লেখক নয় , লেখাই মূলধন

চমক মজুমদারের গল্প

ওই লোকটা মানস নয়

অফিস থেকে বাড়ি ফিরে জুতো খুলতে খুলতে বাড়ির পরিবেশটা বোঝার চেষ্টা করে মানস সরকার। অচেনা লাগে। অন্যান্য দিন বেল বাজলে দরজা খুলে ওর কাঁধের অফিসের ব্যাগটা নিয়ে নেয় স্ত্রী শুক্লা। আজ শুধু দরজা খুলে চলে গেল শুক্লা। ব্যাপারটা সামান্য হলেও অভ্যাসের ব্যতিক্রম বড়ো চোখে লাগে। জুতো খুলতে খুলতে মনের ভেতরের খটকার সাথে যুদ্ধ চলে মানসের। অন্যান্য দিন দরজা খুলতেই ঘরের প্রাণস্পন্দন বুকের উপর কেমন ঝাঁপিয়ে পড়ে। আজ শূন্যতা। ঘরে ঢুকে ব্যাগটা রেখে জামার বোতামগুলো খুলে ফ্যানের সুইচে চাপ দিল ও। শরীর এলিয়ে দিল সোফায়। শুক্লা এসে জলের বোতল ধরিয়ে চলে গেল রান্নাঘরে। অন্যান্য দিন ফ্যান নিজে চালাতে হয় না। শুক্লা গ্লাসে জল এনে পাশে বসে। ফ্যানের হাওয়ায় গায়ের ঘাম শুকোতে শুকোতে সারাদিনের গল্প বলে মানস। মেয়ে পাশের ঘর থেকে আসে, টিভি চলে। আজ টিভিটাও চলছে না। অবস্থার গভীরতা বুঝতে চায় মানস। কিন্তু কোনো তল খুঁজে পায় না। একবার গলা ছেড়ে ডাক পারে। শুক্লার সাড়া পাওয়া যায় না। নিজের ভিতরের অস্থিরতা বাড়ে মানসের। তবু অভ্যাস বশে ও ওঠে, পোশাক খোলে, স্নানের জন্য বাথরুমে ঢোকে।

শুক্লার এই চুপচাপ হয়ে যাওয়াটা ঝড়ের পূর্বাভাস মানস জানে। এর কারণ খুঁজতে মনে মনে তোলপাড় করে ও। কিন্তু কিছুতেই কিছু বুঝে উঠতে পারে না। বাথরুমে শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়ে ভিজতে ভিজতে কারণ হাতড়াতে থাকে মানস। সকালের বাজার থেকে কি পচা মাছ এনেছিল? না না, তা তো হয়নি। তবে কি ইলেকট্রিক বিল জমা দেওয়া হল না? ধুস এ মাসে তো বিল আসার কথাই নয়। মাসকাবারির মালে কি কিছু মিস করে গেলেন? ভাবতে থাকেন মানস। শাওয়ার থেকে জল নেমে ভিজিয়ে দেয় শরীর। কেবলের রিচার্জ, খবর কাগজের বিল, মেয়ের টিউশনির টাকা— ক্যোয়ারী ঘুরতে ফিরতে থাকে। উত্তর অধরাই। তবে কি অফিস থেকে কেউ কাঠিবাজি করল! ইদানীং অফিসে ছেলে-ছোকরাগুলো খুব পেছনে লাগছে। আসলে মানসের পাশেই বসেন পূরবী। কয়েকমাস হল ট্রান্সফার হয়ে এই অফিসে এসেছেন। প্রথম থেকেই খুব মানসদা মানসদা করেন। কমবয়সী স্টাফরা এ-সব দেখে টিটকিরি কাটতে ছাড়ে না। শুক্লাকে এর আগেও পূরবীর কথা বলেছেন। হাবেভাবে মনে হয়নি ব্যাপারটা শুক্লার পছন্দ হয়েছে। তারপর থেকে শুক্লাকে পূরবীর কথা এড়িয়েই চলে মানস। অফিসের কেউ কি মজার ছলে শুক্লাকে কিছু বলল? গায়ে সাবান মাখতে মাখতে অস্থির হয়ে উঠল মানস। গায়ে জল ঢালতে ঢালতে মনে হল অফিসের কেউ এমনটি করবে না। তাছাড়া কারোর কাছে তো শুক্লার ফোন নাম্বার নেই। অস্বস্তিটা কিন্তু রয়েই গেল। অজানা আশঙ্কার মেঘ চারপাশে ঘুরে বেড়াতে লাগল। গামছা দিয়ে গা মুছতে মুছতে মনে হল পিংকির কথা। কয়েক দিন ধরেই শুক্লা একান্তে মেয়ে পিংকির সম্পর্কে কিছু বলতে চাইছে। ওইসব ইঙ্গিত মানস বোঝে। মেয়ে বড়ো হয়েছে, কলেজে পড়ছে— এই বয়সে প্রেম ভালোবাসা হতেই পারে। পাত্তা দেয়নি মানস। শুক্লা হয়তো এতদিন যে-ব্যাপারটা আঁচ করছিল, আজ তার পর্দা উঠেছে। সেই নিয়েই হয়তো মা-মেয়ের দ্বন্দ্ব। তাই মেয়ে নিজের ঘর থেকে বের হয়নি আজ। সেটাই হবে— দৃঢ়চিত্ত হল মানস। বাথরুম থেকে বের হতে হতে মানস ভাবতে থাকেন, এবার ওর ভূমিকা কী হবে! ও নিশ্চিত, শুক্লা ওর দিকে অভিযোগ আনবেই— তুমি নজর দিলে মেয়েটা এভাবে বকে যেত না। কীভাবে হ্যান্ডেল করবেন সিচ্যুয়েশন ভাবতে ভাবতেই বন্ধ টিভিটা চালিয়ে হাঁক দিলেন— কই গো চা-টা দাও। অন্যদিন এই আওয়াজ দিতেই হয় না।

চিত্র: মাতিস

টিভিতে বাংলা সিরিয়াল দেখে মানস। একা নয়, এই সময়টা পিংকি আর শুক্লা এসেও বসে। চা খাওয়া চলতে থাকে, আড্ডা গল্প চলে। খবর খুব একটা দেখে না মানস। একই খবরের চর্বিতচর্বন। আর সন্ধে হলেই স্টুডিও জুড়ে খালি ঝগড়া। বিরক্ত লাগে, বরং খেলা থাকলে স্পোর্টস চ্যানেল খোলে ও। চায়ের কাপটা হাতে ধরিয়ে চলে গেল শুক্লা। মনের অস্বস্তিটা আরও বেড়ে গেল মানসের। ঝড়ের আসব আসব অবস্থাটাই সব চেয়ে শঙ্কার। একবার চলে এলে তার দাপটের সাথে লড়াই করা যায়। কিন্তু না আসলে সে অচেনাই থেকে যায়।

— আরে কী হল। এসো, বসো। ঝড়কে একেবারে স্বাগত জানালো মানস। শুক্লা এসে পাশের সোফায় বসল। কিন্তু কথা বলল না। অস্বস্তিটা আরও বাড়তে থাকে মানসের।
— আরে কী হয়েছে? কথা বলছ না কেন? অস্বস্তিটা এবার ফুটে ওঠে মানসের চোখে মুখে।

শুক্লা মাথা নীচু করে বসে থাকে। এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে চোখ থেকে। মানস বুঝতে পারে সমস্যা গুরুতর। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে পিংকি ততক্ষণে সোফার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। আসল কালপ্রিটকে পেয়ে যেন হাঁফ ছাড়ে মানস। মেয়ের দিকে তাকিয়ে গলাটা একটু কড়া করেই বলে— কী করেছিস মায়ের সাথে? কী হয়েছে?
— আজ তুমি দমদমে কী করছিলে?
না পিঙ্কি নয়। বাবার প্রশ্নের উত্তর পিংকি দেওয়ার আগেই মানসকে প্রশ্নটা ছুড়ে দেয় শুক্লা।
প্রশ্নটা শুনে থতমত খেয়ে যায় মানস। তোতলাতে থাকে, কোথায়— কো… কোথায়? দমদম? আমি?

জিজ্ঞাসাটা হয়তো একটু বেশিই সরাসরি হয়ে গিয়েছিল। একটু সামলে নেয় শুক্লা। মুখ তুলে মানসের চোখে চোখ রাখে। শুক্লার চোখ তখনও জলে টলটলে।
— আজ কি তুমি দমদম মেট্রো স্টেশনে গিয়েছিলে?

মানসের অফিস ডালহৌসির অফিস পাড়ায়। ছুটির পর বাস ধরে হাওড়া স্টেশন। সেখান থেকে ট্রেনে মফস্‌সলের এই বাড়িতে ফেরা। দমদম যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তাছাড়া ওদিকে অফিসের কোনো কাজ থাকে না। বছর তিনেক আগে এক কলিগের বোনের বিয়ে খেতে গিয়েছিল দল বেঁধে বারাসাত। তখন একবার দমদম পর্যন্ত মেট্রোতে গিয়ে ট্রেন ধরতে হয়েছিল। কিন্তু আজ কেন দমদমের প্রসঙ্গ আসছে বুঝে পায় না মানস।
— না। না… তো। দমদম যাইনি। কেন?
— সত্যি বলছ তো? এবার প্রশ্ন করে উঠে পিংকি। ওর চোখও ছলছল করছে।

অবাক হয়ে যায় মানস। কাছের মানুষগুলোর কাছে নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা কেমন ঝড়ের সামনে খড়কুটোর মতো উড়ে যেতে দেখে। পুরো বিষয়টা আরও অন্ধকার, আরও জটিল মনে হতে থাকে ওর। নিজের আত্মবিশ্বাসও কেমন নড়বড়ে হয়ে ওঠে। কথা জড়িয়ে যায়।
— দমদম যাব কেন? ওখানে কী আছে?

শুক্লা ও পিংকি কিছু বলার আগেই বাড়ির বাইরে একটা হট্টগোলের শব্দ। কিছুটা হতবাকই হয়ে পড়ে ঘরের তিনটি প্রাণী। এমন হইহই শব্দ বড়ো বেমানান। বাড়ির বাইরের জানলাটা খুলে উঁকি মারল তিনজন। পাঁচিলের বাইরে একটা জটলা। হাবেভাবে এলাকার ছেলে বলে মনে হল না। জটলাটা থেকে আওয়াজ উঠছে— দাদুর শাস্তি চাই। পিংকি মানসের বাজুটা শক্ত করে চেপে ধরে। জটলার আওয়াজটা ঘনঘন উঠছে, গমগম করছে। মধ্যবিত্ত পাড়াটার অন্যান্য বাড়ির অনেকেই জানলা খুলে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছে। মানসও কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না ব্যাপারটা। বয়স যদিও পঞ্চান্ন ছুঁইছুঁই, মাথাতেও সাদা চুলের সংখ্যা যথেষ্ট, সম্পর্কেও এতদিনে দাদু হয়ে গেছেন— গত বছর পিসতুতো দাদার ছেলের মেয়ে জন্মেছে; তবু রাস্তাঘাটে মানসকে কেউ দাদু বলে ডাকে না, দাদা-ই বলে। ভিড়ের আওয়াজটা বাড়তে থাকে। ‘দাদু, দাদু’ বলে ডাকাডাকি শুরু হয়। উত্তেজনা বাড়তে থাকলে গালিগালাজও শুরু হয়। মানস এবার পরিষ্কার বুঝতে পারে— বিশেষণগুলো ওরই উদ্দেশ্যে। পিংকি ওকে জানলা থেকে সরিয়ে আনে। এমন সময় হঠাৎই একটা আস্ত ইট এসে পড়ে জানলায়। ঝনঝন করে ভেঙে যায় কাচ।

ক্রমশ গুটিয়ে যায় পরিবারটা। মানসের শরীর খারাপ লাগতে শুরু করে। সোফায় এলিয়ে দেয় শরীর। শুক্লা-পিংকি হতভম্ব হয়ে পড়ে। পরামর্শ করে ফোন করে এলাকার কাউন্সিলর সৌমিত্রবাবুকে। আশ্বাস পাওয়া যায় সাহায্যের। বাইরের হট্টগোল এখনও শোনা যাচ্ছে। পিংকি এসে বসে বাবার পাশে। মানস কিছুই বুঝে উঠতে পারেন না। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকেন মেয়ের দিকে। পাশে শুক্লা এসে বসে।

— এ-সব কী হচ্ছে? অবাক হয়ে প্রশ্ন করে মানস।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পিংকি সবটুকু জানায়। আজ দুপুরে মেট্রোতে এক যুগলকে ঘনিষ্ঠভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আপত্তি তোলেন কিছু যাত্রী। তারপর কথা কাটাকাটি। দমদমে ট্রেন থামলে সেই যাত্রীরা যুগলকে ধরে পেটায়।
— কিন্তু তাতে আমার কী? বিরক্ত হয় মানস।

স্টেশনের সিসিটিভিতে ধরা পড়ে ঘটনাটা। নিজের মোবাইলটা চালু করতে করতে বলে পিংকি। আর সেই ক্লিপিংস্‌ জুম করে পাওয়া গেছে কিছু ছবি।
চোখের সামনে মোবাইলে ছবিটা দেখে চমকে ওঠেন মানস। অস্পষ্ট— কিন্তু অবিকল মানস সরকার।

— কিন্তু শুক্লা বিশ্বাস করো, এটা আমি নই। আমি আজকে দমদম যাইনি। চেঁচিয়ে ওঠে মানস। কিন্তু গলায় চেনা আত্মবিশ্বাসের অভাব। শুক্লা ওর কাঁধে হাত রাখে। ‘বিকেল থেকে মেয়েটার কী অবস্থা! ও বিশ্বাস করে ওই লোকটা ওর বাবা নয়। আমিও…’ আঁচল দিয়ে চোখটা মোছে শুক্লা।

মানসের স্মার্ট ফোন আছে। মেয়ের আবদারেই কিনেছিল। ফেসবুক, হোয়াটস্‌অ্যাপ অ্যাকাউন্টও আছে। কিন্তু মানস সে-সব ব্যবহারে সড়গড় নয়। ছয় মাসে ন-মাসে একবার এ-সব খোলেন। খুললে জানতে পারতেন কীভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রোলড হয়ে গেছে ও। পিংকি ফেসবুক করে, ব্যাপারটা জানতে পেরেছে। শুধু জানতে পারাই নয়, সোশ্যাল মিডিয়ায় তীব্রভাবে আক্রান্তও হয়েছে ও।

মেয়ের মোবাইলে ছবিটার দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে ছিল মানস। বিড়বিড় করে শুধু বলছিল, ‘ওই লোকটি মানস নয়।’ এমন সময় ডোরবেল বাজল। সচকিত হয়ে উঠল সবাই। বাইরের গোলযোগটা শোনা যাচ্ছে না। আবার বাজল ডোরবেল। শঙ্কিত হয়ে পড়ল গোটা পরিবার।
— কে? গলা দিয়ে যেন স্বর বের হয় না শুক্লার।
— আমি সৌমিত্র, বউদি। দরজা খুলুন।
আশ্বস্ত হয়ে দরজা খোলে শুক্লা।
— ওদের এখান থেকে সরিয়ে দিয়েছি। বিক্ষোভরত দলটার দিকে ইঙ্গিত করে এলাকার কাউন্সিলর সৌমিত্র। ‘আমার মনে হয় থানাতে একটা কমপ্লেন করা উচিত। আর আপনাকেও বলিহারি, এই বয়সে হাঙ্গামা করতে যান কেন?’
— তুমি আমাকে অবিশ্বাস করছ সৌমিত্র? ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে মানস। ‘তুমি তো আমায় এতদিন ধরে চেনো। আমি কি এমন কাজ করব বলে মনে হয়?’ অপ্রস্তুত পড়ে যান কাউন্সিলর।
— দেখো, ছবিতে এই লোকটার কাঁধে শান্তিনিকেতনী ঝোলা, পাঞ্জাবি পরা। অথচ আমি তো আজ অফিস গেছি শার্ট প্যান্ট পড়েই। আমি তো শান্তিনিকেতনি ব্যাগ ব্যবহারই করি না, আমি তো কাঁধে অফিস ব্যাগ নিই। তাছাড়া আমার সব চুল এমন পাকা নয়। ছবির মতো দাঁত খিঁচিয়ে থাকলে কি আমায় এমন লাগে, দেখো দেখো। দাঁত খিঁচিয়ে দেখায় মানস।
— চলুন, আগে থানাতে ঘুরে আসি। নিজেকে গুছিয়ে নেন কাউন্সিলর। রেডি হয়ে নিন বউদি।
থানার উদ্দেশ্যে বের হওয়ার আগেই শুক্লার ফোনে কল আসে ওর দাদার।
— কিরে এ-সব কী শুনছি মানসের নামে?
— না দাদা। বিষয়টা আসলে গুলিয়ে যাচ্ছে। শুক্লা বোঝাতে চেষ্টা করে।
— ছি ছি ছি, মানস শেষ পর্যন্ত এ-সব…
— দাদা আমরা একটু ব্যস্ত আছি। পরে ফোন করে নেব। কল কেটে দেয় শুক্লা। এ মুহূর্তে জনে জনে ব্যাপারটা পরিষ্কার করার মতো মানসিকতা নেই।

থানার বড়োবাবু খুবই ভালো ব্যবহার করলেন। হয়তো সাথে রাজনৈতিক নেতা আছে বলেই। উনি জানালেন, তদন্ত একটা চলছে। ইতিমধ্যে মানসবাবুর নামে একটা অভিযোগপত্র জমাও পড়েছে। মানস বড়বাবুকে বিভিন্ন প্রমাণ দেখিয়ে বোঝাতে চাইলেন, ওই মানুষটা মানস নন। পুলিশ সব শুনল, তারপর বলল— মানসবাবুর বাড়ির উপর নজর রাখা হবে যাতে আর হাঙ্গামা না হয়। আর কয়েকদিন বাড়ির বাইরে না বের হওয়াই ভালো।

পুলিশের উপদেশটাই মেনে নিয়েছিল মানস। তিনদিন স্বেচ্ছায় গৃহবন্দী হয়ে থাকার পর অফিসের জন্য বের হল। এই তিনদিন পরিবারসহ একটা অবিশ্বাসের পৃথিবীতে ছিলেন যেন। আত্মীয়দের ফোন— ছি ছি-কার। প্রতিবেশীদের উৎসাহ ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ জানার। ফেসবুক উপচে পড়া গালিগালাজ। মানস-শুক্লা-পিংকি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। দু-একটা মিডিয়া থেকেও ফোন করে বাইট চেয়েছিল। ফোন কেটে দেয় পিংকি। সম্পূর্ণ অন্য একটা মানুষের দায় মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে মানসকে। তবে কি ও মিশে যাচ্ছে ওই বুড়ো লোকটার সাথে, এক হয়ে যাচ্ছে দু-জনে। ওর নিজস্ব পরিচয় ক্রমশ মুছে যাচ্ছে এই পৃথিবী থেকে! একটা সম্পূর্ণ মানুষ, যার নামটুকুও জানা নেই, তাঁর সবটুকু দায় মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হবে কি তবে সারাজীবন। চারপাশ বন্ধ ঘরে এটাই মাথায় ঘুরে যায় মানসের। বাড়িতে দমবন্ধ পরিবেশ। না খেলেই নয়, তাই রান্নাটুকু যৎসামান্য করছে শুক্লা।

বাঁচার জন্যই এই পৃথিবীর সব সম্পর্ক ছেদ করেছে মানসরা। ফোন বন্ধ করে রেখেছে, দরজা-জানলা বন্ধ করে প্রতিবেশীদের সাথে দূরত্ব তৈরি করেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় সমস্ত অ্যাকাউন্ট ডিলিট করেছে। এই তিনদিন অবিশ্বাসের চাদরের সাথে যুদ্ধ করেছে মানস। যে-চাদরে আটকা পড়েছে নিজের সত্তা। মানসের ইচ্ছা করছিল এভারেস্টের চূড়ায় গিয়ে চিৎকার করে পৃথিবীকে জানায়— ওই লোকটা মানস নয়।
ট্রেনে নিয়মিত কামরাতে উঠল মানস। নিত্যযাত্রীদের একটা গ্রুপের সাথে যায় ও প্রতিদিন।
— আরে, তোমাকেই তো খুঁজছি। বেমালুম বেপাত্তা তিনদিন। ওকে দেখেই দত্তদা বলে উঠলেন।
— বসো বসো এখানে। ভিড় ঠেলে আসা মানসকে নিজের জায়গা ছেড়ে দেন চক্রবর্তীদা।
— তা তুমি ঠিকই করেছ দু-ঘা দিয়ে। আমি থাকলে তো ব্যাটাকে বুঝিয়ে দিতাম। নোংরামি করবি তো নিজের বাড়িতে করো, পাবলিক প্লেসে কেন?
— দত্তদা, ওই লোকটা আমি… নিজেকে নিয়ে ভুল বোঝাবুঝিটা বোঝাতে চায় মানস।
— আরে তুমি কেন, সবাই লোকটাকে হাতের কাছে পেলে মারত। নোংরামো করবে আর তর্কও করবে।

ট্রেনের কামরায় আইপিএল থেকে কাশ্মীর সমস্যা, নির্বাচন থেকে চন্দ্রযান— সবকিছুর ‘ঘণ্টাখানেক সঙ্গে’ তর্ক চলতে পারে। মানসও প্রতিদিন এতে যোগ দেয়। আজ ওর মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। আর থাকতে না পেরে চিৎকার করে উঠল— ওই লোকটা মানস নয়।

বাসে ওঠা মাত্র মানস দেখল দুটো কম-বয়সী মেয়ে ওকে দেখে ফিসফিস করছে। রুমাল বের করে ঘাম মুছতে থাকল ও। ঘাম মুচ্ছছে নাকি মুছে ফেলতে চাইছে ওই লোকটার পরিচয়! নাকি রুমালের আড়ালে ঢাকতে চাইছে ও নিজের লজ্জা।

অফিসে একটু স্বস্তি পেল মানস। ঘটনার দিন ও অফিসেই ছিল সারাদিন। তবু কোথায় যেন একটা অবিশ্বাসের ছায়া। কলিগরা এ বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করেনি যদিও। শেষবেলায় সুখবরটা দিল সুজিত। খবরে দেখাচ্ছে সেই ঘটনার অভিযুক্তরা গ্রেপ্তার। স্বস্তির শ্বাস ফেলল মানস। ফোন করে খবরটা দিল বাড়িতে। ইন্টারনেটের নিউজ পোর্টালে একই খবর পড়ল মানস। বুকটা হালকা হল। সুজিতকে দিয়ে খবরের প্রিন্ট-আউট করিয়ে বেরিয়ে পড়ল মানস অফিস থেকে।

ফেরার সময় বাসে সকালের মেয়ে দুটোকে খুঁজছিল মানস। দেখা পাওয়ার কথা নয়। তবু দেখা পেলে প্রিন্ট-আউটে খবরটা পড়াত। ট্রেনেও দত্তদা বা চক্রবর্তীবাবুর দেখা মিলল না। ওনারা অনেক পরের ট্রেনে ফেরেন। স্টেশনে নেমে গরম রসগোল্লা কিনল মানস। শুক্লা বড়ো পছন্দ করে। আজ সকলকে বিশ্বাস করাতে পারবে— ওই লোকটা মানস ছিলেন না। রাস্তার ড্রেনের পাশে বাড়ির পাঁচিলে ‘বিজ্ঞাপন নিষেধ’ বিজ্ঞপ্তির উপর কে বা কারা অপটু হাতে লেখা পোস্টার লাগিয়ে গেছে— দাদুর শাস্তি চাই। মানস দ্রুত বাড়িতে ঢুকে আঠা নিয়ে এসে পোস্টারের উপর অভিযুক্তের গ্রেপ্তারের খবরের প্রিন্ট-আউটটা আটকাতে থাকে। নীচে নর্দমার নোংরা জলে ওর হাসিমুখটা ধরা থাকে।

Facebook Comments

পছন্দের বই