লেখক নয় , লেখাই মূলধন

অরিন্দম রায়ের গল্প

হতে পারত একটি ভূত
কিংবা একটা বাঞ্চোৎ-এর কাহিনি

শ্রমজীবী সূর্যটা প্রাত্যহিক দহনে বড়ো অবসন্ন এখন। এক পরিযায়ী শ্রমিকের মতো সে এলিয়ে পড়ছে ক্রমশ পৃথিবীর পশ্চিম কোলে। এদিকে গা ঘেঁষা-ঘেষি করে উঠে যাওয়া বাড়ির শরীরগুলো চুঁইয়ে সোনালি রোদের ছায়া একটু তেরচা হয়ে পড়েছে রাস্তায়, গ্রিলের ফাঁক গলে মেঝেয়। রূপকথার মোড়কে মোড়া এই নরম রোদের স্পর্শে দেহগত প্রেম জাগতে পারে মনে। জাগতেই পারে আদিম কয়েকটি প্রবৃত্তি। অদ্ভুত মনে হতে পারে কিন্তু এটা সত্যি যে, নাগরিক ঈড়া-পিঙ্গলাসর্বস্ব গলিগুলো শুনশান এখন। কুকুরগুলো পর্যন্ত ল্যাজ নামিয়ে একপ্রকার লজ্জা সম্বরণ করে চেয়ে আছে গলির মধ্যে, একদৃষ্টে। নীরব। অথচ বাইরের লোক দেখে বাঙালি খেদাও গোত্রীয় চিল্লা-মেল্লি করাটাই তো দস্তুর ছিল। কিন্তু ওরা তা করে না। করতে পারে না। কারণ, হয়তো তা করা যায় না। এ-পাড়ার কেলো, ভুলো ও তাদের কমপ্রোমাইজড স্ত্রীরা ও স্ত্রীর সন্তানেরা জান-ইজ্জত বাঁচিয়ে দূর-দ্রষ্টার ভূমিকা নেয়। ওরা সত্য ও ন্যায়ের মতো সব বোঝে, কিন্তু চিল্লায় না। কারণ, ওরা প্রয়োজনে সহনশীল হতে বুঝেছে। তো নিরাপদ একটা দূরত্ব থেকে মোটামুটি ১৫-১৯ ডেসিমেল কম্পনে স্বগতোক্তি করে চলে তারা। মূল শহর থেকে বেশ কিছু দূরে এই এলাকা। অল্প আগে পাড়া জুড়ে চোঙে করে হেঁকে বলা হয়েছে এই ঘণ্টাখানেক লক ডাউনটির ব্যাপারে। কারণ নাকি বেশ গুরুতর! মারণাস্ত্র নিয়ে সাজো সাজো রবও পড়ে গেছে। এদিকে বাচ্চুর বাড়ির সামনে গোটা দুই স্করপিও দাঁড়িয়ে আছে নিকষ কালো। কয়েকজন মাসলম্যান বন্দুক হাতে প্রস্তুত। তবে দেখে মনে হচ্ছে শিকারকে জ্যান্ত ধরার মতলবে আছে। এমন ঘনঘোর মুহূর্তে এক মাসলম্যানের কাঁধে আর বন্দুকে কিছুটা পাখির মল এসে পড়তে ও লক্ষ করে, কারো ছাদে বসানো ডিস-এ্যান্টানায় একটা ডাগর, নরম বৌদি-মাংসের পায়রা ঝপ করে বসে হাঁপাচ্ছে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার উড়ান দিল সে। ততক্ষণে তার রেটিনার পর্দায় ফুটে উঠেছে, পায়রার পিছনে যমের মতো এগিয়ে আসছে একটা কুচকুচে কাক। চু-কিত্-কিত্ খেলছ? নাকি চোর-পুলিশ খেলছ কা-কা?

“এই শ্লা বাচ্চু, বেরিয়ে আয় শালা… চারদিকে লোক আছে আমার। পাঁইতাড়া করলে না, খুলি উড়িয়ে দোবো বাঁড়া”

দোতলার ঘরের মরচে পরা কব্জার ফাঁক দিয়ে নিচটা দেখছিল বাচ্চু। পালাবার পথ যে নেই সেটা বুঝে গেছে স্পষ্ট। বাচ্চু জানে চারপাশের মাগ-ভাতার মিলে জানালা, দরজার ফুঁকো দিয়ে ঠিক শালা বলিউডি সিন দেখছে। ঢ্যামনার দল। পাবলিক মানেই শালা ঢ্যামনা, কৃতঘ্ন।

জানালা থেকে সরে এল বাচ্চু। পা কাঁপছে। এক বিশাল বড়ো জলপ্রপাতকে যেন আঁটকে রেখেছে ও শরীরে। যে-কোনো মুহূর্তে হুড়মুড়িয়ে আসতে পারে অশ্রুবান। কিছুটা বেসামাল হয়ে ঘরে ঢুকল। আবছা আঁধার করে আছে ঘর। এক কোণে মেয়েটা চেয়ারে বাঁধা। ছটফট করছে। কেঁদে কেঁদে চোখ লাল তার। ফর্সা গালও লাল। হাতের কব্জিও লাল। কারণ, দড়িটা মোটামুটি শক্ত করেই বাঁধা হয়েছে। মুখ কাপড়ে জড়ানো। বয়স কত হবে?— এই সতেরোর মতো। সেটা বাচ্চু সঠিক বলতে পারবে। ছিপছিপে গড়ন। শরীরের গঠনে পুরুষ টানার ক্ষমতা আছে। কে যে শালা খবর দিল— বাচ্চু ভাবে। বাচ্চু এগিয়ে যায়। মেয়েটার নরম গালে, কপালে হাত বোলাতে থাকে। যেন সবটুকু স্পর্শ নিয়ে যেতে চায় ও, পৃথিবীর ওপারের জগতে। জলে ফাঁপা নরম কিসমিস-গালে হাত বুলায় বাচ্চু। অঞ্জলি ভরে নিতে চায়ল অশ্রু। ওর খটখটে আঙুল যেন ঝরনার জল ছুঁলো। এদিকে মেয়েটা ছটফট করছে। আপ্রাণ চেষ্টা করছে মুক্ত হবার। অঝোরে কাঁদছে। কিছু বলতে চায়। কিন্তু বাচ্চু শুনতে চায় না। মেয়েটার কপালে একটা চুমু খেল বাচ্চু। পা কাঁপে। ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে হাঁটু মুড়ে বসে বাচ্চু মেয়েটার সামনে। তারপর মুখ গুঁজে দেয় থাইয়ে। বাচ্চুর শরীর কান্নার বেগে বারবার কেঁপে ওঠে কেবল। সংলাপ নেই। কী বলতে চায় বাচ্চু? ‘আমায় ক্ষমা কর’? ‘আমি দায়ী তোর এ অবস্থার জন্য’? ‘আমি যথার্থ বাবা হতে পারিনি মা!’… এ-সব? কিন্তু কৃতকর্মের জন্য, ও কি ক্ষমার যোগ্য?

“এই শালা শুয়োরের বাচ্চা… বেরোবি? নাকি ঢুকব…”

চমকে ওঠে বাচ্চু। বোঝে সময় নেই এতটুকু। দ্রুত চোখের জল উলটো চেটোয় মুছে পকেট থেকে রিভালবারটা বের করে। মেয়েটার কান বরাবর যন্ত্রটা ঠেকায় ও। মেয়েকে ওদের হাতে পড়তে দিলে হবে না। মেয়েটার চোখ বন্ধ। জলের ধারা মুখের কাপড় স্যাঁতস্যাঁতে করেছে, করছে। অসহায় সে। ট্রিগারে আঙুল বাচ্চুর।… এমন সময়! আচমকা! পাশের ঘরে জলের গেলাস মেঝেয় পড়ার আওয়াজ হল! চকিতে বাচ্চু উঠে দাঁড়ায়। দ্রুত পদে, সে ঘরে ঢোকে বাচ্চু।

বাচ্চুর বউ মানে নীলু মানে নীলিমা থান্দার ছটফট করছে খাটে। ওর পক্ষাঘাতগ্রস্ত পা দুটো কাঁপছে। বাচ্চু বিছানায় বসল। নীলু এখনও কত সুন্দর মনে হল বাচ্চুর। ধবধবে গায়ের রং। নাকি মরতে হবে এ-কথা স্থির জেনে বাচ্চু খামচে ধরতে চায়ছে সম্পর্কগুলো? অল্পক্ষণ নীলুর মুখে চেয়ে থাকল বাচ্চু। দু-জনের চোখেই জলের ধারা। নীলুর যন্ত্রণা অধিক। কারণ, প্রায় রাতে বাচ্চু মৃত্যু ভয়ের কথা শোনাত তার বউকে। নীলু শুনত কেবল। যন্ত্রণায় মুচড়ে যেত। কিন্তু একটি শব্দ, একটু মাথায় বিলি কেটে দেবার মতো কোনো সান্ত্বনা দিতে পারে না নীলু। নীলুর বুকে বাচ্চু মুখ লুকায় অপরাধী শিশুর মতো। কাঁদতে থাকে হাউ হাউ করে। যেন খেলনা না পেয়ে কাঁদতে বসা এক শিশু। নীলুর কাছেও তো তার কত ক্ষমা চাওয়ার আছে। কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎ মুখ তুলে স্থির, শক্ত হয়ে বসে বাচ্চু। তারপর, আচমকা নীলুকে বুঝতে না দিয়ে ওর ঠোঁটে কামড় বসায়… নিবিড় চুম্বনে, অধর দংশনে নীলুর প্রায় দমবন্ধ হবার জো! হাত দিয়ে নিজের মতো চাদর খামচে ধরছে। কিছুপর বাচ্চু ক্লান্ত হয়… উঠে দাঁড়ায়। বিছানাগত এই মানুষটির বাচ্চু ছাড়া আর কেউ নেই। তাকে খাওয়ানো, পরানো, ধোয়ানো সব বাচ্চুই করে চলেছে। নিজের অসহায় সন্তানের মতো নীলুকে পরিচ্ছন্ন রেখেছে ও। বাচ্চুর না থাকা মানে নীলুর পচে পচে মরা। পায়খানা, পেচ্ছাপে পড়ে নীলু। তার সারা গায়ে বেডসোর। সাদা সাদা পোঁকা কামড়াচ্ছে, রস শুঁষে নিচ্ছে। আর বোবা নীলু ছটফট করছে মৃত্যুর জন্য… নাহ! এ দৃশ্য বাচ্চুর আত্মাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাবে। কখনোই তা হতে দেওয়া যায় না।

“কীবে… কথা কানে যাচ্চে না…”

ছেলেবেলায় রচনা লিখে দশে সাড়ে তিন পাওয়া বাচ্চু বুঝছে সময়ের মূল্য… বাচ্চু চট করে রিভালবার ঠেকায় নীলুর কপালে। ট্রিগারে আঙুল।… এমন সময়, ও-ঘরে চেয়ার উলটে পড়ার শব্দ! হুড়মুড়িয়ে দৌড়ে এল বাচ্চু। যাক! ওরা নয়। ধরা পড়লে কী যে হবে! বাচ্চু ভীষণ অসহায় বোধ করে। দেয়ালে ঘুঁষি মারে। তারপর এগিয়ে এসে আলতো করে চেয়ার তোলে।

“এই খানকি…”

এবার? আর কতক্ষণ? স্থির সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় ক্রুদ্ধ হয়, অসহায় হয়ে পড়ে বাচ্চু। পাশায় হেরে যাওয়া সেই রাজপুত্রের মতো হাঁফিয়ে ওঠে। নিজের উপর বড় বিরক্তও। শেষে নিজের মুখে ব্রহ্মতালু বরাবর যন্ত্রের নলটা ঢুকিয়ে দেয়। নিস্তব্ধতা। কিন্তু নিজে মরলেই কী সব সমাধান? বউ, মেয়ের কী হবে? ওরা কী করবে দু-জনের সঙ্গে? মরে যাওয়াটা বড়ো কথা নয়, কীভাবে ও কেমন করে মরলে মরার পরও দায়িত্ব নিতে পারবে পরিবারের? এসব ভাবে ও… এদিকে ওরা বোধহয় বিড়াল পায়ে দোতলায় উঠে আসছে… অথবা ছাদ থেকে নীচে… আর সেকেন্ডের কাঁটাটা একটু অধিক সময় নিয়ে কলুর বলদের মতো ঘুরে ঘুরে মরছে বলে মনে হয় বাচ্চুর। তিনটে মানুষ, রিভালভারে দুটো গুলি। কার কার মৃত্যু এ মুহূর্তে হওয়া দরকার… শ্বাপদের দল কী ভীষণ টরচার করতে পারে সে-কথা বাচ্চু জানে। বড়ো নৃশংস ওরা… পঙ্গু স্ত্রী, অষ্টাদশী মেয়ে, নাকি ও… বাচ্চু ভাবতে থাকে… কার কার মৃত্যু বাঁচিয়ে দেবে সেই মানুষটিকে অকথ্য যন্ত্রণার থেকে… মৃত্যু যেন বিশল্যকরণী… ভাবতে থাকে বাচ্চু। নিজের ভূতকে সংশয়মান অতীত বা পুরাঘটিত ভবিষতে পাঠায়… তোলন যন্ত্রে নিক্তি নিক্তি করে মাপতে থাকে কার যন্ত্রণা অধিক… কল্পনার পর্দায় আবছা থেকে ক্রমশ স্পষ্টতর হয়ে ওঠে চলমান কতকগুলো ছায়াশরীর… তপস্বীর মতো দেওয়ালে পিঠ ঘষটে বসে বাচ্চু। ভাবতে থাকে…

ঘরের মেঝে রক্তে ভেসে যাচ্ছে। বাচ্চু পড়ে মেঝেয় চিৎ হয়ে। থকথকে ঘিলু ছিটকে আছে। রক্ত-ঘিলুর উপর ভারী বুটের ছাপ পড়ছে। এ-ঘর থেকে ও-ঘর হেঁটে ফিরছে কতকগুলো পা। একটা হোঁৎকা মতন বিশ্রী লোক। মুখে সিগারেট। এগিয়ে এসে বসল চেয়ার নিয়ে। বাচ্চুর দিকে ঘৃণিত চোখে একবার দেখেই বলল—

“এই… এ মাগিটাকে বসা”

“বাবু এ তো পঙ্গু!”

“বলিস কী? পঙ্গু?! বালটা তবে কী মধু পেত? কী মারাত?”

“হাঃ হাঃ হাঃ হা…” [‘মার্ডার টু’ শুরু হওয়ার আগে হলে সমবেত জাতীয় সংগীত গাওয়া যেন। এক অভ্যস্থ টোনে…]

“তবে সায়াটা তোল। দেখি দু-পা কোনখান থেকে অসাড়”

“খিক্ খিক্’ [কিছু থুতু ছিটকে এসে পড়ে মানুষের ঠান্ডা ঘিলুর উপর]

এরপর বিছানায় নীলুকে জোর করে বসানো হয়।

“এই…ই! বল তোর ভাতার কী করত জানিস?”

নীলু তার বেঁকে যাওয়া ঠোঁট নেড়ে কিছু বলতে চায়ল। একটু লালা ঝরে পড়ল কেবল ব্লাউজে।

“বল শালি” হোঁৎকাটা জোর থাপ্পড় কসাল নীলুর গালে। জোর ঝাঁকিয়ে দিল কাঁধ ধরে। “জিনা হারাম করে দিয়েছিল তোর বর”…

“এ্যাই! এ কীরে! মাগিতো ভয়ে মুতে দিল” আঁতকে উঠল হোঁৎকাটা।

“ইহঃ!” [নাক সিঁটকে দিল কেউ, কেউ থু থু ফেলল বাচ্চুর উপর]

— এসবই দেখছিল বাচ্চুর ভূত। যে এই জাস্ট বেরিয়ে এসেছে শরীর ছেড়ে। নিজেকে আর মেয়েকে মেরেছে সে। ভূতটার কষ্ট হল! এতদিন নীলুকে শিশুর মতো আগলে রেখেছে ও। ওহ, সরি! রেখেছিল। সেদিনটা মনে পড়ে। মার্কেট থেকে শপিং করে ফেরার পথে একটা ডাম্পার এসে ঠুকে দিল গাড়িতে। বাচ্চু অজ্ঞান। নার্সিংহোমে জ্ঞান ফিরেছিল। তারপর আরও একমাস পর ছাড়া পেয়েছিল। জানতে পেরেছিল নীলুর নষ্ট পায়ের কথা। ভূতটা আর মনে করতে চায়ল না সে-সব কান্নার দিন-রাতের কথা। তবুও কয়েক টুকরো স্মৃতি তো ভেসে আসে শরৎ মেঘের মতো। বাচ্চুর ভূতেরও মনে এল। যেমন… বাবা-মায়ের আপত্তি। পঙ্গু মেয়েকে বিয়ে করা যাবে না। যতই লিভইনে থাকুক। সেজন্য বাচ্চুর নাকি কোনো লিগ্যালি দায়বদ্ধতা থাকার কথা নয় বলেছিলেন বাচ্চুর আইনজ্ঞ বাবা। ওসব নাকি হাল ফ্যাশানের মাদকতা। তারপর ধরুন… সেই রাত্রির কথা। যে-রাত্রে নীলু বারবার গোঙাচ্ছিল। ওর কপাল গরম। চোখে জল টল টল। বাচ্চুর মনে হয়েছিল নীলু যেন বলতে চায়ছে ও মরতে চায়। এভাবে টিকে থাকতে চায় না ও। বাচ্চু কেঁদেছিল খুব। তাদের কত ছোট্ট ছোট্ট স্বপ্নকে বাচ্চু রোজ মরে যেতে দেখত। টিকটিকিতে নরম শরীরের বাদলা পোঁকা ধরার পর যেমন তার ডানাগুলো ভেসে ভেসে পড়ে নীচে, ঠিক তেমন। সে-রাতে নীলুকে কিছুটা আদর আর স্নেহ দিতে গিয়ে বাচ্চু সঙ্গম করে ফেলেছিল। নীলুর শরীর নিয়ে ও যা খুশিই তাইই করতে পারত তখন। করতোও। কিন্তু পরে পরে পায়খানা, পেচ্ছাপ এ-সব ফেলতে হত বলেই হয়তো সেক্স জাগত না। বাচ্চু অন্য শরীর খুঁজত। ক্ষমা চাওয়ার ছিল বাচ্চুর…

শেষ পাতা

Facebook Comments

পছন্দের বই