লেখক নয় , লেখাই মূলধন

সেলিম মণ্ডলের গদ্য

কৌতূহলের জানালায়: পাগলাখালি

পাগলাখালি আশ্রম

‘উঠল বাই তো কটক যাই’, ক-দিন আগে হঠাৎ এমনই বাই উঠেছিল আমাদের। বহুদিন ধরে পরিকল্পনা চলছিল, যাওয়া হয়ে ওঠেনি। কতটাই বা দূর? চাপড়া থেকে বড়োজোর ২৫ কিলোমিটার। মুশকিল হল, ডিরেক্ট যাওয়া যায় না। বাস, ম্যাজিক, টোটো সব ভেঙে ভেঙে যেতে হয়। এটা বেশ হ্যাপার। কথায় বলে ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর’, কোনো বিশ্বাস বা তর্কের খাতিরে নয়, স্রেফ কৌতূহলেই যাওয়া।
আমরা যখন পৌঁছালাম সূর্য ক্রমশ লাল আভা ছড়িয়ে বিদায় ঘোষণা করছে। পলদা তীরে পাল পাল গোরু নিয়ে শুধু রাখল বালকেরা, তারাও ব্যস্ত শেষ বিকেলের গল্পতে। থেমে গেছে পাখিদের কিচিরমিচির। চারিধার সবুজ মাঠ শূন্যের ভিতর আত্মীয়তা রক্ষা করছে। আর তার মাঝে বিরাট জায়গা নিয়ে একটি মন্দির। কেউ নেই, খালি এক পাগল। সে কেমন যেন সশব্যস্ত! তার সম্বলে থাকা এক তারা বিড়ি নষ্ট করে দিয়েছে মন্দিরেরই এক কুকুর। তবুও রাগ নেই। সে অপেক্ষা করছে দূর গাঁ থেকে কখন কেউ চাল-আলু দিয়ে যাবে আর তা সে মাটির মালসাতে ফুটিয়ে নেবে।
মানুষ সন্ন্যাস হয়ে গেলে তার ভিতরটা কেমন যেন মায়ানদী হয়ে যায়। আমরা তার ত্যাগকে যতই বলি না কঠিন, আসলে এ হল নিজের ভিতরের কোমলতাকে একটা খসখসে মোড়কে প্রলেপ লাগিয়ে টিকে থাকা। আমাদের সমাজতন্ত্র বা অর্থতন্ত্র না হলে কবেই ময়দার রুটির মতন সেঁকে গিলে নেবে।


সেদিনকার ওই পাগলা সাধুর কথা মতো বৃহস্পতিবার মানে ০৯-০৫-২০১৯ তারিখ যাওয়ার কথা। সেদিন সকলের সেকি উৎসাহ! কিন্তু দিনের দিন কাউকে পাওয়া গেল না। একমাত্র বসির! ওর সঙ্গেই আমার এক বছরের প্ল্যানিং। ও কথা দিয়েছে, কেউ না গেলে আমরা দু-জনেই যাব। সকাল থেকে আকাশফাটা রোদ। চল্লিশের কাছাকাছি। দুপুরে দুই বন্ধু বেরিয়ে পড়লাম। যাতায়াতের রাস্তাটাও ভারি চমৎকার। দুপারে শুধু মাঠ আর মাঝে কালো পিচের রাস্তা। এই রাস্তা দিয়ে সকালে বা বিকালের দিকে গেলে আর ফেরার কোনো হুঁশ থাকে না। কিন্তু এই দুপুরে যেতে কষ্ট হচ্ছিল। যে সবুজ শস্য মাথা তুলে থাকতে পছন্দ করে, তার হেলে যাওয়া মাথাকে কীভাবে মেনে নেব? মাঠভক্ত যে চাষিরা বিকাল না গড়ালে বাড়ি ফেরে না, তারাও চলে গেছে দ্রুত। কেউ কেউ মুখ পোড়া, ঘামেভেজা শরীর নিয়ে প্রকৃতিকে অবহেলা করছে। আর মুষ্টিমেয় চাষি, যারা ফণিকেও তোয়াক্কা করেনি তারা নবান্নের ধান ঘরে তুলবে বলে মাঠে শুয়ে থাকা কাটা গাছগুলো তড়িঘড়ি গোছাচ্ছে। এই দৃশ্য দেখতে দেখতে এগোচ্ছি। ভালো লাগছে দু-ধারের নিশ্চুপ কলাগাছেদের দেখে। পাতাঝরা বাবলাগাছগুলো খাঁ খাঁ করছে। ওদের কি কিছু বলার নেই? গাছে গাছে আধপাকা খেজুর। হেজে গেছে। ওরা কি গরম উপেক্ষা করে টিকে থাকবে? কিছুদিন পর ঠোঁটে করে পাকা খেজুর নিয়ে এ-মাঠ থেকে ও-মাঠ দাপাদাপি করবে যে পাখিগুলো আজ তারা কই? ভাঙা পোলে বসা দুটো কাক দেখলাম, দু-জন দু’জনের থেকে মুখ ফিরিয়ে। ওদের কি আজ অভিমানের দিন? অভিমানের দিনগুলো কেউ কেউ বলে মেঘলা। আমার মনে হয় ভুল। অভিমানের দিনগুলো হল তপ্ত রোদ্দুরের। নিজের নুন জিভে নিয়ে দেখা যায় কতটা বিষ তার ভিতর অস্তিত্বকে চুরমার করেছে। আজ কি শুধুই চুরমার হওয়ার দিন? আমার ভিতরের আমি কই? কেমন স্বার্থপর আমি? আমার একমাত্র সঙ্গী বন্ধুটির সঙ্গে একটু কথাও বলছি না! ওর সারাশরীর ঘামে জপজপ করছে। মুখ শুকিয়ে গেছে। মাঠে মাঠে শশা, ইচ্ছে করছিল তুলে গলা ভিজিয়ে নিই। মাঠ থেকে তুলে কচি শশা খাওয়ার কী যে আনন্দ যার অভিজ্ঞতা আছে সেই কেবল জানে। তবে ওই রোদ্দুরে বাইক থেকে নেমে মাঠে যাব, সেই শক্তিও ছিল না। আমরা চলছি আর চলছি… বাগবেড়িয়ার বাঁশের সাঁকো পরিয়ে আরও দূরে… পথ ফাঁকা। গ্রামের পথে পথে ঘুরে বেড়ানো কোনো হাঁস-মুরগিও নেই। জায়গায় জায়গায় তৃণমূল আর বিজেপির পতাকা ঝুলছে। কোথাও সটান। কোথাও নুইয়ে পড়া। ওদের কোনো ক্লান্তি নেই। যে যার মতো লড়ে গেছে। এখন ঝড়-রোদ-বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে টিকে আছে। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার এই গ্রামগুলোতে একটা সময় বিজেপির চিহ্নমাত্র ছিল না। কী করে এত পতাকা? এত পোস্টার? এরা তো খেটে খাওয়া মানুষ, এরা উন্নয়ন বলতে বোঝে দু-মুঠো খেয়ে-পরে বাঁচা। তাহলে কী এদের ঘরে উন্নয়নের কোনো জোয়ার পৌঁছায়নি? ২৩শে মে ফলপ্রকাশ হলে হয়তো কিছুটা বোঝা যাবে। তবে ঢোকার মুখে ভালো লাগছিল, গোলাপি কাগজফুল গাছে একটি নীলকণ্ঠ পাখিকে বসে থাকতে। ওকি আমাদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছিল?


ঘড়িতে পৌনে দু-টো। আগেরদিন যেখানে খাঁ খাঁ করছিল, আজ চরম রোদ্দুরেও লোকে লোকারণ্য। গাড়ি গাড়ি মানুষ এসেছে। পাঁচ-সাতটা বাস। অগুনতি টাটাসুমো, ম্যাজিক, টোটো, বাইক, সাইকেল। পলদা নদীতে নৌকাতে মানুষ এপার-ওপার হচ্ছে। ঘাটের পাশে যেখানে একটু ছায়া দেখেছে, সেখানেই বসে পড়েছে মানুষ।
জায়গাটার নাম এতক্ষণে বলা হয়নি। জায়গাটা বাগবেড়িয়া আর আমঝুপি গ্রামের মাঝামাঝি। এটি ঠিক কোনো গ্রাম না। ফাঁকা মাঠের মাঝখানে একটি আশ্রম। পাগলাবাবার আশ্রম। মূলত শিব-পার্বতীর পুজো হয়। আর এই জায়গাটি এতই নাকি জাগ্রত সকলে নিজের মনস্কামনা পূরণ করার জন্য বাবার পুজো দিতে আসেন। অগণিত ভক্তের দল। এটি ‘পাগলাখালি’ বা ‘পাগলাতলা’ নামেই পরিচিত।
আমি আর বসির ঢুকে পড়েছি। ধর্মীয় জায়গা খুব সেনসেটিভ হয়। যাকে-তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করলে হিতে বিপরীত হতে পারে। কৌতূহল পরিণত হতে পারে কালে। সপ্তাহের দু-দিন (সোম, বৃহস্পতি) এখানে মানুষ মোচ্ছব দেয়। কমিটি থেকে ভক্তদের খিঁচুরি রান্না করে খাওয়ানো হয়। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসে। অনেকে ব্যক্তিগতভাবেও রান্নার সামগ্রী এনে রান্না করে ভক্তদের খাওয়ায়। আমরা মন্দির চত্বরে ঢুকে দেখি— সারি সারি মানুষ কলাপাতায় খিঁচুরির ভোগ খাচ্ছে। পাশেই চলছে একদলের কীর্তন। মন্দিরের ভিতরে ভক্তদের অজস্র ভিড়। মন্দির চত্বরেই বসেছে চারিদিকে সারি সারি দোকান। শুধু পূজার ডালি বা লাল-নীল সুতো বা রুদ্রাক্ষের মালা নয়, বাচ্চাদের খেলনা, ফুচকা, বাদাম থেকে শুরু করে মিষ্টি, কচুরির দোকানও বসেছে। পরিস্থিতি কিছুই বুঝতে পারছি না— কীভাবে কাকে জিজ্ঞাসা করব। কতদিনের আগ্রহ নিয়ে রোদে পুড়ে এসেছি। খেয়ে আসা হয়নি। পেটে খিদে চুঁ চুঁ করছে। গরম জিলাপি ভাজা হচ্ছে। কুড়ি টাকায় তিনশো জিলাপি নিলাম। এতটা পারব না। তবুও শেষ দুটো তুই খাঁ খাঁ করে একটা একটা মেরেও দিলাম দু-জনে। ঘুরছি আর এদিক এদিক এসে দাঁড়াচ্ছি। সুযোগ খুঁজছি। মন্দিরের ভিতরে কী পুজো হচ্ছে, কেন মানুষ ঝাঁকে ঝাঁকে ঢুকছে। নাবালক থেকে সাবালক সকলের ভিড়। দাঁড়িয়ে আছি, এক বয়স্ক মহিলা মাথায় তিলক কেটে দিল। বসির দিল না। গরমে যা ঘাম হচ্ছে! আমাদের দেখে কোনোভাবেই মনে হচ্ছে না, আমরা পাগলাবাবার কোনো ভক্ত। যেভাবে ছবি তুলছি বা ঘোরাঘুরি করছি অনেকেই অবাক প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। যাইহোক, বসির বলল: এবার আর কোনো অসুবিধা নেই। যা মন্দিরের ভিতর দেখে আয়। ঢুকে দেখি: একটা বটগাছের চারিদিকে শিবের মূর্তি আর ত্রি-ফলা। কোথাও কোথাও পার্বতী। গুঁড়ির চারিদিকে ভক্তদের ফুল। কোথাও কোথাও সুতো দিয়ে বাঁধা ছোটো ছোটো ইট বা খোলান, মালার মতো করে গাছে ঝোলানো। মন্দিরে গাছের সোজাসুজি গুঁড়িতে একজন পুরোহিত পুজো দিচ্ছেন। আর পুজোর বাতাসা ছুঁড়ে দিচ্ছেন বাইরে। ভক্তদের ওই বাতাসা কুড়ানো দৃশ্যটি না দেখলে বিশ্বাসই হবে না কারো… বাতাসা কুড়োবার সে কী তৎপরতা! বেশিক্ষণ মন্দিরের ভিতরে থাকতে পারলাম না। কাদায় জপজপ করছে। এখানে দূর দূর থেকে জল এনে বাবার মাথায় জল ঢেলেছে অনেকে গতরাতেই।

বার্ষিক উৎসবের লোক-সমাগম

যাইহোক বেরিয়ে এলাম। আমার জানার উদ্দেশ্য ছিল—
১. পাগলা বাবা কি কোনো ব্যক্তি ছিলেন?
২. ভক্তদের এই উন্মাদনা কেন?
৩. আশ্রমটির প্রকৃত ইতিহাস কী?

একটি চায়ের দোকানে গেলাম। চা খেতে খেতে জিজ্ঞাসা করলাম, এই আশ্রমটি তাও কত বছরের পুরানো? আমার বয়স তো চল্লিশ পেরিয়ে গেছে। সেই ছোটো থেকেই দেখছি। ইতিহাস সম্পর্কে আমরা জানতে চাইলাম, ধরিয়ে দিল একটা কাগজ। কিন্তু কাগজ খুলে তেমন কিছুই পেলাম না। শুধু তাতে ‘অষ্টপ্রহরব্যাপী শ্রীশ্রীহরিণাম সংকীর্ত্তন মহাযজ্ঞ’-এর বিজ্ঞাপন। লোকটি তেমন পড়াশোনা জানে না। জানলে হয়তো আমাদের এই কাজটি ইতিহাস জানতে পারব বলে ধরিয়ে দিতেন না। কথা বলতে বলতেই চায়ের দোকানে একটি ছেলে এল। তার থেকে জানা গেল, ওরা তিনবাস লোকজন এসেছে। ওরা নিজেরাই সাদাভাত রান্না করে মানুষকে খাইয়েছে। ২০০০ পাতা অলরেডি শেষ হয়ে গেছে। আবার কাউকে পাতা আনতে পাঠিয়েছে। দশ বছর ধরে ছেলেটি আসে। চায়ের দোকান থেকে এই আশ্রম সম্পর্কিত বই পাওয়া যায়, তথ্য পেলাম। একের পর এক দোকান ঘুরলাম। কোথাও বই নেই। এক দোকানদার বলল, বই থাকলে আমরা বিক্রি করতাম না? ক্রমশ আশা নিভছে, বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে। লোকজনের ভিড় কমতে শুরু করছে। কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করলে এড়িয়ে যাচ্ছে। আর কেউ কেউ কথা বললে এটুকুই জানতে পারছি, ছোটো থেকেই আছে। বাবা খুব জাগ্রত। বাবার কাছে কিছু চাইলে কাউকে ফেরায় না। ঘুরতে ঘুরতে গেলাম এক ফটোওয়ালা কাকার কাছে। পলদার ওপারের বাড়ি। বলা যায় স্থানীয় বাসিন্দা। উনি প্রায় ১৫ বছর ধরে এই পাগলাবাবার মন্দিরের ফটো বিক্রি করেন। ওনার কাছে বই আছে কিনা জিজ্ঞাসা করতে, বললেন বছর পাঁত-সাত আগে পাওয়া যেত। মাজদীয়ার এক মাস্টারমশাই লিখেছিলেন। এখন আর পাওয়া যায় না? বোধহয় এখানকার কমিটিই বন্ধ করেছে… বইটিতে কী ছিল? ফুরিয়ে গেলে কেনই বা আর প্রকাশ হবে না? এতদিনের পুরানো একটা জায়গা নিয়ে সকলের তো আগ্রহ থাকবে। তাছাড়া নতুন কেউবা লিখছেন না কেন? এর আগে কেউ কি লিখেছেন? জানি না… তবুও ওই বইটা নিয়ে খটকা লাগল।

মন্দিরে গাছের সোজাসুজি গুঁড়িতে একজন পুরোহিত পুজো দিচ্ছেন। আর পুজোর বাতাসা ছুঁড়ে দিচ্ছেন বাইরে। ভক্তদের ওই বাতাসা কুড়ানো দৃশ্যটি না দেখলে বিশ্বাসই হবে না কারো… বাতাসা কুড়োবার সে কী তৎপরতা!

প্রায় পনেরো বছর ধরে উনি ছবি বিক্রি করছেন। উনি মেইনলি সাপ্লাইয়ার। ওঁর থেকে নিয়েই অন্যরা বিক্রি করেন। শুধু বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য এই দু-মাস উনি আসেন। এই দু-মাসে ভক্তদের ভিড় বেশি হয়। ভদ্রলোকের থেকে জানতে পারি, এখানে এমন অনেক আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছে বলেই তো মানুষ এত আসে!
দুটি ঘটনা:
ক)
চাপড়ার ভবানন্দ বলে একজন দীর্ঘ বারো বছর আসছেন। প্রত্যেক সপ্তাহেই আসেন। উনি সারবেন না বলে, চেন্নাই থেকে ফিরে এসেছিলেন। তারপর এই পাগলাবাবার এখানে আসার পর থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ। এখন দিব্যি হেসেখেলে বেড়াচ্ছেন। ব্যাবসা-বাণিজ্য করছেন।

খ)
দ্বিতীয় ঘটনাটি বললেন, একটি পঙ্গু মেয়ের। প্যারালাইসড একটি মেয়ে এখানে এসেছিলেন। পরিবারসহ চব্বিশ ঘণ্টা বাবার কাছে থাকত। বাবার পুজো করত। দু-মাস পর মেয়েটি হেঁটে ফিরল।

কতটা সত্যি, কতটা মিথ জানি না। তবে পাগলাখালির ইতিহাস জানা অত সহজ না। আমাকে হয় ওই মাস্টারের বইটা যেভাবেই হোক ব্যাবস্থা করতে হবে। আর বেছে বেছে এই অঞ্চলের বিভিন্ন পুরোনো লোকের সঙ্গে কথা বলা জরুরি।
ফটোওয়ালা কাকার থেকে বিদায় নেবার পর আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলাম। সবাই রোদে পুড়ে এতটাই ক্লান্ত যে একটি এক্সট্রা কথা বলতেও রাজি না। পলদা নদীর দিকে মুখে করে, আশ্রমের একটি গাছের কাছে গিয়ে বসলাম দু-জনে। ওখানে একজনকে মনে হল, পুরানো অনুরাগী। বসির ঠিক প্ল্যানিং করে ওই কাকার পাশে অল্প একটু ফাঁকাতেই বসে পড়ল। আমি দাঁড়িয়ে আছি দেখে পাশের লোকটি বাঁ-পাশে এগিয়ে গেল। বসির শুরু করল, কাকা এখানকার ইতিহাস নিয়ে কোনো বই পাওয়া যায় না? উনিও সেই একই কথা, আগেও পাওয়া যেত… এরপর উনি নিজেই বলতে শুরু করলেন: আগে তো এখানে কিছুই ছিল না। শুধু ওই গাছ। পাশের গ্রামের বাবার এক ভক্ত, একসময় ওর কিছু ছিল না। এখন দুবাইতে ব্যাবসা করে। সেই এই মন্দির বানিয়ে দিয়েছে। আগে একটাই কল ছিল। এত লোক। কলে লাইন লেগে যেত। আমি তখন আসতাম, তবে এত নিয়ম করে না। একবার জিলাপি খেয়েছি তা হাত ধোব জল নেই। এমন বৈশাখ মাস। চারিধার শুকিয়ে কাঠ। এক জায়গায় মাঠের কাছে গোরুর খুরের গর্তে একটু জল পেলাম। তা দিয়ে হাত ধুয়ে নিলাম। মনে মনে পাগলাবাবাকে বললাম, বাবা যদি আমার ঘরের পাট ১৭০০ টাকায় বিক্রি করতে পারি তাহলে তোর এখানে কল পুঁতে দেব। দু-মাসের মধ্যে পাটের দাম বাড়ল। ৭০০ টাকা কেনা পাট ১৭০০ ছাড়িয়ে গেল। প্রচুর লাভ হল। পরের বছর বাবাকে বললাম, তোর ১০০০ ভক্তকে লুচি করে খাওয়াব। এভাবে ১০০০ থেকে ২০০০, ২০০০ থেকে ৩০০০-তে গিয়ে ঠেকল। আমি নিজেই বাবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলাম। এত লুচি বেলার লোক পাওয়া যায় না। ফিরে এলাম খিঁচুরিতে। সেই থেকে এটাই চলে। আমাদের একটা দল আছে। সবাই মিলে এখন পুরো ব্যাবস্থা করি। ভক্তদের খাওয়ায়।

বার্ষিক উৎসবে ভক্তদের ভোগ খাওয়ার মুহূর্তে

আরও নানা মিথ ছড়িয়ে আছে। শোনা যায়, একবার এক লোক বিরাট বোঝা তোলার জন্য কাউকে পাচ্ছিলেন না। হঠাৎ একজন বুড়ো দাড়িওয়ালা লোক এসে হাজির। তিনি তুলে দিলেন। তারপর লোকটির সঙ্গে চলতে চলতে হঠাৎ কোথায় মিলিয়ে গেলেন।
আবার শোনা যায়, পলদার ডানদিকে টাওয়ারের কাছে একটা এলাকা বসে যায়। কোনোভাবেই কিছু হচ্ছিল না। পাগলা বাবার কাছে পুজো দেবার দু-ঘণ্টার মধ্যে ঠিক হয়ে যায়।
বেলা ঘনিয়ে আসছে। প্রকৃত ইতিহাস একদিনে পাওয়া সম্ভব না। আরও ঘুরতে হবে। কয়েকবার আসতে হবে। শেষবেলায় পলদার এপাশে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম— ওপারের সেই বট আর খেঁজুর গাছটিকে। খেঁজুর গাছটির অস্বাভাবিক বেড়ে ওঠা নিয়েও রয়েছে নানা মিথ। গতদিনের সেই পাগলা সন্ন্যাসীকে এদিন একবারও দেখতে পেলাম না। ওঁর আদি বাড়ি আসামে বলেছিলেন। ওখানেই কোনো আশ্রমে যাওয়ার কথা ছিল। সেদিন ওঁর থেকে শুনেছিলাম— ওই গাছ দু’টিতে বাবা-মা থাকে। দিনে দু-বার তারা নদী পার করে। সকালে একবার, আরেকবার সন্ধ্যাবেলা। আমাদের আসার কিছুক্ষণ আগেই নাকি ওরা নদী পেরিয়েছে। যখন ওরা যাতায়াত করে পুরো পরিবেশ চেঞ্জ হয়ে যায়। চারিধার হয়ে যায় থমথমে। একবার নাকি বড়ো খেজুর গাছটিতে কেউ রস সংগ্রহ করার জন্য কেটেছিল। গলগল করে রক্ত বেরিয়েছিল। ওই লোকটিও বেশিদিন বাঁচেননি।


কৌতূহলের বারো আনার মধ্যে অনন্ত ছয় আনা হলেও নিয়ে ফিরছি এটুকু শান্তি। শান্তির বারান্দার এখন মৃদু রোদ। সবুজ মাঠ স্বশাসনে। মাঠে মাঠে চাষির দল। এটাই আমার বাংলা। এটাই বাংলার প্রকৃতি। এটাই আমার বাংলার লোকাচার। আমাকে আবার আসতে হবে… আবার আসতে হবে? পাগলাতলার কী জাদু, কে জানে!

Facebook Comments

পছন্দের বই