লেখক নয় , লেখাই মূলধন

অনুরাধা মুখার্জির গল্প

ডেথ সার্টিফিকেট

কিন্তু ডাক্তারবাবু তখনও জানতেন না যে তাঁর জন্য অপেক্ষা করে আছে আরও দুর্ভোগ, আরও অনেক যন্ত্রণা। বহু অপমান ভোগ করতে হবে তাঁকে। আজীবন দুঃখ ভোগ আছে তাঁর কপালে। সুলিখিত চিত্রনাট্যের সবেমাত্র প্রথম দৃশ্যের অভিনয় সাঙ্গ হয়েছে ‌গত রাতে।

দশটা বাজতে না বাজতেই আবার পুলিশ আসে ওয়ারেন্ট নিয়ে। ডাক্তারবাবু গ্রেফতার হন ভূয়ো ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়ার অপরাধে। পাড়ার মধ্যে অজস্র কৌতূহলী ও আশঙ্কিত দৃষ্টির সামনে দিয়ে মাথা নীচু করে পুলিশের জিপে চড়ে চলে যান ডাঃ রায়। বেশ কয়েকদিন হাজতবাসের পর জামিনে মুক্ত হন তিনি। আদালতে তাঁর অপরাধ প্রমাণিত হয়। কিন্তু কী পরিস্থিতিতে তাঁকে ভূয়ো সার্টিফিকেট দিতে হয়েছিল তা আদালতের বিচার্য বিষয় ছিল না। শাস্তিস্বরূপ তাঁর রেজিস্ট্রেশন নাকচ হয়, তিনি হারান তাঁর পেশা, তাঁর চিকিৎসার অধিকার। লাঞ্ছিত, নিপীড়িত, বিতাড়িত চিকিৎসক এতটা আঘাত নিতে পারলেন না। সিভিয়ার করোনারি এ্যাটাকের ফলে তাঁকে দীর্ঘদিন হাসপাতালে কাটাতে হয়। শয্যাশায়ী ডাক্তারবাবু জানতেও পারেন না যে, তাঁর দুই ছেলের জীবনে কী পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে।


ডাক্তারবাবুর ছেলেদের কথা বলার আগে তাঁকে শেষ করে দেওয়ার জন্য যে-নাটক সাজানো হয়েছিল সেই নিয়ে দুই একটি কথা বলে নেওয়া যাক। এই নাটকের রচয়িতা যদিও সেই ওসি কিন্তু উপাদান যোগাড় করে দিয়েছিলেন ওসিকে তাঁর পৃষ্ঠপোষক এক ধনাঢ্য স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তি। মৃতা মহিলা তাঁর আশ্রিতা অসহায় আত্মীয়া। ইচ্ছেমতো ভোগ করার পর মহিলা যখন অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন ও অনাগত সন্তানের পরিচয়ের জন্য দাবি জানান তখনই তাঁকে ইহলোক থেকে সরিয়ে দেবার জন্য পরিকল্পনা করা হয় দারোগাবাবুর জ্ঞাতসারে। আর এই হত্যাকাণ্ড তাঁর হাতে তুলে দেয় ডঃ রায়ের উঁচু মাথাটা ধুলোয় লুটিয়ে দেবার সুযোগ। তাই ডাঃ রায় বাড়ি ফিরে আসার পর মহিলার শব গেল শ্মশানে ও পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক রেড হল সেখানে, পুলিশের ডাক্তার রায় দিলেন বিষক্রিয়ায় মৃত্যু, শববাহকরাও গ্রেফতার হল। তবে পুলিশি তৎপরতায় আদালতে আত্মহত্যা প্রমাণিত হওয়ায় তারা মুক্তি পেল জরিমানা দিয়ে। জরিমানার টাকাও কিছু দিনের হাজতবাসের খেসারতস্বরূপ তারা ভালো টাকা পেয়েছিল। এ-সব তথ্য সামনে আসে অনেক পরে। তার আগেই ডাক্তারবাবুর জীবনে চরম সর্বনাশ ঘটে গিয়েছে।

ডাক্তারবাবুর দুই ছেলে, বড়ো কানু ও ছোটো শানু। এই নামেই তারা এই তল্লাটে পরিচিত। সহদর ভাই হলেও স্বভাবের দিক দিয়ে তারা দু-জন বিপরীত মেরুর বাসিন্দা। কানু জীবনকে নিয়েছিল খুব হালকা চালে, লক্ষ্যহীনভাবে সময়ের স্রোতে ভেসে যাওয়া হল তার প্রকৃতি। সেই রাতের অত্যাচার আর বাবার এই লাঞ্ছনা দেখে সে হয়ে গিয়েছিল ভীত, সন্ত্রস্ত ও সদাসশঙ্ক।

আর উচ্চ-মাধ্যমিকের ছাত্র শানু দাদার একদম বিপরীত, অত্যন্ত গম্ভীর ও সিরিয়াস ছেলে। তার স্বপ্ন বাবার মতো ডাক্তার হবে সে, আর সেই লক্ষ্যেই নিজেকে গড়ে তুলছিল সে। কিন্তু সেই অভিশপ্ত রাতের অত্যাচার আর বাবার অবমাননা আর দুর্গতি তার মধ্যে জ্বালিয়ে দিল প্রতিহিংসার আগুন। সে ঠিক করে এই অত্যাচারের, অসহ্য লাঞ্ছনার আর বাবার অপমানের বদলা তাকে নিতেই হবে। বহু চেষ্টায় সে যোগাযোগ করে তাদের সঙ্গে যারা মাঝে মাঝেই গভীর রাতে চিকিৎসার জন্য তার বাবার চেম্বারের দরজায় টোকা দিত। তারাও শানুকে লুফে নিল। ওই অত্যাচারী পুলিশ অফিসারের নাম অনেকদিন যাবৎ তাদের হিটলিস্টে ছিল। এখন শানুর মুখে ডাক্তারবাবুর লাঞ্ছনার সম্পূর্ণ বিবরণ জানতে পেরে তাদের মাথাতেও আগুন জ্বলে উঠল। তৈরি হল প্ল্যান অফ আ্যকশন। এবার ফাঁদ পাতল তারা, মূহূর্তের ভুলে সেই ফাঁদে পা রাখলেন সেই অফিসার আর সেই ভুলের খেসারত দিতে হল তাঁকে নিজের প্রাণ দিয়ে। ইতিহাসের অমোঘ নিয়ম— অত্যাচারীর ক্ষমা নেই।

কিন্তু পুলিশের গায়ে হাত পড়লে সমস্ত বাহিনী আহত বাঘের মতো হিংস্র হয়ে ওঠে। এই ঘটনার পর পুলিশ বাহিনী অতিসক্রিয় হয়ে ওঠে। সন্দেহভাজনদের তালিকায় শানুর নাম ছিল তাই সর্বপ্রথম কানুকে এনে হাজতে ঢোকায়। পুলিশের অত্যাচার কানুর মতো দুর্বল চিত্তের ছেলের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব ছিল না। তাই সে যতটুকু জানত, যা আন্দাজ করত সব বলে দিল পুলিশকে।

পুলিশ এবার হানা দিল শানুদের গোপন ডেরায়। অতর্কিত আক্রমণে কয়েকজন পালিয়ে যেতে পারলেও শানু ও আরেকটি ছেলে নিহত হল পুলিশের গুলিতে। শানুর দেহ সনাক্তকরণের জন্য হাজত থেকে বার করে আনা হল কানুকে। ভাইয়ের মৃতদেহ দেখে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়া কানুর চোখের সামনে দিয়ে যখন শানুর মৃতদেহের একটা পা ধরে টেনে হিঁচড়ে তোলা হল শববাহী গাড়িতে তখন কানু আর সইতে পারল না। অত্যাচারিত হয়ে পুলিশের কাছে দেওয়া জবানবন্দি ও তার ফলে শানুর হত্যা ও আদরের ছোটো ভাইয়ের মৃতদেহের নিদারুণ লাঞ্ছনা, বাবার ওপর নির্যাতন ও তাঁর নিদারুণ অসুস্থতা, এতগুলি আঘাত সহ্য করার মতো মানসিক শক্তি ছিল না কানুর, ফলে পাগল হয়ে গেল সে। ডাক্তারবাবু যখন সুস্থ হলেন তখন তাঁর দুই ছেলের মধ্যে একজন মৃত ও অন্যজন বিকৃত মস্তিষ্ক। আর পরিস্থিতির শিকার হতবাক, হতচকিত তাঁর স্ত্রী আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে কাঁদতেও ভুলে গেছেন। ডাক্তারবাবু নিজেও শয্যা আশ্রয় করলেন, পণ করলেন আর কখনো চিকিৎসা করবেন না।

কিন্তু জীবন তো শুধুই তমসাচ্ছন্ন নয়। তাই দিনের পর দিন চলে তাঁর দরজায় ধর্ণা। মধ্য ও নিম্ন মধ্যবিত্ত রোগী যেমন আছে তেমনই আছে তাঁর বিনা ভিজিটের রোগীরা। সবাই প্রত্যহ সোচ্চারে জানিয়ে যায়— আমরা কাগজ জানি না, নম্বর চিনি না। আমরা শুধু আপনাকেই জানি। আপনার ওষুধই আমাদের কাছে মৃতসঞ্জিবনী। এগিয়ে আসে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা মারা বেকার যুবকরা, জানায় তারা ডাক্তারবাবুর নির্দেশ অনুযায়ী কম্পাউন্ডারের কাজ চালিয়ে নেবে। আগেকার কম্পাউন্ডারবাবুরা কাজ ছেড়ে দিলেও কাজ চালিয়ে নিতে পারবে তারা ও এই কাজের জন্য বেতনাভিলাষী নয় তারা। তাদের একমাত্র আকাঙ্ক্ষা যে, চেম্বার খুলুন তিনি, আগের মতো রোগী দেখুন। আর পারলেন না ডাঃ রায়, আবার স্টেথোস্কোপ ধরতে বাধ্য হলেন নামকাটা ডাক্তার।

তাঁর আত্মীয় বন্ধুরাও চুপচাপ বসে ছিলেন না, অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন তাঁর হৃত অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য। ইতিমধ্যে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটেছে। পুনর্বিচারে তিনি ফিরে পেয়েছেন তাঁর চিকিৎসার অধিকার।

সত্তরের দশকের পর কেটে গেছে আরও দুই দশক। রুগ্ন, জীর্ণ শীর্ণ ডাক্তারবাবু তাঁর পুরোনো মান্ধাতার আমলের এ্যাম্বাসেডর গাড়ি চড়ে প্রত্যহ সকালে বাড়ি বাড়ি কলে যান। তবে এখন ওই একবারই কলে বার হন দিনে। আগেকার মতো যখন-তখন বার হতে পারেন না শরীরের জন্য। তবে চেম্বারে দু-বেলাই বসেন। সাহায্যের জন্য একজন জুনিয়র চিকিৎসক নিয়োগ করেছেন। কিন্তু আর কখনো ডেথ সার্টিফিকেট তিনি দেন না। প্রয়োজন হলে নবীন ডাক্তার সেই কাজ করেন। সার্টিফিকেট লিখতে গেলেই তাঁর চোখের সামনে ভেসে ওঠে জীবনোচ্ছ্বল তাঁর দুই কিশোর পুত্র কানু, শানুর মুখ। যাদের একজন পৃথিবী থেকেই হারিয়ে গিয়েছে আর অপরজন আছে মানসিক হাসপাতালে। অথচ এই দু-জনকে যন্ত্রণার হাত থেকে বাঁচানোর জন্যই তিনি নিজের সব নীতি, আদর্শ বিসর্জন দিয়ে জীবনে প্রথম ও শেষ বারের মতো ভূয়ো ডেথ সার্টিফিকেট দিতে বাধ্য হয়েছিলেন আর আজ তাদের স্মৃতিই তাঁর হাত চেপে ধরে, সার্টিফিকেট লিখতে দেয় না।

প্রথম পাতা

Facebook Comments

পছন্দের বই