লেখক নয় , লেখাই মূলধন

অভিষেক ঝা’র গল্প

হারাম

চিত্র: রেনে ম্যাগরিত

বড়ো প্রার্থিত ঘন এক ব্যক্তিগততম ফিসফিস হয়ে বেরিয়ে এল, “আল্লাহ”। এইসব ইটপাথালি অবশ্য পাঁচ ছ’শ বছর ধরে হরেক ফিকিরের ফিসিফিস শুনে আসছে। তাই আলাদা করে তারা কান দিল না। নিজেদের ঝুরঝুরে হয়ে যাওয়া ফাঁকগুলোকে খানিক জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে দিয়ে সেই ফিসিফিসকে নিজেদের ভিতর নিয়ে নিল। একটা ইট সরিয়ে আল্লাকে এখন মীনা মুছে যাওয়া এককালের মীনা করা ইটগুলোর কোটরে রেখে, ইটটা আবার যথাস্থানে ঢুকিয়ে দিল সে। হাত ধুয়ে নিল। আল্লাকে যথাস্থান থেকে বার করে, গামছায় পেঁচিয়ে শিকলি খুলে স্নানঘর থেকে বেরিয়ে এল। মগরিবের আজানের জন্য গলা খাঁকারি দিতে শুরু করেছে তার বড়ো চাচা। বাড়ি লাগোয়া মসজিদ থেকে এখনই ভেসে আসবে বড়ো সুরেলা সে আজানের শেষটুকু। সেই আজানের সময় কয়েকটা ঘোড়াকে চড়ে বেড়াতে দেখছে সে, এখান থেকে কয়েক মাইল দূরে বয়ে চলা নদীর চরে। একফালি মিষ্টি কুমড়ার মতো চাঁদ যোগ হলে সেই দৃশ্যে আল্লা লুকিয়ে আছে আশেপাশে কোথাও বলে তার মনে হয়।
“আর্জিনা খাতুন, সেভেন ডি, রোল একশ পনেরো, হাইট পাঁচ এক, সাতান্ন কেজি। নেক্সট গোলাপী মোমিন আয়”, হাঁক দেয় পিটি ম্যাডাম। ডিপ ডিফেন্সে তার যে কোনো বিকল্প নাই এই ইস্কুলে সেটা তাকে পুরা মাস ধরে মনে করিয়ে দিয়েছে পিটি ম্যাডাম। এই একমাস জুড়ে সে শিখে নিয়েছে সাইড ট্যাকেলে বল থাকলেই যেতে পারে, কিন্তু পেছন থেকে ট্যাকেল একেবারেই না; পেনাল্টি বক্সে হাত পিছনে, জার্সি ধরে টানা যাবে না এখানে, আর এখানে বল পায়ে এলেই কিছু না ভেবে দুম করে উড়িয়ে দিতে হবে মাঝমাঠের দিকে, কর্ণারের সময় তাকে উঠতে হবে হেড নিতে, তারপর সড়পট মেরে নামতে হবে নীচে। তার মাথায় এত কথা একসাথে থাকে না। খাতায় লিখে দিয়েছে দিদিমণি। সে বারবার দেখে নেয় আর মাঠে নেমে পায়ে বল পেলে সব ভুলে গোল করতে উঠে যায়। “অই আর্জিনা নেমে আয়। মেরে মুখ ভেঙে দিব”, কানে আসে পিটি ম্যাডামের গলা।
গোটা মহকুমায় চারটা স্কুল পাওয়া গেছে যারা মেয়েদের ফুটবল দল নামাতে পারছে। তাই পুরা মাস জুড়ে হরসুন্দরী বালিকা বিদ্যালয়ে এই তোড়জোড়। জার্সি কেনা হয়েছে নতুন। মোজাগুলো রোজ রোদে শুকোচ্ছে। আর্জিনার পায়ে বল নিয়ে দৌড় এই প্রথম। তার আগে অবধি আর্জিনা খাতুন স্কুল স্পোর্টস, জোনাল স্পোর্টস, ব্লক স্পোর্টস আর ডিস্ট্রিক্ট স্পোর্টস জুড়ে একশ মিটার, দু’শো মিটার আর আটশ মিটার দৌড়ে আসছে সেই ক্লাস থ্রি থেকে। চোস্ত লেগিংস পড়ে আর্জিনার দৌড়কে অনেক দূর থেকে দেখলে লাল ফড়িঙের ইতলবিতল ছুট ঠেকে, উড়াল শেষে যেন দুলফি ফুলের মধু অপেক্ষা করছে ফড়িং আর্জিনার। অবশ্য এমনিতে খুব একটা মিষ্টি তাকে সারা বছর ঠেকে না হরসুন্দরী বালিকা বিদ্যাপীঠের ক্লাস ফাইভ থেকে ক্লাস এইট অবধি মেয়েদের। আর্জিনার হাতে কিল খায়নি এমন মেয়ে বড়ো দুর্লভ। আর্জিনা কারুর পাত থেকে মিড ডে মিলের বরাদ্দ ডিম তুলে খেয়ে নেয়নি, এমন পাতও বড়ো দুর্লভ। তবু আর্জিনা প্রশ্রয় পেয়ে যায় অই খেলাধূলা হেতু। আর এই মাস জুড়ে তো আলাদাই খাতির পাচ্ছে সে। যদিও তাতে এই গঞ্জের কিছুই এসে যায় না। বড়ো নির্লিপ্তভাবে এই জায়গা নিজেকে প্রায় একইরকম রেখে দিয়েছে এর পত্তনের দিন থেকে। সেই কবে থেকে ঘোড়ার গাড়ি করে জিনিস আসে আর যায় এখানে খালি।
আর্জিনা এখনও জানে না সেইসব কথা যা জানত তার বড়োদাদার বড়োদাদা। এ গঞ্জের থেকে মাইল খানেকের ভিতরেই আলতামাস গড়। পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে কালজানি। ঔরঙ্গজেব দিল্লীর মসনদের দখল নিতেই মীর জুমলাকে পাঠায় বাংলায় শাহ সুজাকে খতম করতে। জুমলা সুজাকে ঢাকা থেকে খ্যাদাই দিলে পুরা হারেম নিয়েই আরাকানের দিকে সুজা ভাগান দেয়। চাটগাঁ থেকে হাজার হাজার পালকি যখন আরাকানের দিকে এগোচ্ছে নফ নদীর ধার দিয়ে, জুমলার কোটাল আলতামাস ঝাঁপিয়ে পড়েন। অজস্র পালকির দখল নেয় আলতামাস। পালকির ভেতরের হারেমকন্যাদেরও। কোনো বাদশাহের যে নাচ না দেখলে, নর্তকীদের সাথে ধ্যাষ্টামি না করেও চলে যায় তা শুনে বিশ্বাস করতে না করতেই তারা সুলতানি মহলের নিশ্চিন্তের আশ্রয় ছাড়া হয়ে যায়। যারা নাচকে সবকিছু দেয় জীবন তাদের কাছে বাকি সব জানলা বন্ধ করে দেয়। সব জানলা বন্ধ মানুষগুলিকে নিয়ে চলে আসেন আলতামাস। ঔরঙ্গজেবের বড়ো নিকট কোটাল হয়ে উঠেছেন ততদিনে। বাদশাহের নিকটজন এবং যা যা বাদশাহ আর কোরান হারাম মনে করে সবকিছুতেই আসক্ত। এবং বাদশাহের ভয়ে ভরা দরবারে পেচ্ছাব করে ফেলতে পারেন এমন মানুষ। আসক্তি আর ভয় মিলে জন্ম নেয় আলতামাসের গড়। দরবার, কারাগার আর কোটালের প্রাসাদ ছাড়া বাকি সব সরকারি দালান মসজিদ এখানে। ফজর থেকে ঈশা অবধি মসজিদে ইনাম থাকেন। তারপর ইমানের সাথে তারা বিদায় নেন, আলতামাসের হাত থেকে নিজেদের গর্দান বাঁচাতে। ঈশা থেকে ফজর আলতামাস প্রহর। যে নর্তকীরা পুরা দিন বাড়িতে জানলা লাগিয়ে কলমা পড়ে গেছেন, তারা জীবনের অন্য জানলা খুলে দেন। বেজে ওঠে সুরমণ্ডলী। আলতামাস বরফ জলে চোবানো একটা ইলাইচিখাস আম বেতের ছুরিতে গেঁথে মুখে চালান করতে করতে বলে বসেন, “ইনশাল্লাহ! ভাগ্যিস ভগবান কার্তিক এমন যন্ত্র পৃথিবীতে ভুলে গিয়েছিলেন”। ফজরের সময় এগিয়ে এলে এই পৃথিবীকে ভুলতে শুরু করে আলতামাসের গড়। আরেকটু পরে গৌড়ীয় মীনা করা ইটগুলি আলো হয়ে আসবে। সবুজ, হলুদ, গেরুয়া, সাদারা সারাদিন ধরে ধর্মে ভিজবে। ঈশার অপেক্ষায়।

চোস্ত লেগিংস পড়ে আর্জিনার দৌড়কে অনেক দূর থেকে দেখলে লাল ফড়িঙের ইতলবিতল ছুট ঠেকে, উড়াল শেষে যেন দুলফি ফুলের মধু অপেক্ষা করছে ফড়িং আর্জিনার।

বাসে করে বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল আর্জিনার। বাস জুড়ে হাত পা ব্যথা নিয়ে মেয়ের দল আর হিপ হিপ হুররে। আর্জিনার বাঁ পায়ের থাই-এর উপরে এখনও টনটন। সিধা বুট খেয়েছে সেখানে। চারদিন পর ফাইনাল। সেরে যাবে একদম, পিটি দিদিমণি বলেছে। দিদিমণি পাশে এসে বসেছে। টনটনানির জায়গাটায় ঠান্ডা স্প্রে করে দিচ্ছে। কী আরাম আল্লাহ! জানলার বাইরে একটা মিষ্টিকুমড়ার ফালির মতো চাঁদ। কয়েকটা ঘোড়া চড়ছে নদীটার ধারে। ঘোড়া থেকে গঞ্জ ফেরতা গাড়িগুলান আলাদা হয়ে আছে সারাদিনের খাটনি শেষে।
“চাচা হে! শুনেছি এইসব মসজিদে বাঈজী নাচতো। ঘর বানাতে লেওয়া কি ঠিক হবে এইসব দালানের ইটে”, দোনামোনা করে প্রায় সবাই জিজ্ঞাসা করে। আলতামাসের এন্তেকাল হয়েছে দুই’শ বছর। ঔরঙ্গজেবের মরার এক যুগ আগেই। এই গড়ের এন্তেকাল প্রায় দেড়শ সন। তারপর অর্ধ শতাব্দী যথেষ্ট সাদা, গেরুয়া, হলুদ, সবুজ সব মীনাকে প্রাথমিক লালে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সেগুলোকে আবার হরেক রঙা সবুজের তলে নিয়ে যেতে বেশি সময় লাগে না ক্রান্তীয় বৃষ্টিদের। ঝুম করে সজারু চলে যায়। দিনের বেলায় শেয়াল বেড়ায়। লতাভরতি গম্বুজে রোদ পোহাতে থাকে একলা এক দুধ গোখরো। এইসব অতিক্রম করে মানুষ নামক দানো আসে। বাড়ি বানাবার লাগি ইট নিতে। শেয়াল ভাগায়। সাপ মারে। খরগোশ ঝলসে খায়, সারদিন ইট ভাঙার মাঝে। শাবল, গাঁইতি দিয়ে ঘোড়াগাড়িভরতি ইট নিয়ে যাওয়ার সময় তামাকু হাতে নিয়ে প্রায় সবাই জিগায়, “হারামের মসজিদের ইটের দালান কি হারাম?”
“এই হারামে তোমাকে পুরা দায়ী করা যায় না ঠিকই, কিন্তু হাফপ্যান্ট পরি তোমার ফুটবল খেলা ঠিক হয় নাই”, বড়ো চাচার গলা তাকে ত্রস্ত করে তুলছে। “তোমারে তো খেলাধূলায়, পড়াশুনায় বাধা দেওয়া হয় নাই। তুমি কি আরও সতর্ক হয়ে আদবের সাথে এগুলান করতে পারতা না?” —আর্জিনা চুপ। “তুমি কি জানো মৌলানা বাড়ির মেয়েদের আদব সহি না হলে সে হারামের দায়ে সে বাড়ির নামাজীদেরও আল্লাহ শাস্তি দেন?” —আর্জিনা চুপ। “তুমি আর খেলবা না ফুটবল, কাল তো রবি, আমি সোমে তোমার স্কুলে গিয়ে বলে আসব” —আর্জিনা চুপ। এইসব কথার ঠিক পনেরো মিনিট আগে মগরীবের নামাজ শেষে বড়ো চাচা ফোন খুলে ধরে আর্জিনার কাছে। তার চাচাতো দাদা সহেবুলের ফোন। শেখপুরার রিন্টু শেখ ফেসবুকের রকিং রিন্টু হয়ে আর্জিনার থাইয়ের ছবি দিয়েছে। মুখ কুঁকড়ে প্রায় নব্বই ডিগ্রিতে পা তুলে আছে সে, হাফপ্যান্ট গুটিয়ে স্প্রে করছে পিটি দিদিমণি। ছবির সাথে লেখা: “লেডিস লেগ— এনজয়”।
প্রয়োজন আর ফোকটে পাওয়া আলতামাসের গড়ের কাঁচামালে মন খচখচ করলেও একের পর এক দালান গড়ে ওঠে এই গঞ্জে। তারও কেটে গেল একশ বছর। কিছু ইট ঝুরঝুরে হয়ে গেল। কত ইটের উপর সিমেন্টের পলেস্তরা পড়ল। কিছু গোসলঘরের চোরাকুঠুরি তৈরি হয়ে থাকল।
খুব নরমেই নামে এ’সব সন্ধ্যা। খানিক দূরের জিভ বের করে নাগাড়ে লালা ঝরিয়েও এক চুরুক ঠাণ্ডা না পাওয়া কুকুরের দুপুর, বা, খানিক কাছের তিসির পিঠার পেটের ভাপ ছাড়া বিকেলের ফেলে যাওয়া খাতে যে তিশকিন রং লাগছে তা টের পায় মসজিদের পেছনের বাগানের এককোণে থাকা ধ্যারাশ লম্বা মেহেগনি গাছটার সবচেয়ে উপরে থেকে রোদতিক্ত হওয়া পাতাটা। মেহেগনি গাছটা এ বাগানের বাকিদের সাথে কী করে ইয়ারানা নেভায় তা ভাবলে খানিক গুড়ুম হতে হয় বটে। কাঁঠাল, কাঁচামিঠা, জাম, কুল, লখনা, খানিক দূরের পিতোনিয়া, কাগজি লেবু, খুব কাছের পেয়ারা, অতসী, ভোরবেলা সব ফুল চুরি হয়ে যাওয়া টগর, নিম, বৃহদাকার শিশু, বাতাবিলেবু, পেঁপে, সজনা, ল্যাটল্যাটে মাদার, এদের সঙ্গে মেহেগনিটা কেমন করে যেন একসাথে আছে সেই কবে থেকে। তার সরলবর্গীয় ঘ্যাম আজকাল এই আলফাল ক্রান্তীয়দের সাথে থাকতে থাকতে খানিক কমেও গেছে। আর্জিনার বিশ্বাস মেহেগনি গাছটার মাথায় চড়তে পারলে আলতামাস গড়ের অনেকটা দেখা যাবে। সামনে চিকচিকাবে কালজানি আর কালজানিতে সূর্য গোলা জল। সেটা পার করেই খেলতে গিয়েছিল সে। শুধু গোল আটকায়নি। দু’টা গোল করেও ছিল। চারপাশ থেকে সিঁটি পড়ছিল। এইসব ভেবে ভেবেই কেটে যাচ্ছে একটা রবিবার। আর সে বুঝতে পারছে তার আর ফাইনালে খেলা হবে না। কী আর করা? আর্জিনা সিধান্ত নিয়ে ফেলে।
বড়ো যত্ন করে মেশায় সরিষার তেল আর সাবান গোলা জল। মগরীবের নামাজ সেরে গোসলখানার পাশের কলতলায় খানিক বাদেই আসবে বড়ো চাচা। বড়ো যত্ন করে পিচ্ছিল হয়ে উঠছে কলতলা। এক শুদ্ধ নামাজীর পায়ের অপেক্ষায়। হারাম যখন হচ্ছেই পুরাই হারাম হোক। সহেবুল নামাজ পড়তে গেছে। বিছানায় তার মোবাইল। তুরতুরে পায়ে সেই মোবাইল হাতে আসে। গোসলঘরে ঢুকে যায় সে। আগেও এই কাজ করেছে সে বেশ কয়েকবার। এইবার আলাদা মজা আসছে। নামাজ শুরু হতে আর কতক্ষণ? জেড এঁকে খুলে ফেলে তালা। নামাজ শুরু হয়েছে। এইবার একে একে খুলে ফেলে নিজের সব পোষাক। ঠান্ডা মেঝেতে বসে পা ছড়িয়ে দেয় দু’দিকে। মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ। কী হারাম ঘটে চলেছে সেখানে! উফফ! আঙুল খুঁজে নিয়েছে তার প্রার্থিত স্থান। হে আল্লা তার হারামের শাস্তি যেন পায় তার বড়ো চাচা।
বড়ো প্রার্থিত ঘন এক ব্যক্তিগততম ফিসফিস হয়ে বেরিয়ে এল, “আল্লাহ”।

Facebook Comments

পছন্দের বই