লেখক নয় , লেখাই মূলধন

অনুরাধা মুখার্জির গল্প

ডেথ সার্টিফিকেট

বর্ষার রাত। ডঃ রায়ের চেম্বারের দরজায় জোর ধাক্কা। এ ধাক্কা তো নির্যাতিত, আহত তরুণদের মৃদু সশঙ্ক করাঘাত নয়, এই শব্দ কোনো বলদর্পী, গর্বান্ধ ব্যক্তির সজোরে পদাঘাতের শব্দ। ডাক্তারবাবু নিজেই দরজা খুললেন। দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন জনাচারেক কনস্টেবল-সহ সেদিনের সেই থানা ইনচার্জ।

— ডঃ রায় আপনাকে তো একটু থানায় যেতে হবে, নিজের করতলে রুলার ঠুকতে ঠুকতে বললেন ওসি।

— এত রাতে! এই বর্ষায়! বিস্মিত প্রশ্ন ডঃ রায়ের।

— আপনি চিকিৎসক, চিকিৎসা আপনার ফার্স্ট প্রায়োরিটি। তাই আপনার আপত্তি করার তো কোনো কারণ নেই। ব্যঙ্গের কশাঘাত হানেন থানা-অফিসার।

— কিন্তু থানায় তো আর রোগী দেখতে যেতে হবে না। এসেছেন তো আমায় জিজ্ঞাসাবাদ করতে। তা সেটা তো কাল সকালেও করা যেতে পারে, তাতে তো কোনো মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। বিদ্রূপের প্রত্যুত্তরে বলেন ডাক্তারবাবু।

— ওহ্! সরি! থানা বলাটা আমার স্লিপ অব টাঙ্‌। থানা নয়, থানার কাছাকাছি আমার এক আত্মীয়ের বাড়িতে এক রুগ্না মহিলাকে দেখার জন্য আপনাকে নিতে এসেছি। ব্যঙ্গের রেশ তাঁর কথায় বেশ স্পষ্ট।

বিপদের আভাস পেলেও ডাক্তারবাবু শান্তভাবে প্রশ্ন করেন, “তিনি কি খুব অসুস্থ, কাল সকালে গেলে চলবে না?”

— না ডক্টর, তিনি অত্যন্ত অসুস্থ। আপনি এখনি চলুন।

— চলুন তাহলে, আমি ভিতরে একটু বলে আসি। “পাঁচ মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে তিনি জিপে ওঠেন। নিদ্রাতুর ভীত চোখে তাঁর স্ত্রী এসে দরজা বন্ধ করেন।

দারোগাবাবুর সঙ্গে ডাঃ রায় এসে ঢুকলেন একটা ছোটো একতলা বাড়িতে যেটা মোটেও থানার কাছে নয়। যে-ঘরে তাঁরা ঢুকলেন সেখানে একটি তক্তাপোশের উপর এক মহিলা দেওয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে আছেন ও রোগীর আশেপাশে কেউ নেই। ডাক্তারবাবুর অভিজ্ঞতা তাঁকে পুরো ঘটনার অস্বাভাবিকতা সম্পর্কে সচেতন করল। তিনি এগিয়ে গিয়ে রোগিনীর মুখ দেখলেন, অনাবশ্যক জেনেও রোগিনীর নাড়ি, আঙুল ও নখের রং পরীক্ষা করলেন ও স্পষ্ট বুঝলেন রোগিনীর মৃত্যু হয়েছে বিষক্রিয়ায়, এবং তাঁকে ডেকে আনার নিহিতার্থ তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল। ধীরে রোগিনীর হাতটা নামিয়ে রেখে ওসির মুখোমুখি দাঁড়ালেন— “এই মহিলার মৃত্যু অন্তত ঘণ্টা তিনেক আগেই বিষক্রিয়ায় হয়েছে, তবে আমাকে এভাবে ডেকে আনা হল কেন?”

— ইয়েস ডঃ রায় সে-তথ্য আমার জানা আর আপনাকে ডেকে এনেছি কারণ, আমার একটা নর্মাল ডেথের সার্টিফিকেট চাই আর সেটা আপনাকেই দিতে হবে।

— অসম্ভব। গর্জে ওঠেন ডাঃ রায় “এ তো ক্লিয়ার কেস অফ পয়জনিং, মে বি মার্ডার অর সুইসাইড। আর তার তদন্ত তো আপনার এক্তিয়ারভুক্ত। আমি সার্টিফিকেট দেব না।”

— দিতে তো আপনাকেই হবে ডাক্তার। চিবিয়ে চিবিয়ে বলেন ওসি, “অসম্ভবকে সম্ভব করার পদ্ধতি আমার জানা আছে।”

— আমি দেব না। দৃঢ় স্বরে জানান ডাক্তারবাবু।

এরপর ঘরের মাঝখানে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন ডঃ রায় আর পিঞ্জরাবদ্ধ পশুর মতো পদচারণা করতে থাকেন দারোগাবাবু। আর শয্যায় পড়ে থাকে বিষজর্জর মহিলার মৃতদেহ। এইভাবেই কেটে যায় ঘণ্টাখানেক। এবার থানা ইনচার্জ চীৎকার করে ওঠেন— “আপনি সার্টিফাই করবেন কিনা?

“কখনোই নয়।” শাণিত স্বরে উত্তর শোনা যায়।

“আপনাকে করতেই হবে ডাক্তার। না শুনতে আমি অভ্যস্ত নই।”

— আমি করব না, কী করবেন আপনি? এ্যারেস্ট করবেন? টর্চার করবেন? করুন আপনার যা খুশি। কিন্তু আমার এক কথা সার্টিফিকেট আমি দেব না।

এবার তীব্র ব্যঙ্গ ঝরে পড়ে ওসির কণ্ঠস্বরে— দেবেন ডাক্তার দেবেন। দাওয়াই আমার জানা আছে। ডাক্তারকে নিয়ে এবার থানায় আসেন তিনি। এএস আই-কে বলেন, “যাও। ডাক্তারের দুই ছেলেকেই তুলে আনো।”

— এ আপনি করতে পারেন না। ডাক্তারবাবু চীৎকার করে ওঠেন।

— আমি সব পারি ডাক্তার। এখন ইমার্জেন্সি চলছে। মিসায় তুলে আনব আপনার ছেলেদের আর প্রমাণ করে দেব যে, তাদের সঙ্গে বেআইনি রাজনৈতিক দলের যোগাযোগ আছে। ইচ্ছে করলে এনকাউন্টারও করতে পারি। ছাদ কাঁপিয়ে অট্টহাস্য করে ওঠেন দারোগাবাবু।

কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর দুই কিশোর পুত্রকে হাজতে পুরে দেওয়া হয়। তারপর চলে নির্মম অত্যাচার। ছেলেদের আর্তচিৎকারে কানে হাত চাপা দিয়ে বসে থাকেন ডাক্তারবাবু। তাদের প্রতিটি আর্তনাদ যেন তাঁকে কশাঘাতে বিদ্ধ করে। তিনি জানতেন তাঁর অস্বীকৃতির মূল্য তাঁকে চোকাতে হবে, তিনি সমস্ত দুর্যোগের কল্পনা করেছিলেন নিজেকে ঘিরে আর তার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতও ছিলেন। কিন্তু কোনো নরপিশাচ যে তাঁর নিরপরাধ কিশোর পুত্র দু-টির উপর এরকম নির্মম অত্যাচার করতে পারে তা ছিল তাঁর স্বপ্নাতীত। এই দুঃসহ অবস্থায় কেটে যায় অনেকটা সময়। আর পারেন না তিনি সহ্য করতে। পিতৃহৃদয়ের অনাবিল স্নেহের কাছে মাথা নত করে তাঁর আদর্শ, চিকিৎসকের নীতি, তাঁর মূল্যবোধ। ডাক্তার কাঁপা হাতে লিখে দেন সার্টিফিকেট। অফিসারের উচ্চ হাস্যে ফুটে ওঠে তাঁর বিজয়োল্লাস। দুই পুত্র-সহ ডাক্তার মুক্তি পান ভোররাতে। অনেক কষ্টে আহত, পীড়িত দুই পুত্র নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন যখন, তখন রাজপথে যান চলাচল শুরু হয়েছে। প্রাথমিক শারীরিক চিকিৎসার পর (মানসিক ক্ষতের চিকিৎসা করার মতো মানসিক সুস্থতা তখন তাঁর নিজের ছিল না) পুত্রদের নিয়ে তিনি যখন বিশ্রাম নিতে গেলেন, তখন তাঁর দরজায় রোগীর আগমন সবে শুরু হয়েছে। এই প্রথম তাঁর চেম্বারের দরজা বন্ধ রইল রোগীদের জন্য। কম্পাউন্ডারবাবুরা জনে জনে তাঁর অসুস্থতার সংবাদ দিতে থাকল।

শেষ পাতা

Facebook Comments

পছন্দের বই