লেখক নয় , লেখাই মূলধন

অনুরাধা মুখার্জির গল্প

ডেথ সার্টিফিকেট

বেলা এগারোটা। প্রতিদিনের মতো ডাঃ রায়ের চেম্বারে রোগীর ভিড় ওয়েটিং রুমে, বাইরের বারান্দা ছাপিয়ে সদর রাস্তা পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে। নিত্যদিনের এই এক চিত্র। এমন সময়ে স্থানীয় থানার ওসি একজন কনস্টেবল-সহ ডাঃ রায়ের চেম্বারে এলেন ও গটগট করে ভিতরের ঘরে ঢুকে গেলেন। রোগী দেখতে দেখতে মুখ তুলে তাকান ডাক্তারবাবু, বলেন— জুতোটা একটু বাইরে খুলে আসবেন প্লিজ। নানা রকম রোগী আসে তো, তাই সংক্রমণের ভয় থাকে। এই জন্য সামান্য সাবধানতা আরকী!

অফিসার ভদ্রলোক কর্ণপাতও করলেন না তাঁর কথায়। একটা চেয়ারের পিছনে রুলার ঠুকতে ঠুকতে প্রশ্ন করেন— গতকাল রাতে আপনার চেম্বারে একটি গুলিবিদ্ধ ছোকরা এসেছিল? আপনি তার গুলি বার করে দিয়েছেন?

ভেতরে ভেতরে একটু চমকালেন ডাঃ রায়, কিন্তু শান্ত ‌স্বরেই জবাব দিলেন— হ্যাঁ দিয়েছিলাম।

— কেন আপনি থানায় খবর দিলেন না? জানেন সে‌ একজন আ্যন্টিসোশ্যাল?

ডাক্তারবাবু এবার গম্ভীর হলেন— ছেলেটি আ্যন্টিসোশ্যাল আপনার কাছে, আমার কাছে সে একটি রোগী ও তার চিকিৎসার আশু প্রয়োজন ছিল। তখন খবরা-খবর করে চিকিৎসায় বিলম্ব করা সম্ভব ছিল না, তাতে ছেলেটির প্রাণ সংশয় হতে পারত।

— তার সঙ্গে আরও কেউ ছিল?

— হ্যাঁ আরও দু-টি ছেলে ছিল।

— তারা কোন দিকে গিয়েছিল বলতে পারেন?

— না, ডঃ রায়ের গম্ভীর উত্তর, “তখন রাত-দুপুর, আমি দরজা বন্ধ করে শুতে চলে যাই, রাস্তার দিকে লক্ষ করিনি।

— অত রাতে দরজা খোলা-বন্ধ আপনি নিজেই করেন?

— হ্যাঁ, আমার পেশায় দিন-রাত নেই, তাই বলে আমার পরিজনকে আমি বিরক্ত করব কেন?

— ছেলেগুলোকে দেখলে আপনি চিনতে পারবেন নিশ্চয়ই।

— আজ্ঞে না, দিনে এত রোগী দেখি যে, কারো মুখ আলাদা করে মনে রাখা সম্ভব নয়।

— দেখুন ভবিষ্যতে এ-ধরনের কেস এলে আগে থানায় খবর দেবেন তারপর আপনার চিকিৎসা শুরু করবেন।

— কথা দিতে পারলাম না কারণ, ডাক্তারের কাছে প্রথম প্রায়োরিটি হল রোগীর চিকিৎসা, তার প্রাণরক্ষা, আনুষাঙ্গিক ব্যাপারের স্থান তারপর।

— আমি আপনাকে সতর্ক করছি ডঃ রায়। ওসির মুখ রাগে লাল, কণ্ঠস্বর ও অপমানজনক।

— আপনার কাছে আর একটু ভদ্র ব্যবহার আশা করেছিলাম অফিসার। মনে রাখবেন আমি আপনার অধস্তন কর্মচারী বা আইন ভঙ্গকারী অপরাধী নই। আপনি আমাকে অনুরোধ করতে পারেন, কিন্তু অর্ডার করতে বা চোখ রাঙাতে পারেন না। ডঃ রায়ের কণ্ঠস্বরে বজ্রকঠিন দৃঢ়তা।

— আচ্ছা দেখা যাবে আমি কী পারি আর কী পারি না? রাগে আরক্তলোচন ওসি চেম্বারের দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন আর সমবেত রোগীদের ভিড় ঠেলে গিয়ে জিপে উঠলেন, দেখলেন রাস্তায়ও প্রচুর লোক জড়ো হয়েছে ও জনতার ভাবগতিক খুব সুবিধার নয়। বুঝলেন ডাঃ রায়ের বিরুদ্ধে সোজাসুজি কিছু করাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।— ঠিক আছে, মনে মনে ভাবলেন দারোগাবাবু, “সোজা আঙুলে যদি ঘি না ওঠে তাহলে আঙুল বাঁকা করতে হবে।”

হ্যাঁ, এই ঘটনাটি সত্তরের দশকের দক্ষিণ-পূর্ব কলকাতার একটি বিশেষ অঞ্চলের ঘটনা। এই এলাকায় প্রচুর উদ্বাস্তু কলোনি আছে আর আছে বেশ কিছু সাধারণ মুসলিম পরিবার। ভদ্রলোক বলতে আমরা যা বুঝি তাঁরাও নিম্নমধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের। এই তল্লাটে উচ্চ-মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের লোকজনই সুদুর্লভ, উচ্চবিত্ত সম্প্রদায়ের বসবাসের তো প্রশ্নই ওঠে না, তাঁদের বসবাস বাসরাস্তার অপর পার্শ্বে। আর আছে রেললাইনের ধারে অসংখ্য ঝুপড়িবাসী— যাদের মেয়েরা ভদ্রলোকেদের বাসায় পরিচারিকার কাজ করে আর ছেলেরা রিক্সাওলা, ঠেলাওলা, মোটবাহকের মতো কায়িক পরিশ্রমের উপার্জনে পরিবার প্রতিপালন করে।

ডঃ রায় এই এলাকায় ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সবারই বাড়ির ডাক্তারবাবু, চিকিৎসকদের যে-প্রজাতিটি এই শতাব্দীতে অবলুপ্ত। রেলবস্তির এই শ্রমজীবী সম্প্রদায়ের অবাধ গতি ডাক্তারবাবুর চেম্বারে, সেখানে তারা শুধু বিনামূল্যে চিকিৎসাই পেত না, পেত ওষুধের স্যাম্পল ফাইল ও বহু ক্ষেত্রে রোগীর পথ্যের জন্য অর্থ সাহায্যও। তাঁর রাজনৈতিক রং কেউ জানত না, জানতে চাইতও না। কারণ, তাঁর দ্বার সদাসর্বদা সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। দু-জন কম্পাউন্ডার ও দু-বেলার ভিড় সামলাতে হিমসিম খেত। আর সত্তরের দশকে আরেক ধরনের রোগীর সংখ্যাও ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছিল, তারা নিশাচর। বিপক্ষীয় রাজনৈতিক দল বা পুলিশের হাতে প্রহৃত, আহত, রক্তাক্ত যে-কোনো দলের তরুণরা নির্দ্বিধায়, গভীর রাতে তাঁর চেম্বারের দরজায় মৃদু টোকা দিত, আর তারা জানত আর যেদিক থেকেই বিপদ আসুক না কেন, ডঃ রায়ের কাছ থেকে তাদের কোনো বিপদাশঙ্কা নেই।

কিন্তু দলমত নির্বিশেষে তাঁর এই জনপ্রিয়তা, নিঃস্বার্থ চিকিৎসা, বিশেষত আঁধার রাতের আগন্তুক তরুণদের প্রতি তাঁর মমত্ববোধ সে-যুগের পুলিশ প্রশাসন ও কিছু ক্ষমতালিপ্সু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ভালো চোখে দেখত না। কিন্তু তাঁকে ঘাঁটালে প্রচণ্ড জনরোষের মুখে পড়তে হতে পারে ভেবে সামনাসামনি তাঁরা কিছু করার সাহস পেত না। কিন্তু সাপ কি তার স্বভাব ছাড়তে পারে! তাই অন্ধকারে তাঁরা তাঁদের জাল বিছানো শুরু করে আর ঠিক এই সময়ে এল মোক্ষম সুযোগ— ইমার্জেন্সি ঘোষিত হল। পুলিশের হাতে এল অগাধ ক্ষমতা— সাপের বিষ ঢালার জন্য সুবর্ণ সুযোগ।

দ্বিতীয় পাতা

Facebook Comments

পছন্দের বই