইড্রেনপ্রীতি বাড়ে, কবিকে আদর্শ মনে হয়, প্রতিষ্ঠাকে বড়ো কোনো ভুল। এই যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে, সেখানেই বমি করে ভাসিয়ে দেব আলবাত দেব অথবা এখান থেকেই কয়েকশো পা উত্তরে হেঁটে গিয়ে ভীষণ কিছু একটা দেখে ফিরে আসব চুপচাপ। ফিরে আসাটি পছন্দসই কবির উপমা আর ছন্দের দোলায় টলটল করে উঠবে, জলকে জল বলতে শিখলাম না বলে যারা গালাগাল দিচ্ছেন তারাও মুহূর্তকাল নীরবতা পালন করে উঠে যাবেন ইজিপ্ট ভ্রমণে। আমার বালি ভালো লাগে, আপনার? আমার বালির মধ্যে সমুদ্রের তীরবর্তী বালি ভালো লাগে, আপনার? বালি ভিজে গেলে ভারি সমস্যা হয়, গোটা রাস্তা সেই ভেজা বালির রেশ টানতে কতকিছু আনোখা জিনিস পায়ে এসে লাগে, হোটেলে ঢোকার আগে ভালো করে পা ধুয়ে তারপর ঢুকতে হয় ঘরে নাহলেই কিচকচে বালি… তবুও বালির মধ্যে সমুদ্রের নোনাপানিতে ভিজে ওঠা বালি ভালো লাগে আমার, আপনার? আমার নিজস্ব পছন্দ বলতে রং, তা সে যে কোনো রকম রং, কোনো কিছু রঙিন হলেই আনন্দে লাফালাফি করি, রং আমার সহজাত পছন্দ, আপনার?

ক্রমশ পচনশীল একটি গল্পের মূলে পৌঁছে গেছি, আপনি উত্তর না দিয়ে এক-একটা পা এগিয়ে চলেছেন আর আমি প্রশ্ন উত্তর খেলতে খেলতে পিছু পিছু দৌড়ে চলেছি। আপনার পছন্দ বলতে আমি জানি স্বল্প পোশাকের ছবি, প্রিয় নারীদের অতুলনীয় বুক আর পাছার মাংস, কোমরের সুললিত ভাঁজ আর গাঢ় লিপস্টিক। আপনার পিঠের ওপর খোপ খোপ করে বসানো আছে রমনার মাথা, আলোকিকার বুক আর বিপাশার পাছা। আমি নিতান্তই আগ্রহী বলেই সরিয়ে দেখেছি, প্রশ্ন-উত্তর খেলার ফাঁকে ফাঁকে সরিয়ে দেখেছি বিপাশার পাছার আড়ালে আপনি সাজিয়ে রেখেছেন কয়েকটি আধোওয়া চায়ের পেয়ালা, হাঁড়ি-কড়াই ঠুনকো বাসনপত্র। রমনার মাথার পিছনে রাখা ছিল কালো আর লালে মেশানো এক জোড়া দস্তানা, গোলাপি শাড়ির কেটে নেওয়া অংশ আর ফারের টুপি। এরপর আমি হাত বাড়িয়ে ছিলাম, অতিরিক্ত আগ্রহ নিয়েই হাত বাড়িয়ে ছিলাম আলোকিকার বুক রাখা খোপের দিকে, আপনি ঘুরে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। পৃথিবীর দিকে মুখ করে আপনি দাঁড়িয়ে পড়েছেন, আমি আপনার পিছনে পড়ে থাকা আকাশ দেখার বাহানায় চোখ এড়িয়ে যাচ্ছি হঠাৎ আপনি বলে বসলেন, আমি জলকে জল বলতে পারি না।

আমি বহুকাল জলকে জল বলতে পারছি না। কীসের ওপর দিয়ে সব ভেসে ভেসে গেছে? আপনার প্রিয় নারীদের স্বল্প পোশাকের ছবি আর প্রজন্মের কাছাকাছি রাখা আয়ত ক্যানভাস কিসে ভেসে গেল? আমি শুধু তরল তরল দেখি, লাল দেখি, আবছা গোলাপি দেখি। হুইস্কির সাথে খণ্ড খণ্ড বরফের টুকরো দেখি, এ-সব আমার রক্তে গিয়ে আমার দৃষ্টির প্রবণতা সামান্য সামনে ঝুঁকিয়ে এনেছে। এখন আমি খুব সামনে থেকে একটি ক্রমশ পচনশীল গল্পকে দেখছি, সামান্য সামনে ঝুঁকে পড়া… গল্পেও পিঁপড়েরা বসত গড়েছে, আমি পিছিয়ে পড়ার আগে লাল তরলের কাছে জবানবন্দি দিয়ে যাচ্ছি, এমন হওয়ার কোনো কথা ছিল কি? আর একটি আস্তরণের পুরোটাই খেয়ে ফেলে কবির ইঁদুর লেজ নাড়াচ্ছে, বিদূষীর বেড়াল কান নাড়াচ্ছে, প্রেমিকারা রুমাল নাড়াচ্ছে, মাঝবয়সি এবং যুবকেরা লিঙ্গ নাড়াচ্ছে… দরজায় আওয়াজ, লাফিয়ে পড়ে দরজা খুলে দিচ্ছে আমার আহত আত্মা… জলকে জল বলতে শেখাতে শেখাতে আপনি আবার হাঁটা শুরু করলেন অনন্তের দিকে।
মাথার খুপরিগুলি তুলনামূলক ছোটো, তাতে কম প্রাঞ্জল ছোটোবেলা সাজানো রয়েছে। খুব সম্ভব এগুলি দিয়েই পারিবারিক ছবির অ্যালবামে ঢোকা যায়, সেখানে বেড়ালের ছবির পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে মৃদু রঙের প্রেমিকা, আলোজ্বলা টেবিলঘড়ি আর সারেঙ্গীবাদক একজন। একটি মুখ চৌকো করে কেটে নেওয়া, কেটে নেওয়ার সময় বোঝা যায় আপনার হাত কাঁপছিল, নইলে এত খারাপ করে কাটিং করার বান্দা আপনি নন। এই সারেঙ্গীবাদকের কাছে এসে আমি আমার প্রাক্তন অভ্যাস ভুলে জলকে জল বলতে শিখলাম। কারা হৈ হৈ শব্দ তুলে খুপরি থেকে খুপরি দৌড়ে বেড়াচ্ছে আর অদ্ভুত ধোঁয়ার মতো ব্যাপার ছড়িয়ে পড়ছে স্পষ্টতর দৃশ্যগুলিতে। এখন কবির কাছে ফিরি, তিনি একটি কচুরিপানার ফুল আমার হাতে দিয়ে বলেন এক লাফে কয়েকটি বছর পেরিয়ে যেতে। কয়েকটি বছর শুধুমাত্র একটা তার্কিক পরিসংখ্যান, কবি বোঝান, সেখানে বাস্তবে মানুষটি মোটা হয় অথবা রোগা, চুল ছোটো করে ছেঁটে ফেলে অথবা খানিকটা বড়ো রাখে। পরাবাস্তববাদী কবি আমাকে ক্রমাগত বোঝান এবং আরও কয়েকটি কচুরিপানার ফুল হাতে দিয়ে বলেন এক লাফে বছরগুলি পেরিয়ে যেতে। সাড়ে সাত হাজার বছর পেরিয়ে আসি, সংক্রমণ আকারে ছোটো এবং বর্ণনায় সংক্ষিপ্ত হয়।

মায়াবী তরলে ক্রমশ পচনশীল একটি গল্প চোবানো, লেবু নুন দিয়ে তারিয়ে তারিয়ে বসে শতাংশের হিসেব করছে একজন জেব্রার মত জামা পরা লোক, এগিয়ে এসে কবি বলে চিনতে অসুবিধা হয় না। তাঁর তখন চামড়ায় ঝুল পড়েছে, তবু মাথায় মেহেরজান। এখানে খুপরিগুলি তুলনামূলক চওড়া ও গভীর, আপনি শ্যাওলার ওপর বসে জিরিয়ে নিতে নিতে একটি মেহেফিলি সুর ভাঁজছেন। একটি গভীর খুপরিতে সঞ্চিত বাদামি তরল পান করে আমি খানাতল্লাশিতে লেগে পড়ি। আদিমতার হিংস্রতম অধ্যায়গুলি আমার ভালো লাগে, আপনার? গনধর্ষণকেই আমার একমাত্র টিমগেম হিসাবে ভালো লাগে, আপনার? শাস্তি দেওয়ার মাধ্যম হিসেবে শরীরে গরম শিক ফুটিয়ে দেওয়া ভালো লাগে, আপনার? চওড়া একটি খুপরিতে মোটামুটি আয়েশ করে বসা যায় দেখে আমি সেখানেই পুরোনো নথিপত্র খুলে বসি, বিকল্প হিসেবে আপনি যাকে বেছে নিয়েছেন তার বাঁ গালে একটি তিল, বুকের ওপর সাবুদানার মতো লালচে আঁচিল আর পাছায় পদ্মকাঁটা ফুটে উঠেছে, অধিকারহীন বিছানায় বসে কেউ একজন রহমানের গান শুনছে আর আপনি পার্শ্ববর্তীকে বোঝাচ্ছেন পাশের দুটি ঘরের বিছানা সম্পর্কে। হাওয়াতে মৃদু এসরাজ, শব্দ সংরক্ষণের সমস্ত তরল বা কঠিন প্রিজারভেটিভ ঢেলে কোনোক্রমে কণ্ঠস্বরকে ধরে রাখা গেছে। একজন মাটির জিনিস গড়ছে, গড়ছে এবং ভাঙছে আবারও গড়ছে, কাছে এগিয়ে গিয়ে সবিস্ময়ে কবিকে দেখি। তাঁর চুলে জটা, সর্বাঙ্গে মালিন্য, উকুন খুঁটে খেয়েছে তার কান আর ঠোঁট, শুধু চোখ দুটি তাঁর অসম্ভব তেজস্বী চোখ দুটি থেকে গেছে। কবি মাটির তাল তুলে আনেন, গড়েন, ভাঙেন আবার গড়েন, আমাকে দেখে সম্ভবত তাঁর খেয়ে যাওয়া ঠোঁটগুলি নড়ে ওঠে, কবি কিছু বলতে চান হঠাৎ একটি কচুরিপানার ফুল উড়ে এসে কবির সামনে পড়ে আর কবির বন্ধু সেই ভীষণ ঈগল পাখিটি কবিকে ছোঁ মেরে উড়ে যায়। আমিও ছুটতে থাকি, ছুটতে থাকি, ছুটে যেতে থাকি, টিলার মাথায় কবি ঢলে পড়েন, ঈগলের সাথে আরও কতগুলি শকুন নৈশভোজে যোগ দেয়, কবির হাত থেকে একটি কচুরিপানার ফুল ঝরে পড়ে…

লম্বা কার্পেটের ওপর দিয়ে হেঁটে চলেছি। রাস্তাটি অপরিচিত, আপনি আগে আগে নিশ্চিন্ত গাইডের মতো হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছেন, রাস্তার নুড়িগুলিতে সামান্য ধাক্কা খাচ্ছে আপনার জুতোর ফলা এবং আপনি হেঁটে চলেছেন। এখানে গাছের সংখ্যা নগন্য, ঘাস এবং জংলা লতাগুলিকে ঢেকে চওড়া কার্পেট বিছানো, নুড়িগুলি কার্পেটের ওপর সুদৃশ্য পাথরের মতো ছড়ানো রয়েছে। কিছুদূর হাঁটার পর বড়ো একটা জলার কাছে এসে আপনি বসে পড়লন, কবির মৃত্যুর পর আমি আর প্রশ্ন-উত্তর খেলি না, খুপরিগুলিতে সাহস করে ঢুকে দেখি না তাতে কি রয়েছে। একটা খুপরিতে হাত ঢুকিয়ে আপনি স্বয়ং বের করে আনলেন সোনার তবক মোড়ানো কিছু একটা। আপনার গম্ভীর নির্দেশে আমি কখন যেন খুলে ফেলেছি সোনার তবক, সেখানে পাত্রে পাত্রে তরল, তরলে ভেজানো রয়েছে একটি মুখ, বহুদিন ভিজে থাকার ফলে তাতে ফুটে বেরিয়েছে এক অদ্ভুত মদের প্রভাব আর লাবণ্য। তার চোখদুটিতে লেখা রয়েছে মায়া সভ্যতার রহস্য, তার ঠোঁটের ওপর খোদিত হয়েছে মোহ, কপালের ওপর সুখকর ঘামের আভাস। আমি আরও ঝুঁকে এসে মুখটিকে দেখি, কেমন উন্মাদ লাগে হাতে তুলে আচ্ছন্ন হতে হতে একটি শুকনো কচুরিপানার ফুল আপনার হাতে দিয়ে আরও বেশি করে সেই মায়া মুখে আবিষ্ট হই। রাত্রির নিস্তব্ধতা নিয়ে পাশাপাশি বসে থাকি, সেখানে জলের রঙ আরও গাঢ় হয়। ভোর হয়, সকাল দুপুর আর রাত্রি হয়… রাত্রি হয়। একটি পচনশীল সহিংস প্রেমের দৃশ্যে হাত টেনে নিয়ে যায় কেউ, ঢুকে পড়ি। কবির সাথে দেখা হয়/হয় না, পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার সময় দেখি গল্পের সমস্ত অরম্ভগুলি আমাকে কামের দৃষ্টিতে দেখে, আমাকে মায়ার দৃষ্টিতে দেখে, আমাকে ক্ষুধার্ত দৃষ্টিতে দেখে, আমাকে হিংসার দৃষ্টিতে দেখে, আমাকে করুণার দৃষ্টিতে দেখে… আমাকে সাধারণভাবে না দেখে চলে যায়। আমি, হ্যাঁ আমিই অনেকবার চরিত্রদের সাথে ভুল করে গল্পে ঢুকে পড়ি, অলৌকিক নদী এবং উপত্যকা পেরিয়ে আসার পর আপনি একটি নির্দিষ্ট খুপরিতে আমাকে বসত গড়ে দেন, সেখানে নিদর্শন হিসাবে বসে থাকতে থাকতে আমার ইন্দ্রিয়গুলি দেনামোহরে দাবী করে। জল এবং মাংস-মদ দাবি করে, পুরুষের এবং নারীর বুক-পিঠ-পাছা-লিঙ্গ দাবি করে। কামড়ে কামড়ে সুরক্ষিত খুপরি থেকে বেরিয়ে আসি, অসমতল কার্পেটের পর খটখটে মাটির ওপর দিয়ে ছুটতে ছুটতে একটি গোলাপি সমুদ্র ও আকাশের সামনে এসে দেখি কবি ও আপনি আড্ডা জুড়েছেন। দু-জনের মাঝখানে রমনার মাথা, আলোকিকার বুক, বিপাশার পাছা… আমার চামড়া ঝুলছে, আমার চোখের অংশ তার পাশে, বাদামি মাইয়ের বোঁটা, আমার নাক-ঠোঁট সমস্ত অস্বাভাবিক শরীর ও ইন্দ্রিয়… ছেঁড়া ছেঁড়া- ইতিহাস ও সংস্কৃতিসুলভ। বিখণ্ড অংশগুলি বিদ্রোহ করে ওঠে দু-জনের মাঝখানে প্রচণ্ড কলহ করে, পরস্পরকে চিরে চিরে খেতে থাকে। সেই নারকীয় তাণ্ডবের মাঝে কবি ও আপনি আড্ডা জমিয়েছেন, বাতাসে সারেঙ্গী-এসরাজ, মাঝে একটি কচুরিপানার ফুল…

Facebook Comments

পছন্দের বই